ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

গল্প ॥ সেল্ফি

শাওন আসগর

প্রকাশিত: ০১:৪২, ১২ আগস্ট ২০২২

গল্প ॥ সেল্ফি

সেল্ফি

আজ চৌদ্দ জুলাই২০২২সন্ধ্যার পর থেকেই আমার শরীর ভালো নেইমন ভালো নেইএই ঘরের আলমারী, পোশাক, ডাইনিং টেবিল, ড্রইংয়ের সোফা, টিভি. কম্পিউটারের মনিটর কিচ্ছু ভালো নেইভালো নেই আমার মেয়ে তানিশার মনও, ওরা বাবার মনসবার ভেতরে কষ্টের সুনামী বইছেপ্রচ- ঠা-ার বরফ জমে আছে আমাদের শরীরেঅথবা তীব্র তাপপ্রবাহের জ¦ালা আমাদের দেহের প্রতি রোমকূপে

ভালো নেই ঘরের সদর দরোজা, যে দরোজা দিয়ে সানি ঘরের বের হলো সকাল সাতটায়ছেলেটা গেলো তখন আমি আর শোয়া থেকে উঠিনিতবে জেগেই ছিলামকারণ, ওর বাবা আরো সকালে চলে যায়আমার তেমন কোনো কাজ থাকে নাতাই একটু আলসেমি করি এবং বয়সের ভারে শরীরে গিঁটে গিঁটে যে ব্যথা, তার উপশম ঘটাইসানি বের হলে দরোজা খুলে তানিশা আবার বন্ধ করেছে এই শব্দ আমি পেয়েছিযাবার সময় আমার রুমের কাছে গলা বাড়িয়ে ছেলেটা বলে গেলো- মা আমি বের হচ্ছিআমি বললাম- যাও আল্লাহ ভরসা

শরীর ব্যথার কারণে সকালে উঠতে আমার দেরি হয়তানিশা নিজে নিজে নাস্তা রেডি করে খেয়ে কলেজে যখন যাবার প্রস্তুতি নেয়, তখন আমি দেহের সমস্ত শক্তি এক করে উঠি, বসি, একটু হাঁটিধীরে ধীরে ঘরের সব রুমে চোখ রাখি, তারপর নিজের ওষুধ আর নাস্তার দিকে নজর দিই

কেনো যেনো আজ সকালের পর থেকেই মন ভালো ঠেকছে না আমারমেয়েটা বারবার বলছিলো- মা আমাকে শপাঁচেক টাকা দাওএক বান্ধবীর বার্থ ডে, ওকে সবাই মিলে গিফ্ট দেবোআমি একটু রাগ করেই জবাব দিই- সব বান্ধবীর জন্মদিন এলেই তুমি টাকা নিয়ে গিফ্টের একটা আয়োজন করোতোমার জন্মদিনে কেউ কিছু দেয় তাতো শুনি না। -মা আমাকেও দেয়সবাই দেয়, তোমাকে বলি না

আচ্ছা ঠিক আছে এখন থেকে এসব দেয়া-নেয়া কমাতে হবেখেয়াল করো কদিন যাবত লোডশেডিং বেড়েছেদেখো না পানির দাম বেড়েছে, গ্যাসের দাম, তেলের দাম বেড়েছেসবই বাড়তির দিকেতোমার বাবা যে মন খারাপ করে থাকে, তাতো খেয়াল করো নাতার দোকানের ব্যবসা মন্দএখন সবাই কম খরচ করবানা হলে আগামী এক বছরের মধ্যে দেশটা খাঁ হবে, সেসব বুঝো ?

মা আমাকে কেনো বুঝাওতোমার পাঁচশো টাকার জন্য অতো জ্ঞান দিচ্ছো আমাকেভাইয়া যে লাখ লাখ টাকা খরচ করে তখন তো বলো না ?

