ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৭ জুন ২০২৫, ১৩ আষাঢ় ১৪৩২

‘কিলো ফ্লাইট’ একখানা অসমাপ্ত বই

ক্যাপ্টেন আলমগীর সাত্তার 

প্রকাশিত: ২২:২২, ১৯ অক্টোবর ২০২৩

‘কিলো ফ্লাইট’ একখানা অসমাপ্ত বই

সদ্য প্রকাশিত ‘কিলো ফ্লাইট’ নামের বইখানার লেখক আমি নিজেই

আমাদের বর্তমান বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠিত হয়েছিল ১৯৭১ সালে ভারতের নাগাল্যান্ড রাজ্যের রাজধানী ডিমাপুরে। তখন স্বাধীন বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর নামকরণ করা হয় ‘কিলো ফ্লাইট’। স্বাধীন বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রধান ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার। তাঁর নামের প্রথম অক্ষর ‘ক’ এভিয়েশন টার্মিয়োনজিতে উচ্চারিত হয় কিলো (করষড়) বলে। তাই আমাদের বিমানবাহিনীর নামকরণ করা হয়েছিল ‘কিলো ফ্লাইট’ বলে।

সদ্য প্রকাশিত ‘কিলো ফ্লাইট’ নামের বইখানার লেখক আমি নিজেই। আবার একথাও বলছি, বইখানা অসমাপ্ত। তবে আমি কেন এমন অসমাপ্ত বই লিখলাম?
আমার উত্তর: খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে আমি শতভাগ তথ্য পরিবেশন করতে পারছি না, কিন্তু আশি শতাংশ তথ্য পরিবেশন করতে পারছি। পাঠক ঐতিহাসিক এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে একদম কিছুই না জানার চেয়ে আশি শতাংশ জানাও তো একেবারে মূল্যহীন নয়!
বইখানার বিষয়বস্তুর কিছু অপূর্ণতা থাকার কারণ এবার উল্লেখ করছি:
আমাদের বর্তমান বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠিত হয়েছিল ১৯৭১ সালে ভারতের নাগাল্যান্ড রাজ্যের রাজধানী ডিমাপুরে। তখন স্বাধীন বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর নামকরণ করা হয় ‘কিলো ফ্লাইট’। স্বাধীন বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রধান ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার। তাঁর নামের প্রথম অক্ষর ‘ক’ এ্যাভিয়েশন টার্মিয়োনজিতে উচ্চারিত হয় কিলো (করষড়) বলে। তাই আমাদের বিমানবাহিনীর নামকরণ করা হয়েছিল ‘কিলো ফ্লাইট’ বলে।
ওই সময় ক্যাপ্টেন খালেক, ক্যাপ্টেন মুকিত এবং আমাকে নির্বাচন করা হয়েছিল কিলো ফ্লাইটের ডাকোটা অ্যারোপ্লেনখানা চালানোর জন্য। ডাকোটা অ্যারোপ্লেন দিয়ে শুধু একটি মাত্র অভিযান পরিচালনা করার কথা ছিল। সেটা ছিল একটি নির্দিষ্ট দিনে ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরের ওপর প্রতিটি এক হাজার পাউন্ডের পাঁচটি (সর্বমোট পাঁচ হাজার পাউন্ড) বোমা বর্ষণ করতে হবে। ওই পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের দেড় মাসব্যাপী কঠিন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল।
কোন্দিন অভিযানে যেতে হবে, তা আমাদের জানা ছিল না। তাই দিনটার জন্য আমরা অপেক্ষায় ছিলাম। অবশেষে নির্দেশ দেওয়া হলো নভেম্বর মাসের দুই তারিখ মধ্যরাতে ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরের ওপর বোমাবর্ষণের অভিযানে যেতে হবে।
নভেম্বরের দুই তারিখ সকাল দশটায় ডিমাপুর থেকে আমাদের আসতে হবে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের কৈলাস শহর নামের একটি পরিত্যক্ত বিমান ঘাঁটিতে।
আমাদের ডাকোটা প্লেনের ইন্সট্যাক্টর স্কো. লি. সঞ্জয় কুমার জোরহাট বিমান ঘাঁটি থেকে একখানা ডাকোটা প্লেন নিয়ে আসবেন। তিনি ওই প্লেনে আমাদের নিয়ে যাবেন কৈলাস শহরে। ঢাকায় অভিযান পরিচালনা করবেন ওই ডাকোটা প্লেন দিয়ে।
সঞ্জয় কুমার চৌধুরীর ডিমাপুর পৌঁছানোর কথা ছিল সকাল দশটায়। আমাদের বিমানবাহিনী প্রধান এ কে খন্দকারসহ আমরা ডিমাপুরে আমাদের আবাসস্থলে অপেক্ষা করছিলাম।
