
ছবি: সংগৃহীত
আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে জার্মানি অন্যতম জনপ্রিয় গন্তব্য। এর পিছনে রয়েছে অনেক কারণ। জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের উচ্চ শিক্ষাগত মানের জন্য বিশ্বজুড়ে সুপরিচিত। এখানকার শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের জন্য মূল্যবান সংযোগ তৈরির সুযোগ, জ্ঞান বিস্তারের পথ এবং পছন্দের ক্যারিয়ার গড়ার জন্য দক্ষতা অর্জনের সুযোগ করে দেয়। তবে শুধু এতেই শেষ নয়—জার্মানিতে পড়াশোনার আগে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানা অত্যন্ত জরুরি।
শুধু পড়াশোনা নয়, জার্মানিতে থাকাকালীন শিক্ষার্থীরা ঐতিহাসিক স্থান ভ্রমণ, প্রকৃতিতে ঘুরে বেড়ানো, আর স্থানীয় খাবারের স্বাদ নেওয়ার মতো নানা অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারেন। তবে যাওয়ার আগে কিছু বিষয় অবশ্যই জেনে নেওয়া উচিত। এই নির্দেশিকায় জার্মানিতে পড়াশোনা শুরুর আগে প্রয়োজনীয় সব তথ্য পেয়ে যাবেন।
১. জার্মান শিক্ষাব্যবস্থা বোঝা
জার্মানিতে উচ্চশিক্ষার জন্য নানা ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে—বিশ্ববিদ্যালয়, অ্যাপ্লায়েড সায়েন্স ইউনিভার্সিটি, কলেজ ও প্রাইভেট ইনস্টিটিউট। সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাত্ত্বিক শিক্ষা দেওয়া হয়, আর অ্যাপ্লায়েড সায়েন্স ইউনিভার্সিটিগুলো বেশি গুরুত্ব দেয় ব্যবহারিক শিক্ষায়। প্রাইভেট ইনস্টিটিউট ও কলেজগুলো মূলত সৃজনশীল বিষয়ে আগ্রহীদের জন্য।
জার্মানিতে ইউরোপের বোলোনিয়া প্রসেস অনুযায়ী উচ্চশিক্ষা পরিচালিত হয়, যার ফলে এখানে ব্যাচেলর, মাস্টারস এবং পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করা যায়। সাধারণত ব্যাচেলর ডিগ্রি তিন থেকে চার বছর আর মাস্টারস ডিগ্রি তিন থেকে পাঁচ বছর মেয়াদী। বর্তমানে অনেক কোর্স ইংরেজিতেও পড়ানো হয়, তবে বেশিরভাগ কোর্সই জার্মান ভাষায়। তাই আগেই ভাষার যোগ্যতা যাচাই করে নিতে হবে। জার্মান ভাষার কোর্সে ভর্তি হলে TestDaF বা DSH পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া বাধ্যতামূলক।
২. আবেদন প্রক্রিয়া
সঠিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কোর্স নির্বাচন করতে আগে থেকেই বিস্তারিত গবেষণা করা জরুরি। এই ক্ষেত্রে DAAD (জার্মান অ্যাকাডেমিক এক্সচেঞ্জ সার্ভিস)-এর মতো বিশ্বস্ত প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মান, অবস্থান এবং সেখানে জীবনযাত্রার খরচ—সবকিছু বিবেচনা করুন।
ভর্তির যোগ্যতা প্রতিষ্ঠান ও কোর্স অনুযায়ী ভিন্ন হয়। সাধারণত, স্বীকৃত মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট, ভাষার দক্ষতার প্রমাণ এবং কিছু ক্ষেত্রে প্রি-ইউনিভার্সিটি কোয়ালিফিকেশন বা প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রয়োজন হয়। মাস্টারস প্রোগ্রামের জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ব্যাচেলর ডিগ্রি লাগবে।
ভর্তি আবেদনের সময়সীমা কঠোর। সাধারণত, শীতকালীন সেমিস্টারের আবেদন মে থেকে জুলাই এবং গ্রীষ্মকালীন সেমিস্টারের জন্য ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি মাসের মধ্যে শেষ হয়। আবেদন করতে গেলে একাডেমিক সার্টিফিকেট, ভাষার সনদ, জীবনবৃত্তান্ত (CV), মোটিভেশন লেটার ও সুপারিশপত্র প্রস্তুত রাখতে হবে। কিছু ক্ষেত্রে কাজের অভিজ্ঞতার সনদ বা পোর্টফোলিওও লাগতে পারে।
৩. আর্থিক প্রস্তুতি
জার্মানির অন্যতম বড় সুবিধা হলো—এখানে পড়াশোনার খরচ তুলনামূলকভাবে কম। বেশিরভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশন ফি নেই বা খুবই সামান্য। ফলে শিক্ষার্থীরা উচ্চমানের শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পান, বড় আর্থিক চাপ ছাড়াই।