-তোমার ভাইয়া তো তার পড়াশোনা শেষ করে ফেলেছে প্রায়আর ছয়টা মাসতারপর সে চাকরি করবেসংসারের হাল ধরবেতখন তুমিও খরচ নিতে পারবেএখন থেকে হিসেবি হওমেয়েদের হিসেবি না হলে ঘরে কল্যাণ হয় নাবড় হচ্ছো, বিয়ে সংসার হলে তোমাকেই ঘর সামাল দিতে হবেএখন যদি না শিখো পরের ঘরে গেলে কীভাবে টিকবে?

এসব কথা মেয়ের সাথে বলছি যখন, তখন তানিশা তার কলেজ থেকে ফিরে গোসল সেরে আমার সাথে দুপুরের খাবার খেতে বসেখাবার টেবিলেই অনেকদিন পরপর আমি মেয়ের সাথে কথা বলিমেয়েটা বেশ শান্ত, কখনো মাথা গরম করে নাখুব শান্তভাবে কথা বলবেআর ছেলেটাও আমাদের খুব ভালো, সেও শান্ত ভদ্রধূমপান করবে না, বাইরে অযথা ঘুরবে নাঘরেও বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা মারবে নাওর বাবা এসব নিয়ে মাঝে মাঝে কথা বলে ভয়ের সাথেআমাকে বুঝায়, আজকালকার ছেলেরা অতো শান্ত হলে চলে বলোহইচই করবে, আড্ডা গান সিনেমায় না থাকলে ঘর কেমন মরা মরা লাগে

আমি স্বামীর সাথে এই তর্কে কখনো একমত হই নাআমি বলি, আমার ছেলেমেয়েরা হইচই গান আড্ডা নিয়ে থাকুক তা আমি চাই নাএরকম শান্ত থাকাই আমার পছন্দওরা রাতে ঘরে থাকলেই আমার সারাদিনের ক্লান্তি চলে যায়আমি যখন অনুভব করি আমার দুই ছেলেমেয়ে ঘরে যার যার রুমে আছে, তখনই আমি সুখী হয়ে উঠি

গতকাল রাতে আরিফ বলছিলো, মা পদ্মা সেতু হয়ে গেলোআমরা কয়েক বন্ধু মিলে কাল সকালে দেখতে যাবোবিকেলের আগেই ফিরে আসবোআমাকে ওরা পলাশীর মোড় থেকে কিপআপ করবেখুব সকালে বের হবো, তাই তোমাকে জ¦ালাবো নাতুমি তো দেরি করে ওঠোকোনো টেনশন করো না মাটাইম্লি চলে আসবোতারপরও সকালে সানি ঠিকই সকালে আমার রুমের দরোজায় টোকা দিয়ে বলে গিয়েছে

কিন্তু বিকেল থেকে আমি অস্থির হয়ে আছিভেতরে কেমন যেনো চনমন, একটি হাহাকার করা, চৈত্রের খাঁ খাঁ রোদে যেমোন শরীরে হাঁফাঁস লাগে, ঘরের বিদ্যু চলে গেলে যেনো শরীর ঘেমে যায়, আমার শরীর ও মনের অবস্থা তেমনিআমি সানিকে ফোন দিইওর ফোনে রিং হচ্ছে কিন্তু ধরছে নাএমন এক বোকামি আমি করেছি যে ওর সাথী বন্ধুদের কারো নাম্বারও রাখিনিআমি আরো এক ঘণ্টা পর ফোন দিই তখন সানি ধরেও জবাব দেয়, মা আমরা খুব ব্যস্তখুব আনন্দ করছিতোমার কথা খুব শুনতে পারছি নাআমরা একটি নৌকায় চড়েছি মাসবাই নদীর পানির ¯্রােতে এন্জয় করছিঅনেক অনেক সেল্ফি তুলছিখুব সুন্দর ছবি সবদেখবে বাসায় এলেতুমি আর ফোন দিও নাবাতাসের কারণে শুনতে পাবো নাআমি তীরে ফিরলে তোমাকে ফোন দেবো