কিছুটা সময় বিলম্ব করে সকাল এগারোটায় চন্দন সিং এবং সঞ্জয় কুমার এলেন। চন্দন সিং দিল্লি থেকে পাঠানো একটি টেলেক্স বার্তা খন্দকার সাহেবের কাছে দিলেন। ওই টেলেক্স বার্তায় লেখা ছিল, ডাকোটা অ্যারোপ্লেন দিয়ে ঢাকায় অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়েছে। ডাকোটা প্লেনের পাইলটরা ব্যারাকপুর বিমান ঘাঁটিতে গিয়ে অবস্থান করবে। তাঁদেরকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধানের অধীনস্থ করা হলো। ওই নির্দেশ অনুযায়ী ক্যাপ্টেন খালেক, মুকিত এবং আমি ব্যারাকপুর বিমান ঘাঁটিতে চলে গেলাম।
এসব কারণে চূড়ান্ত যুদ্ধের সময় কৈলাস শহরে আমাদের যাওয়ার আর সুযোগ হয়নি। তাই আমাদের অটার এবং হেলিকপ্টারের আকাশযুদ্ধের বিস্ময়কর সাফল্যের কথাও সরাসরি জানার সুযোগ হয়নি। আমরা কেবল কর্নেল ওসমানীকে নিয়ে ছয়-সাতটি ফ্লাইট করেছি।
যুদ্ধের পরবর্তী সময় ক্যাপ্টেন আকরামের কাছ থেকে অটার প্লেনের এবং ক্যাপ্টেন শাহাবের কাছ থেকে হেলিকপ্টারের যেটুকু তথ্য জেনেছি, তা এ বইয়ে তুলে ধরেছি। ক্যাপ্টেন আকরাম জীবিত থাকাকালে কিলো ফ্লাইট সম্পর্কে আমি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কিছু লেখা লিখেছি। সে সব লেখা আকরামকে দেখিয়েও নিয়েছি।
শাহাব, আকরামের সঙ্গে নিত্যদিন আড্ডা দিতে গিয়ে কিলো ফ্লাইটের অটার এবং হেলিকপ্টারের অপারেশন প্রসঙ্গ নিয়ে যে সব কথাবার্তা হয়েছে, সেসব এখন তো ভুলেই গিয়েছি। বইখানা যদি এখন থেকে ২০ বছর আগে লিখতাম, তবে বইখানা অনেকটাই পূর্ণতা লাভ করত। আমি কখনও চিন্তা করি নাই একদিন কিলো ফ্লাইট নিয়ে বই লিখব। চিন্তা করলে আকরাম, শাহাবের কাছ থেকে সব তথ্য সংগ্রহ করে লিখে রাখতাম। তা যখন করি নাই তখন আক্ষেপ করে লাভ নাই।
বর্তমান সময়ে এসে ভেবে দেখলাম, এখনো যদি অবহেলা করি, তবে আমাকে দায়িত্ববান মানুষ বলে গণ্য করা উচিত হবে না। মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে গৌরবময় ইতিহাস আর লিখিতভাবে থাকবে না। যে জাতি তার গৌরবময় ইতিহাস লিখে রাখে না, সে জাতির ভবিষ্যৎও গৌরবময় হতে পারে না। সে জাতির মধ্যে আত্মবিশ্বাসেরও কমতি হয়।
কিলো ফ্লাইটের পাইলটরা এক এক করে এই ইহজগতের মায়া কাটিয়ে অজানা জগতের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিচ্ছেন। যেমনÑ অটার প্লেনের তিনজন পাইলটের তিনজনই মারা গিয়েছেন। ক্যাপ্টেন সরফুদ্দিন ১৯৭২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ডাকোটা ক্র্যাশে মারা যান। ক্যাপ্টেন আকরাম তিন বছর আগে করোনায় মারা গেছেন। শামসুল আলম দীর্ঘদিন ক্যান্সারে ভুগে কয়েক মাস আগে মারা গেছেন। এখন যদি কেউ অটার প্লেনের অভিযান সমূহের বিস্তারিত জানতে চান, তিনি সেটা আর পারবেন না।
হেলিকপ্টারের পাইলট সুলতান মাহমুদ কয়েক মাস আগে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন। ক্যাপ্টেন শাহাব এবং বদরুল আলমের স্বাস্থ্যও ভালো যাচ্ছে না। ডাকোটা প্লেনের পাইলট ক্যাপ্টেন মুকিত এবং আমি জীবিত আছি। কিন্তু আমরা তো আকাশযুদ্ধে অংশগ্রহণ করিনি। কর্নেল ওসমানীকে নিয়ে কয়েকটি ফ্লাইট করেছি মাত্র। এসব কারণে বইখানা লেখার বিষয়ে আমার যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা ছিল।
বইখানা আরো কিছুটা পূর্ণতা পেতে পারত যদি আমি তাড়াহুড়ো না করতাম। আমি তাড়াহুড়ো করেছি এই কারণে যে, আমাদের বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রতিষ্ঠা দিবস অর্থাৎ ২৭ সেপ্টেম্বরের আগে যাতে প্রকাশিত হয় এবং আমাদের বিমানবাহিনীর প্রধানের কাছে তা তুলে দিতে পারি।
এত সীমাবদ্ধতার পরেও বলব, কিলো ফ্লাইটের সব ঘটনার আশি শতাংশই আমি এ বইয়ে গ্রন্থনা করতে সক্ষম হয়েছি।

×