
সেল্ফি
আজ চৌদ্দ জুলাই। ২০২২। সন্ধ্যার পর থেকেই আমার শরীর ভালো নেই। মন ভালো নেই। এই ঘরের আলমারী, পোশাক, ডাইনিং টেবিল, ড্রইংয়ের সোফা, টিভি. কম্পিউটারের মনিটর কিচ্ছু ভালো নেই। ভালো নেই আমার মেয়ে তানিশার মনও, ওরা বাবার মন। সবার ভেতরে কষ্টের সুনামী বইছে। প্রচ- ঠা-ার বরফ জমে আছে আমাদের শরীরে। অথবা তীব্র তাপপ্রবাহের জ¦ালা আমাদের দেহের প্রতি রোমকূপে।
ভালো নেই ঘরের সদর দরোজা, যে দরোজা দিয়ে সানি ঘরের বের হলো সকাল সাতটায়। ছেলেটা গেলো তখন আমি আর শোয়া থেকে উঠিনি। তবে জেগেই ছিলাম। কারণ, ওর বাবা আরো সকালে চলে যায়। আমার তেমন কোনো কাজ থাকে না। তাই একটু আলসেমি করি এবং বয়সের ভারে শরীরে গিঁটে গিঁটে যে ব্যথা, তার উপশম ঘটাই। সানি বের হলে দরোজা খুলে তানিশা আবার বন্ধ করেছে এই শব্দ আমি পেয়েছি। যাবার সময় আমার রুমের কাছে গলা বাড়িয়ে ছেলেটা বলে গেলো- মা আমি বের হচ্ছি। আমি বললাম- যাও আল্লাহ ভরসা।
শরীর ব্যথার কারণে সকালে উঠতে আমার দেরি হয়। তানিশা নিজে নিজে নাস্তা রেডি করে খেয়ে কলেজে যখন যাবার প্রস্তুতি নেয়, তখন আমি দেহের সমস্ত শক্তি এক করে উঠি, বসি, একটু হাঁটি। ধীরে ধীরে ঘরের সব রুমে চোখ রাখি, তারপর নিজের ওষুধ আর নাস্তার দিকে নজর দিই।
কেনো যেনো আজ সকালের পর থেকেই মন ভালো ঠেকছে না আমার। মেয়েটা বারবার বলছিলো- মা আমাকে শ’ পাঁচেক টাকা দাও। এক বান্ধবীর বার্থ ডে, ওকে সবাই মিলে গিফ্ট দেবো। আমি একটু রাগ করেই জবাব দিই- সব বান্ধবীর জন্মদিন এলেই তুমি টাকা নিয়ে গিফ্টের একটা আয়োজন করো। তোমার জন্মদিনে কেউ কিছু দেয় তাতো শুনি না। -মা আমাকেও দেয়। সবাই দেয়, তোমাকে বলি না।
আচ্ছা ঠিক আছে এখন থেকে এসব দেয়া-নেয়া কমাতে হবে। খেয়াল করো কদিন যাবত লোডশেডিং বেড়েছে। দেখো না পানির দাম বেড়েছে, গ্যাসের দাম, তেলের দাম বেড়েছে। সবই বাড়তির দিকে। তোমার বাবা যে মন খারাপ করে থাকে, তাতো খেয়াল করো না। তার দোকানের ব্যবসা মন্দ। এখন সবাই কম খরচ করবা। না হলে আগামী এক বছরের মধ্যে দেশটা খাঁ হবে, সেসব বুঝো ?
মা আমাকে কেনো বুঝাও। তোমার পাঁচশো টাকার জন্য অতো জ্ঞান দিচ্ছো আমাকে। ভাইয়া যে লাখ লাখ টাকা খরচ করে তখন তো বলো না ?
