
গল্প বা উপন্যাস পাঠ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে বিশেষ চরিত্র কর্তৃক আলোড়িত হতে হয় পাঠক সমাজকে।
গহীনের মানসপটে সে চরিত্রগুলো বিচরণ করে বছরের পর বছর। স্মৃতিতত্ত্বের মতো বিস্তৃত হয় সময়াঙ্গনে। আড়াল করা যায় না কিছুতেই।
যারা কাল্পনিক আবহ থেকে বেরিয়ে এসে মানবিক মানুষ পরিচয়ে নিজেকে বিকশিত করে বাস্তব প্রেক্ষাপটে। যাদের অবিস্মরণীয় কৃতকর্ম ঔজ্জ্বল্য ছড়ায় প্রকৃতির পথে প্রান্তে। সেই স্মরণীয় চরিত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘দীপাবলি’ যে সমাজ প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে তাকে জীবনভর যুদ্ধ করে যেতে হয়েছিল, সে সমাজ কখনই নারীবান্ধব ছিল না।
এমন একটি নান্দনিক চরিত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মনোভাব আপনা আপনি জন্ম নেয়াই স্বাভাবিক;
সাতকাহন উপন্যাস পাঠের সময় দিপাবলির প্রেমে বুদ হয়েছিলাম। শিরা, উপশিরা করোটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিহিরণ তুলেছিল সে। যাকে অতিদূর থেকেও ভালবাসা যায় নিশ্চিন্তে। মুগ্ধতার স্পর্শতিলক যেন সে। যদিও বাস্তবে তার সাক্ষাত পাওয়া আদৌ সম্ভব নয়।
এক প্রগতিশীল সংস্কারমুক্ত নারী চরিত্রের নাম দীপাবলি। তিনিই সমরেশ মজুমদার রচিত সাতকাহন উপন্যাসের কালজয়ী চরিত্র। কি করুণ ট্র্যাজেডি থেকে উঠে এসে দীর্ঘকাল ধরে একাকিনী পাখির মতো সংগ্রাম করে যেতে হয়েছিল তাকে!
জন্মের পর প্রকৃত মায়ের মৃত্যুর পর বাবা তাকে ছেড়ে অজানায় উধাও হয়ে যায়। অনেকের ধারনা ছিল তিনি গৃহত্যাগী হয়েছেন। সেই শিশু বয়সে মাসি মা অঞ্জলি এবং খালু অমরনাথ তার দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেন। সেই সংসারে বসবাস করতে গিয়ে স্নেহ মমতার বিন্দুমাত্র ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়নি তার জীবনে। অমরনাথকে বাবা, অমরনাথের মাকে দাদিমা এবং অঞ্জলিকে আপন মা বলে চিনেছিল সে।
এই তিনটি মানুষের নিঃস্বার্থ ভালবাসা তাকে পরিপূর্ণভাবে আগলে রেখেছিল।
মেধাবী শিক্ষার্থী হওয়ায় স্কুলের এক প্রবীণ শিক্ষক সবসময় তাকে সমর্থন দিয়েছিল।বিপদে আপদে প্রেরণার পথ্য সম্ভার ছিলেন তিনি দিপার জীবনে।
পরিবার থেকে সমর্থন পেলেও, মাত্র ১১ বছর বয়সে তাকে জোর করে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে বাধ্য করা হয়েছিল।
কারণ প্রস্তাবটা ছিল লোভনীয়।
বিয়ের সময় দীপাবলি তার আসল পরিচয় জানতে পেরেছিল। জানার পর তার যন্ত্রণার সীমা মহাকাশকে স্পর্শ করেছিল।
দ্বায় মুক্তির খাতিরে এত অল্প বয়সে তাকে বিয়ে দেয়া হয়েছে, এমন চিন্তার রেশ তার মনে যতই ছড়িয়ে যাচ্ছিল, ভেতরটা তার ততই ক্ষত বিক্ষত হয়ে যাচ্ছিল।