আমি শান্ত হইআমার ভেতর মনের খোঁপে এসি চালালে যে প্রশান্তি, সেরকম শীতলতা টের পাইমেয়েটা আমাকে এককাপ কফি করে দেয়দুজনে মিলে খাইওর বাবা তো দোকান থেকে রাত এগারোটার আগে আসে নামা মেয়ে এটা সেটা করে কাটিয়ে দিই

কিন্তু আসলে আমি যে মামার মন সব সময় ব্যাকুলতায় ছেয়ে থাকেআমার মনের চারদিকে টেনশনের ঝোঁপঝাড় তৈরি হয়নদীর শ্যাওলায় আমার পাকে অনঢ় করেআমি অস্থিরতায় কুঁকড়ে যাইমা কী পারে কোনো সন্তান এগারোটার মধ্যে ঘরে না ফিরলে শান্ত থাকতে! ওদের বাবা ফিরে এসেই চোখ বুলায় ঘরেটের পায় কিছু, নাকি আন্দাজে জানতে চায়, সানি আসেনি? আমি বলি, সন্ধ্যার আগে কথা হয়েছেওরা পদ্মা নদীতে নৌকায় ঘুরছেবলো কী, আজকে তো অনেক বাতাসনদীতে ¯্রােত থাকবেপদ্মা তো সর্বনাশাওরা বোকামি করলোদাও দাও ফোন দাও এখনি, নিশ্চয়ই ফিরে আসছেহয়ত ট্রাফিক জ্যামে পড়েছে কোথাওতুমি আবার ফোন দাও

আমি ফোন দিই কোনো শব্দ নেইরিং টোন নেইআবার ফোন দেই, কোনো রিং টোন নেইআবার ফোন দিই কোনো রিং টোন নেই

অতো যে রাত হলো সানি আসে নাঅতো যে রাত যাচ্ছে আমরা কারো ফোনও পাই নারাত বাড়তে বাড়তে একটা দুটো তিনটাকারো ঘুম নেই চোখেসানি ফিরে আসে নাআমার চোখে প্রমত্ত পদ্মার জল থৈ থৈ ¯্রােতধারা, ঢেউয়ের আঘাতে নৌকা ডুবে যাবার শঙ্কামানুষের ভিড় কান্না চিকার সব মিলিয়ে আমি পাগল প্রায়।  কী করবো কোথায় যাবো

আমার ঘর এলোমেলোডাইনিংয়ে সানির জন্য যে খাবার রেখেছি তা খাবার মুখ থুবড়ে পড়ে আছেওর বাবা কাঁঠাল নিয়ে এসেছে, তাতে মাছি বসেছে কটাতানিশার ঘুম নেইসেও অস্থির হয়ে এঘরে ওঘরে যাচ্ছেওর বাবা তো বিমর্ষ হয়ে সোফায় বসে-ওঠে, বারান্দায় যায়, আরেকবার নিচে নামেছেলের জন্য তার অতো মায়া আগে টের পাইনি কখনোআমি কী করবোতানিশাকে বলি আমার মাথায় পানি ঢালতেও পানি ঢালে আমার মাথায়একটু পর, তখন রাত প্রায় তিনটাআমি আবার সানির মোবাইলে ফোন দেইনা কোন শব্দ নেই, রিং টোন নেইঅসার শক্তিহীন শরীর নিয়ে আমি শুয়ে পড়ি সোফায়

ওর বাবা টিভি অন করেতার টিভি দেখার অভ্যাস নেইতবু কী মনে করে যেনো আজ অতো রাতে টিভি অন করে সেতারপর তার চোখ আরো তির্যক করে ব্রেকিং নিউজের দিকে যায়সে পড়ে আপডেট নিউজসে পড়ে আর চিকার দিয়ে বলে, আহ আল্লাহ! আমার ছেলেরে নিয়া গেলেন..?

×