ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৪ মে ২০২৫, ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

১৫৭ বছরেও জাতীয়করণ হয়নি ঐতিহ্যবাহী উলিপুর মহারাণী স্বর্ণময়ী বিদ্যাপীঠ

রফিকুল ইসলাম রফিক, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, কুড়িগ্রাম

প্রকাশিত: ১৯:১৭, ২৩ মে ২০২৫; আপডেট: ১৯:১৮, ২৩ মে ২০২৫

১৫৭ বছরেও জাতীয়করণ হয়নি ঐতিহ্যবাহী উলিপুর মহারাণী স্বর্ণময়ী বিদ্যাপীঠ

উলিপুর মহারাণী স্বর্ণময়ী বিদ্যাপীঠ

উত্তরাঞ্চলের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কুড়িগ্রামের উলিপুর মহারাণী স্বর্ণময়ী স্কুল অ্যান্ড কলেজ ১৫৭ বছরেও জাতীয়করণের আলো দেখেনি। কালের সাক্ষী এই শিক্ষাঙ্গণ আজও সরকারি স্বীকৃতির অপেক্ষায়। এলাকাবাসী, প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা মনে করেন, রাজনৈতিক অবহেলা ও প্রশাসনিক উদাসীনতার কারণেই জাতীয়করণ করা হয়নি প্রতিষ্ঠানটি।
একসময় বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব সেলিম আল দীন, কবি কালিদাস শেখর সহ অনেক স্বনামধন্য ব্যক্তিদের পদচারণায় মুখরিত ছিল এ বিদ্যাপীঠ।
১৮৬৮ সালে কাশিমবাজারের জমিদার কৃষ্ণচন্দ্রের স্ত্রী মহারানি স্বর্ণময়ী বাহারবন্দ পরগনার দরিদ্র প্রজাদের শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে নিজস্ব জমিতে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। পালকিতে চড়ে নিজে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্র সংগ্রহের ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী এই প্রতিষ্ঠান। সময়ের ধারাবাহিকতায় এটি মাধ্যমিক, কারিগরি ও উচ্চ মাধ্যমিক শাখায় রূপান্তরিত হয়েছে।
এই বিদ্যাপীঠে অধ্যয়ন করেছে নাট্যব্যক্তিত্ব সেলিম আল দীন,  প্রকৌশলী আবুল বিশিষ্ট চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ এম এন হুদা, কাশেম চাঁদ (চাঁদ কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা), বীর বিক্রম শওকত আলী সরকারসহ বহু বিশিষ্টজন। ১৯৭১ সালে এই প্রতিষ্ঠান থেকে শতাধিক ছাত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। বর্তমানে এখান থেকে লেখাপড়া করে দেশবিদেশে বহু ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত রয়েছেন।
একাধিক অভিভাবক ও স্থানীয় নাগরিকদের মতে, জাতীয়করণ না হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও শিক্ষক নিয়োগে দীর্ঘসূত্রতা দেখা দেয়। মো. শহিদুল ইসলাম নামপর একজন অভিভাবক বলেন, “আমার ছেলে এখানে পড়ে। সরকারি হলে যেমন নিয়মিত শিক্ষক পাওয়া যেত, উন্নয়ন কাজ হত, তা হচ্ছে না।” রাবেয়া খাতুন নামের একজন প্রাক্তন ছাত্রী জানান, “আমি এখন ঢাকায় একটি ব্যাংকে চাকরি করি। এই স্কুলের জন্যই আমি আজ এ জায়গায়। কিন্তু এত পুরোনো স্কুলটি কেন এখনও সরকারীকরণ হলো না, বুঝতে পারি না।” মো. আনোয়ার হোসেন নামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক বলেন, “১৯৯৭ সালে যখন কারিগরি শাখা খোলা হয়, তখনও আমরা আশাবাদী ছিলাম। কিন্তু প্রতিবার জাতীয়করণ তালিকায় উঠে, আবার বাদ পড়ে যাই।”
বিদ্যালয়ে বর্তমানে ১৩টি ভবনে প্রায় ৪০টি কক্ষে পাঠদান চলে। শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ২,৫০০ জন এবং শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ৮০। রয়েছে কম্পিউটার ল্যাব, বিজ্ঞানাগার, খেলার মাঠ, শাহী মসজিদ ও জগদ্ধাত্রী মন্দির। ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক চর্চায় প্রতিষ্ঠানটি সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত।