কারণ, সে তার স্বপ্ন ভঙ্গের খুব কাছে চলে এসেছিল। দীপাবলি যে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার বাসনা মনের গহীন কোণে লালন করে রেখেছিল! বিয়ের পর বাসর ঘরে গিয়ে জানতে পারে তার স্বামী মারাত্মক অসুস্থ এবং শারীরিক সম্পর্ক করার অনুপযুক্ত। বাসর ঘরে মিলনের আগেই যখন স্বামীর মৃত্যু হয়েছিল তখন সে নিরুপায় মমির মতো স্তব্ধকাতর হয়ে পড়েছিল। সেই রাত ছিল তার জন্য ভীষণ দুর্বিষহ। দীপাবলি রাতের অন্ধকারে পালাতে বাধ্য হয়েছিল। এতটুকু মেয়ে অনেক অনেক দুর্গম পথ অতিক্রম করে নিজ গৃহের পাশে এসে অচেতন হয়ে পড়েছিল। তারপর বাড়িতে তুলে নিয়ে গিয়ে অনেক কষ্টে তার সুস্থ স্বাভাবিক চেতনা ফিড়িয়ে আনা হয়েছিল। পিতা অমরনাথ নিজের ভুল বুঝতে পেরে হু হু করে কেঁদেছিলেন আড়ালে গিয়ে।
মেয়েকে সব ধরনের সমর্থন দেবেন বলে মনে মনে শপথ নিয়েছিলেন।
কুসংস্কারাচ্ছন্ন সেই সমাজে বিয়ের প্রথম রাতেই তাকে বিধবা খেতাবে ভুষিত করা হয়েছিল। অথচ দীপাবলি সেই বয়স থেকে বিদ্রোহ শুরু করল। আমিষ খাবার চাই তার। সাদা শাড়ির অনুশাসন মানতে পারবে না সে! বাবা অবশ্য মেয়ের এমন প্রস্তাবে সমর্থন দিয়েছিলেন।
বাবা সবসময়ই তার পাশে লেপ্টে ছিলেন ছায়াদায়ী বৃক্ষের মতন। কিন্তু দাদীমা মনোরমা মেনে নিতে পারতেন না।
যদিও দীপাবলিকে পিতার পরে সেই দাদিই সবচেয়ে বেশি ভালবাসতেন।
বাবা বেঁচে থাকা অবস্থায় অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে এইচ এসসি পাস অবধি সফলভাবে অতিক্রম করে যায় দীপা।
সেই সমাজে কি নিষ্ঠুর বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাকে! তবুও সকল পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস রেজাল্ট! একটি বিধবা মেয়ে এভাবে তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে এ যেন কেউ মেনে নিতে পারছিল না।
তাই তারা পথে কাঁটা বিছিয়ে দিয়েছিল নিজেদের খেয়াল খুশিমতো।
দীপা ওসবকে গুরুত্ব না দিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল আপন স্বাধীন স্বকীয়তায়।
পিতার মৃত্যুর পর মায়ের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
অথচ তাতে দীপার কোন দোষ ছিল না। দীপা বরঞ্চ তার অভাবগ্রস্ত মাকে টিউশন থেকে প্রাপ্তির কিছু অংশ পাঠিয়ে দিত। মনোরমা মাঝে মাঝে চিঠি লিখতো দীপার হোস্টেলে।
পিতার মৃত্যুর পর তার জীবন যুদ্ধটা আরও কয়েকগুণ কঠিন হয়ে পড়েছিল।
এত নিঃসঙ্গতার আঁধার তাড়িয়ে সে তবুও জীবনের অধিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিল। সরকারী ক্যাডার পদে সিলেক্ট হলে উচ্চপদস্থ সরকারী চাকরিতে তাকে মনোনীত করা হয়েছিল।
তৎকালীন সমাজের নারীদের জন্য যা ছিল অভাবনীয় সাফল্য। শিক্ষায় দীক্ষায় মেধায় মননে আচার রুচিতে দীপাবলি নিজেকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল।