ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

লড়াকু ক্রীড়াবিদ সেবিকা মণ্ডল

সোহেলি সুহি

প্রকাশিত: ০১:২৮, ১ ডিসেম্বর ২০২৩

লড়াকু ক্রীড়াবিদ সেবিকা মণ্ডল

ক্রীড়াবিদ সেবিকা মণ্ডল

মানিকগঞ্জ জেলার স্বাধীনতা পূর্ব এবং পরবর্তীকালে যে কজন মহিলা ক্রীড়াবিদ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন, তাদের একজন সেবিকা মণ্ডল। ১৯৭৭ সালের ৩ ডিসেম্বর মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার বেতিলা-মিতরা ইউনিয়নের বার্থা  গ্রামের এক কৃষক পরিবারে তার জন্ম। বাবা ছিলেন তুখোড় হাডুডু ও কাবাডি খেলোয়াড়।  রক্তের সঙ্গে তাই মিশে ছিল খেলাধুলা। ছিল হৃদয়ের টানও। মা ছিলেন গৃহিণী। বাবা মায়ের তৃতীয় সন্তান সেবিকা মণ্ডল। লেখাপড়ার চেয়ে খেলাধুলার দিকেই তার ঝোঁক ছিল বেশি। গাছে চড়া, নৌকা ও সাইকেল চালানো, দৌড়, গ্রামীণ খেলাধুলা ছিল তার নিত্যদিনের দুরন্তপনার অংশ। সাইকেল চালাতে খুব ভালোবাসতেন। কিন্তু দরিদ্র পিতার সাইকেল কিনে দেওয়ার মতো সামর্থ্য ছিল না।

উপরন্তু গ্রামের একজন দরিদ্র কৃষক যার চারটি মেয়ে তার পক্ষে সংসার চালানোই ছিল দায় সেখানে মেয়েকে খেলাধুলায় উৎসাহ দেওয়াটাও ছিল প্রায় অসম্ভব। তবুও খেলোয়াড় পিতা তার মেয়েকে গ্রামের মানুষের কটুকথা সত্ত্বেও খেলাধুলার প্রতি নিরুৎসাহিত করতেন না। তার মনের মধ্যে জীবনের প্রথম সফলতার স্মৃতি আজও জ্বল জ্বল করে ওঠে। বার্থা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় আন্তঃপ্রাথমিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় তিনটি ইভেন্টে প্রথম হয়ে ইউনিয়ন প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। এরপর পঞ্চম শ্রেণি পাস করে ভর্তি হন মানিকগঞ্জ সুরেন্দ্র কুমার উচ্চ বিদ্যালয়ে।

সেবিকা মণ্ডলের বড় দুই বোন সুরেন্দ্র কুমার উচ্চ বিদ্যালয়ে বিনা বেতনে পড়াশোনা করতেন।  সেবিকা নিজেও ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিনা বেতনে সেখানে পড়াশোনা করেন। তার বাবার পক্ষে চারটি মেয়ের পড়াশোনার খরচ জোগাড় করা কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। বার্থা থেকে কয়েক কিলোমিটার হেঁটে মানিকগঞ্জ শহরে এসে তিনি ক্লাস করতেন। ছোটবেলা থেকেই ছিলেন খুব জেদি। মাঝে মাঝে খাবার কম হলে  ভাঙচুর, রাগারাগি করতেন। এজন্য তার মাও নিজে না খেয়ে তার জন্য বেশি করে খাবার রাখতেন। খুব ছোট ছিলেন বলে হয়তো মায়ের সেই না খেয়ে থাকার কষ্ট বুঝতে পারতেন না।
হাই স্কুল জীবনের গণ্ডি পেরিয়ে ভর্তি হন সরকারি মহিলা কলেজে। সেই সময় নিজের একটি সাইকেল না থাকা সত্ত্বেও রাস্তায় ও মাঠে সাইকেল চালানোর দক্ষতা দেখে জাসদের তৎকালীন সভাপতি ইকবাল হোসেন খান তাকে ডেকে নিয়ে সাইকেলিং টিমের ম্যানেজার রতন খানের সঙ্গে দেখা করার পরামর্শ দেন। তার বড়দিদি তখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছেন। অভাবের সংসারে তখন একটুখানি আলো দেখা দেয়। আর কুমুদিনী নার্সিং ইনস্টিটিউটে মেজ দিদি ভর্তি হন। সেবিকা ম-ল বড় বোনের কাছে একটি সাইকেল আবদার করেন। কিন্তু টাকা না থাকায় নতুন সাইকেল কেনা সম্ভব হয়নি। তাই পুরনো একটি সাইকেল কিনে দেন।