তবে জীবনযাত্রার খরচ শহরভেদে আলাদা হয়। গড়ে মাসে ৮৫০ থেকে ১২০০ ইউরো প্রয়োজন পড়তে পারে, যার মধ্যে বাসা ভাড়া, খাবার, স্বাস্থ্যবিমা, যাতায়াত, ফোন/ইন্টারনেট, পড়াশোনার উপকরণ ও বিনোদন খরচ অন্তর্ভুক্ত। DAAD, Erasmus+ এবং আরও নানা সংস্থা থেকে স্কলারশিপ পাওয়া যায়। আগে থেকেই এগুলো খুঁজে আবেদন করুন।
৪. ভিসা ও রেসিডেন্স পারমিট
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে থেকে আসা শিক্ষার্থীদের স্টুডেন্ট ভিসা নিতে হয়। নিজ দেশের জার্মান দূতাবাস বা কনস্যুলেটে আবেদন করতে হবে। ভিসার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পত্র, আর্থিক সামর্থ্যের প্রমাণ, স্বাস্থ্যবিমা এবং বৈধ পাসপোর্ট লাগবে।
জার্মানিতে পৌঁছানোর পর স্থানীয় Foreigners' Registration Office-এ গিয়ে রেসিডেন্স পারমিট নিতে হবে। এর জন্য ভিসা, থাকার প্রমাণ, স্বাস্থ্যবিমা ও বায়োমেট্রিক ছবি লাগবে। এই পারমিটের মাধ্যমে পড়াশোনার পুরো সময় জার্মানিতে থাকা যাবে।
৫. স্বাস্থ্যবিমা
জার্মানিতে স্বাস্থ্যবিমা বাধ্যতামূলক। এখানে দু’ধরনের স্বাস্থ্যবিমা আছে—প্রাইভেট ও পাবলিক। বেশিরভাগ শিক্ষার্থী পাবলিক স্বাস্থ্যবিমা নেন, যার মাসিক খরচ প্রায় ১২০ থেকে ১৩০ ইউরো। ভর্তি হতে গেলে স্বাস্থ্যবিমার প্রমাণ লাগবে, তাই আগে থেকেই এটি নিশ্চিত করুন।
৬. আবাসন ব্যবস্থা
জার্মানিতে থাকার জন্য বেশ কিছু বিকল্প আছে—বিশ্ববিদ্যালয় ডরমিটরি, শেয়ার ফ্ল্যাট (WG), বা ব্যক্তিগত অ্যাপার্টমেন্ট। ডরমিটরি তুলনামূলক সাশ্রয়ী হলেও অনেক বেশি চাহিদাসম্পন্ন। ব্যক্তিগত অ্যাপার্টমেন্টে স্বাধীনতা থাকলেও খরচ বেশি। শেয়ার ফ্ল্যাট বেশ জনপ্রিয় এবং সাশ্রয়ী। Studentenwerk বা WG-Gesucht ওয়েবসাইটে ঘর খুঁজতে পারেন। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসন সহায়তা থাকে।
৭. সংস্কৃতিতে মানিয়ে নেওয়া
জার্মানিতে মানিয়ে নিতে হলে স্থানীয় সংস্কৃতি জানতে হবে। যদিও অনেক কোর্স ইংরেজিতে পড়ানো হয়, তবে জার্মান ভাষা শিখলে দৈনন্দিন জীবনে অনেক সহজ হবে এবং চাকরির ক্ষেত্রেও সুবিধা পাবেন।
জার্মানরা সময়নিষ্ঠতা, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও সরাসরি কথা বলা পছন্দ করেন। সময়মতো উপস্থিত থাকা, ব্যক্তিগত পরিসর সম্মান করা এবং খোলামেলা মতামত গ্রহণ করা এখানে স্বাভাবিক।
বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্লাব, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বা আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য আয়োজিত অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারেন।
৮. পড়াশোনার পাশাপাশি কাজের সুযোগ
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরের শিক্ষার্থীরা বছরে ১২০ দিন ফুল-টাইম বা ২৪০ দিন পার্ট-টাইম কাজ করতে পারেন। সাধারণ ছাত্র চাকরির মধ্যে টিউশনি, ক্যাফেতে কাজ বা পড়াশোনার বিষয় সংশ্লিষ্ট ইন্টার্নশিপ বেশি জনপ্রিয়।
ইন্টার্নশিপের মাধ্যমে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায়। অনেক কোর্সেই বাধ্যতামূলক ইন্টার্নশিপ থাকে। তবে কাজের নিয়মনীতি জেনে তবেই কাজ শুরু করুন।
৯. যাত্রার প্রস্তুতি
জার্মানিতে সব ঋতু থাকে, তাই আবহাওয়া অনুযায়ী পোশাক গুছিয়ে নিন। গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট, ওষুধপত্র ও প্রয়োজনীয় ইলেকট্রনিক্স অবশ্যই সাথে রাখুন।
আগাম বিমানবন্দর থেকে যাতায়াতের ব্যবস্থা করে রাখুন, প্রয়োজনে সাময়িক থাকার জন্য হোটেল বুক করে নিন। হাতে কিছু ইউরো রাখুন যাতে প্রাথমিক খরচ মেটানো যায়।
জার্মানিতে পড়াশোনা শুধুমাত্র শিক্ষা নয়, জীবনের একটি বড় অভিজ্ঞতা। সঠিক প্রস্তুতি ও পরিকল্পনার মাধ্যমে এই অভিজ্ঞতা আরও সুন্দর ও সফল হবে। সঠিক তথ্য, আর্থিক প্রস্তুতি, আবাসন নিশ্চিতকরণ, ভাষা শিখে সংস্কৃতিতে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া—সব মিলিয়ে এই অভিজ্ঞতা হতে পারে আপনার জীবনের অন্যতম সেরা অধ্যায়।
আবির