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আব্দুল কাদের বলেন, “আমি দীর্ঘদিন এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলাম, অনেক চেষ্টাকরেও জাতীয়করণ করতে পারি নাই, হাজার হাজার স্টুডেন্ট এই প্রতিষ্ঠান থেকে অনেক বড় বড় জায়গায় চান্স পেয়েছে, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে হাজার হাজার স্টুডেন্ট, এই প্রতিষ্ঠান সরকারি করা এখন সময়ের দাবি।
বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. জাহাঙ্গীর আলম সরদার বলেন, উলিপুর মহারাণী স্বর্ণময়ী স্কুল অ্যান্ড কলেজ শুধু একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, এটি এ অঞ্চলের মানুষের আত্মার সঙ্গে মিশে থাকা এক ঐতিহ্য। এই প্রতিষ্ঠানে যারা পড়েছেন, তারা দেশ-বিদেশে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে অধিষ্ঠিত। আমরা দীর্ঘদিন ধরে জাতীয়করণের জন্য আবেদন করে আসছি। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানে প্রায় ২,৫০০ শিক্ষার্থী রয়েছে, যাদের সুশৃঙ্খল পাঠদান, নিয়মিত শিক্ষক নিয়োগ এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য জাতীয়করণ অত্যন্ত জরুরি।
তিনি আরো বলেন,প্রতি বছর উলিপুর মহারাণী স্বর্ণময়ী স্কুল এন্ড কলেজ থেকে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়ে থাকেন শিক্ষার্থীরা। চলতি ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে তৌফিকুর রহমান তরঙ্গ ভর্তি পরীক্ষায় ১১ তম স্থান অধিকর করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছে। আরাফাত আহমেদ রুপক,বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট),ফারিয়া আনজুম অর্পি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,রাফিউজ্জামান রাফি বাংলাদেশ ইউনিভারসিটি অব টেক্সটাইল (বুটেক্স),রেদওয়ানুল কবির জিহাদ ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,সাদিদুর রহমান সেবিব,আরাফাত হোসেন মাছুম প্লাবন বিশ্ববিদ্যালয়,
প্রীতম ঘোষ শ্যাজালাল বিমান এ প্রযুক্তি,মোঃ রিফাত খন্দকার,মোছাঃ আয়শা সিদ্দিকাসহ ২৪ জন শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। এরকম প্রতি বছর আমাদের উলিপুর মহারাণী স্বর্ণময়ী স্কুল এন্ড কলেজ থেকে  ভালো ভালো জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে এটা আমাদের গর্ব। "উলিপুর মহারানী স্বর্ণময়ী স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন । দুঃখের বিষয় হচ্ছে এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি জাতীয়করণের আওতায় আনতে পারিনি ।
মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার কাছে আমাদের আকুল আবেদন—এই ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠকে জাতীয়করণের মাধ্যমে একটি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিন। আমরা বিশ্বাস করি, এই স্বীকৃতি পেলে আমাদের প্রতিষ্ঠান আরও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবে।”
একটি প্রতিষ্ঠানের জাতীয়করণ কেবল সরকারি অর্থায়নের বিষয় নয়—এটি ইতিহাস, উত্তরাধিকার ও প্রজন্মের প্রতি রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতার প্রতীক। উলিপুর মহারাণী স্বর্ণময়ী স্কুল অ্যান্ড কলেজের মতো শতবর্ষী প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও তাৎপর্যপূর্ণ। অবিলম্বে জাতীয়করণের উদ্যোগ গ্রহণ না হলে এই ঐতিহ্য হারানোর শঙ্কা থেকেই যাবে।

সাব্বির

×