
“ওকি গাড়িয়াল ভাই..হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দর এ রে.......” একটি গানের প্রথম লাইন, যা শুনলেই মনটা যেন অজান্তেই ফিরে যায় ফসলের মাঠে, নদীর ঘাটে, কিংবা ধূলিধূসরিত মেঠোপথে হাঁটা গরুর গাড়ির শব্দে। ভাওয়াইয়া শুধু গান নয়—এ যেন উত্তরবঙ্গের হৃদয়স্পন্দন, জীবনের গল্প, বেদনার ভাষা।
ভাওয়াইয়া গানের উৎপত্তি প্রায় দেড় শতাব্দী আগে। কুচবিহার, রংপুর, জলপাইগুড়ি ও দিনাজপুর অঞ্চল জুড়ে এই গান জন্ম নেয় সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে মিশে থাকা দুঃখ, প্রেম, প্রত্যাশা ও বিচ্ছেদের অনুভূতি থেকে। এই গানে কথা বলে গাড়িয়াল, মজুর, কৃষক, পালকি বাহক বা নদীঘাটের নৌকা মাঝি।
গবেষকরা বলেন, “ভাওয়া” শব্দটি এসেছে “বায়ু” বা “হাওয়া” থেকে, যার অর্থ দোল খাওয়া বা ভেসে যাওয়া। এই গান যেন সত্যিই হাওয়ার মতোই গ্রামে গ্রামে ভেসে বেড়াত এক সময়।
আজকের বাস্তবতা ভিন্ন। নতুন প্রজন্মের অনেকেই এই গানের কথা তো দূরের কথা, নামটিও শোনেনি। গ্রামের মাঠের বদলে এখন তরুণদের মনোযোগ মোবাইল স্ক্রিনে। গান শোনা হয় ইউটিউবে, তাও বেশিরভাগই আধুনিক পপ কিংবা হিপহপ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আধুনিকতার জোয়ারে হারিয়ে যাচ্ছে লোকসংস্কৃতি। পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, ডিজিটাল সংরক্ষণের উদ্যোগের সীমাবদ্ধতা ও তরুণ প্রজন্মের আগ্রহহীনতা এই বিপন্নতার পেছনে বড় কারণ।
তবে আশার কথা, কিছু সংগঠন ও নতুন প্রজন্মের কিছু শিল্পী ভাওয়াইয়া রক্ষায় এগিয়ে আসছেন। রংপুরের “ভাওয়াইয়া সংরক্ষণ পরিষদ” নামে একটি সংগঠন স্কুল-কলেজে কর্মশালা করছে, স্থানীয় শিল্পীদের নিয়ে গান রেকর্ড করছে এবং ইউটিউবের মাধ্যমে সেই গান বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরছে।
ভাওয়াইয়া আমাদের আত্মপরিচয়ের অংশ। এটিকে টিকিয়ে রাখতে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্তি, মিডিয়ায় প্রচার এবং স্থানীয় পর্যায়ে উৎসবের আয়োজন দরকার।” যতদিন মানুষের মধ্যে ভালোবাসা থাকবে নিজের শেকড়ের প্রতি, ততদিন হারিয়ে যাওয়া ভাওয়াইয়াও হয়তো একদিন ফিরে আসবে তার প্রকৃত মর্যাদায়।
নোভা