সাইকেল পাওয়ার পর তার উৎসাহ আরও দ্বিগুণ হয়। সাইকেলিং টিমের ম্যানেজার রতন খান তার সাইকেল চালানো দেখে তাকে টিমে সিলেক্ট করেন। বি টি এম সির কোচ আবদুল কুদ্দুস মেঘনা টেক্সটাইলে ৮০০ টাকা বেতনে একটি চাকরির ব্যবস্থা করেন। অভাবের সংসারে ৮০০ টাকা বেতন ভালোই ছিল। কিন্তু এটুকু সুখও কপালের সইলো না। দুই বছর পর মিল বন্ধ হয়ে গেল ১৯৯৭ সালে বিজিএমসিতে সামান্য বেতনে একটি চাকরি হয়। ১৯৯৭ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বিজিএমসিতে খেলোয়াড় হিসেবে তিনি কর্মরত হন। ২০১১ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত কোচের দায়িত্ব পালন করেন।

বিজেএমসিতে ২০১৯ সালে খেলাধুলা বন্ধ হয়ে যায়। চাকরিরত অবস্থায় ২০০২ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের পরের বছরই কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। চাকরি করা অবস্থায় তার যাতায়াতের মাধ্যম ছিল সেই প্রিয় সাইকেলটি। মানিকগঞ্জ থেকে ডেমরা পর্যন্ত যাতায়াত করেন সাইকেলে চড়ে। কিন্তু হঠাৎ একদিন কষ্টের কেনা সাইকেলটি চুরি হয়ে যায়। মানসিকভাবে ভীষণ ভেঙে পড়েন। সে কষ্টের কথা মনে পড়লে আজও তার ভিতরটা ভেঙেচুরে যায়। পরবর্তী সময়ে অবশ্য জনাব এসএ মালিক সাহেবের আর্থিক সহায়তায় নতুন একটি সাইকেল ক্রয় করেন।
সেবিকার শ্বশুরবাড়ি ছিল হরিরামপুর উপজেলার বায়রা গ্রামে। প্রমত্তা পদ্মা নদীর ভাঙনে একসময় বাড়িঘর জমি ভিটা সব বিলীন হয়ে যায়। তবুও জীবন থেমে থাকেনি। তিনি ছোট্ট একটি গরুর খামার করেছেন। স্বামী ব্যবসা করছে। চার সদস্যের পরিবার নিয়ে তিনি বাবার বাড়িতেই থাকছেন। দুই মেয়ের একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স পড়ছে এবং ছোট মেয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ছে। 
ছোট্ট এই জীবনে তার বহু অর্জন রয়েছে। স্কুলজীবনে ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন সাতটি ইভেন্টে। প্রথম হিসেবে পুরস্কার পেয়েছেন পঞ্চাশটির মতো, দ্বিতীয় হিসেবে পুরস্কার পেয়েছেন ২০টি। সাইকেলিংয়ে জাতীয় পর্যায়ে ১৯টি স্বর্ণপদক লাভ করেন। সপ্তম বাংলাদেশ গেমস স্বর্ণপদক  চারটি, দ্বিতীয় সার্ক সাইকেলিং এ,  নয়াদিল্লিতে রৌপ্য পদক ০২টি এবং ০২টি ব্রোঞ্জ পদক অর্জন করেন। এছাড়াও সাঁতার, হ্যান্ডবল, ভলিবলসহ বিভিন্ন খেলায় সাফল্যের সঙ্গে পদক ও মেডেল অর্জন করেন। শুধু খেলাধুলাই সেরা নন, তিনি একজন সমাজসেবকও বটে। গ্রামের দরিদ্র মহিলাদের নিয়ে সবুজ বাংলা মহিলা সমবায় সমিতি নামে একটি সমিতি গঠন করেছেন যার সদস্য ২০০ জন। তারা সবাই নিজ নিজ জায়গায় স্বাবলম্বী।
জীবনে অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও দমে যাননি সেবিকা মণ্ডল। তিনি তার দৃঢ় প্রত্যয় এবং অদম্য আত্মবিশ্বাসে এগিয়ে গেছেন সামনের পথে।

×