-তোমার ভাইয়া তো তার পড়াশোনা শেষ করে ফেলেছে প্রায়। আর ছয়টা মাস। তারপর সে চাকরি করবে। সংসারের হাল ধরবে। তখন তুমিও খরচ নিতে পারবে। এখন থেকে হিসেবি হও। মেয়েদের হিসেবি না হলে ঘরে কল্যাণ হয় না। বড় হচ্ছো, বিয়ে সংসার হলে তোমাকেই ঘর সামাল দিতে হবে। এখন যদি না শিখো পরের ঘরে গেলে কীভাবে টিকবে?
এসব কথা মেয়ের সাথে বলছি যখন, তখন তানিশা তার কলেজ থেকে ফিরে গোসল সেরে আমার সাথে দুপুরের খাবার খেতে বসে। খাবার টেবিলেই অনেকদিন পরপর আমি মেয়ের সাথে কথা বলি। মেয়েটা বেশ শান্ত, কখনো মাথা গরম করে না। খুব শান্তভাবে কথা বলবে। আর ছেলেটাও আমাদের খুব ভালো, সেও শান্ত ভদ্র। ধূমপান করবে না, বাইরে অযথা ঘুরবে না। ঘরেও বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা মারবে না। ওর বাবা এসব নিয়ে মাঝে মাঝে কথা বলে ভয়ের সাথে। আমাকে বুঝায়, আজকালকার ছেলেরা অতো শান্ত হলে চলে বলো। হইচই করবে, আড্ডা গান সিনেমায় না থাকলে ঘর কেমন মরা মরা লাগে।
আমি স্বামীর সাথে এই তর্কে কখনো একমত হই না। আমি বলি, আমার ছেলেমেয়েরা হইচই গান আড্ডা নিয়ে থাকুক তা আমি চাই না। এরকম শান্ত থাকাই আমার পছন্দ। ওরা রাতে ঘরে থাকলেই আমার সারাদিনের ক্লান্তি চলে যায়। আমি যখন অনুভব করি আমার দুই ছেলেমেয়ে ঘরে যার যার রুমে আছে, তখনই আমি সুখী হয়ে উঠি।
গতকাল রাতে আরিফ বলছিলো, মা পদ্মা সেতু হয়ে গেলো। আমরা কয়েক বন্ধু মিলে কাল সকালে দেখতে যাবো। বিকেলের আগেই ফিরে আসবো। আমাকে ওরা পলাশীর মোড় থেকে কিপআপ করবে। খুব সকালে বের হবো, তাই তোমাকে জ¦ালাবো না। তুমি তো দেরি করে ওঠো। কোনো টেনশন করো না মা। টাইম্লি চলে আসবো। তারপরও সকালে সানি ঠিকই সকালে আমার রুমের দরোজায় টোকা দিয়ে বলে গিয়েছে।
কিন্তু বিকেল থেকে আমি অস্থির হয়ে আছি। ভেতরে কেমন যেনো চনমন, একটি হাহাকার করা, চৈত্রের খাঁ খাঁ রোদে যেমোন শরীরে হাঁফাঁস লাগে, ঘরের বিদ্যুৎ চলে গেলে যেনো শরীর ঘেমে যায়, আমার শরীর ও মনের অবস্থা তেমনি। আমি সানিকে ফোন দিই। ওর ফোনে রিং হচ্ছে কিন্তু ধরছে না। এমন এক বোকামি আমি করেছি যে ওর সাথী বন্ধুদের কারো নাম্বারও রাখিনি। আমি আরো এক ঘণ্টা পর ফোন দিই তখন সানি ধরে। ও জবাব দেয়, মা আমরা খুব ব্যস্ত। খুব আনন্দ করছি। তোমার কথা খুব শুনতে পারছি না। আমরা একটি নৌকায় চড়েছি মা। সবাই নদীর পানির ¯্রােতে এন্জয় করছি। অনেক অনেক সেল্ফি তুলছি। খুব সুন্দর ছবি সব। দেখবে বাসায় এলে। তুমি আর ফোন দিও না। বাতাসের কারণে শুনতে পাবো না। আমি তীরে ফিরলে তোমাকে ফোন দেবো।
আমি শান্ত হই। আমার ভেতর মনের খোঁপে এসি চালালে যে প্রশান্তি, সেরকম শীতলতা টের পাই। মেয়েটা আমাকে এককাপ কফি করে দেয়। দুজনে মিলে খাই। ওর বাবা তো দোকান থেকে রাত এগারোটার আগে আসে না। মা মেয়ে এটা সেটা করে কাটিয়ে দিই।
কিন্তু আসলে আমি যে মা। মার মন সব সময় ব্যাকুলতায় ছেয়ে থাকে। আমার মনের চারদিকে টেনশনের ঝোঁপঝাড় তৈরি হয়। নদীর শ্যাওলায় আমার পা’কে অনঢ় করে। আমি অস্থিরতায় কুঁকড়ে যাই। মা কী পারে কোনো সন্তান এগারোটার মধ্যে ঘরে না ফিরলে শান্ত থাকতে! ওদের বাবা ফিরে এসেই চোখ বুলায় ঘরে। টের পায় কিছু, নাকি আন্দাজে জানতে চায়, সানি আসেনি? আমি বলি, সন্ধ্যার আগে কথা হয়েছে। ওরা পদ্মা নদীতে নৌকায় ঘুরছে। বলো কী, আজকে তো অনেক বাতাস। নদীতে ¯্রােত থাকবে। পদ্মা তো সর্বনাশা। ওরা বোকামি করলো। দাও দাও ফোন দাও এখনি, নিশ্চয়ই ফিরে আসছে। হয়ত ট্রাফিক জ্যামে পড়েছে কোথাও। তুমি আবার ফোন দাও।
আমি ফোন দিই কোনো শব্দ নেই। রিং টোন নেই। আবার ফোন দেই, কোনো রিং টোন নেই। আবার ফোন দিই কোনো রিং টোন নেই।
অতো যে রাত হলো সানি আসে না। অতো যে রাত যাচ্ছে আমরা কারো ফোনও পাই না। রাত বাড়তে বাড়তে একটা দুটো তিনটা। কারো ঘুম নেই চোখে। সানি ফিরে আসে না। আমার চোখে প্রমত্ত পদ্মার জল থৈ থৈ ¯্রােতধারা, ঢেউয়ের আঘাতে নৌকা ডুবে যাবার শঙ্কা। মানুষের ভিড় কান্না চিৎকার সব মিলিয়ে আমি পাগল প্রায়। কী করবো কোথায় যাবো।
আমার ঘর এলোমেলো। ডাইনিংয়ে সানির জন্য যে খাবার রেখেছি তা খাবার মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। ওর বাবা কাঁঠাল নিয়ে এসেছে, তাতে মাছি বসেছে কটা। তানিশার ঘুম নেই। সেও অস্থির হয়ে এঘরে ওঘরে যাচ্ছে। ওর বাবা তো বিমর্ষ হয়ে সোফায় বসে-ওঠে, বারান্দায় যায়, আরেকবার নিচে নামে। ছেলের জন্য তার অতো মায়া আগে টের পাইনি কখনো। আমি কী করবো। তানিশাকে বলি আমার মাথায় পানি ঢালতে। ও পানি ঢালে আমার মাথায়। একটু পর, তখন রাত প্রায় তিনটা। আমি আবার সানির মোবাইলে ফোন দেই। না কোন শব্দ নেই, রিং টোন নেই। অসার শক্তিহীন শরীর নিয়ে আমি শুয়ে পড়ি সোফায়।
ওর বাবা টিভি অন করে। তার টিভি দেখার অভ্যাস নেই। তবু কী মনে করে যেনো আজ অতো রাতে টিভি অন করে সে। তারপর তার চোখ আরো তির্যক করে ব্রেকিং নিউজের দিকে যায়। সে পড়ে আপডেট নিউজ। সে পড়ে আর চিৎকার দিয়ে বলে, আহ আল্লাহ! আমার ছেলেরে নিয়া গেলেন..?