ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

উপকূলীয় নারীর জীবন

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ০১:২১, ১৮ নভেম্বর ২০২২

উপকূলীয় নারীর জীবন

উপকূলীয় নারীর জীবন

বাংলাদেশে উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে সমসংখ্যক নারীদের নজরকাড়া অংশীদারিত্ব দৃশ্যমান হতে সময় লাগছে না। শুধু সমৃদ্ধির জোয়ারে যোগসাজশ নয় বরং হরেক বিপন্ন, বিপরীত পরিস্থিতিতেও নারীদের নাজেহাল হওয়ার বিসদৃশ্য প্রায়ই উঠে আসে। বিশেষ করে দুর্যোগ, দুর্ভোগের অসময়ে নারী ও শিশুরা সবচাইতে বেশি ঝুঁকির আবর্তে পড়ে সেটাই যেন চিরাচরিত নিয়মের অধীন।

বাংলাদেশও বিভিন্ন সঙ্কটও আপদকালীন অবস্থা মোকাবিলায় অর্ধাংশ নারীদেরই বিপত্তি ঘটে বেশি। বর্তমানে  জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ দূষণের মতো চরম ক্রান্তিকাল পার  করছে সারা বিশ্ব। বিশ্বের সর্ববৃহৎ ব-দ্বীপ আমাদের এই বাংলাদেশও চলমান দুঃসময়কে মোকাবিলা করতে বিভিন্নভাবে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখছে। নারীরাও তাদের সাধ্যমতো হরেকমাত্রার সম্মুখ সমরকে সামলিয়ে টিকে থাকার লড়াই করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। শুধু তাই নয়, ঘুরে দাঁড়িয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার প্রচেষ্টাও সকলের দৃষ্টি কাড়ছে।

সম্প্রতি ইউএনউইমেন আয়োজিত এক ছবির প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। বাংলা একাডেমির ‘ভাস্কর নভেলা প্রদর্শনী কক্ষে’ অনুষ্ঠিত তিন দিনব্যাপী যে ছবির প্রদর্শনী শুরু হয় তাতে উঠে এসেছে উপকূলীয় প্রান্তিক নারীদের জীবন যুদ্ধের অভাবনীয় চিত্রকল্প। ছবিতে দৃশ্যমান হয় কি মাত্রায় সমুদ্র ও নদী পরিবেষ্টিত বাংলাদেশে বঙ্গ ললনাদের সংগ্রামের ইতিবৃত্ত। সঙ্গে শোভা বর্ধন করছে টিকে থাকা এবং নিজেদের সফল কর্মযোগে এগিয়ে যাওয়ার অনন্য সম্ভার। আমরা জানি নৈসর্গের লীলা নিকেতন বাংলাদেশ প্রকৃতির বিরূপ প্রতিবেশে তার কোলের সন্তানদের প্রতিনিয়ত বিড়ম্বনার শিকার করে।
সেখানে গত শতাব্দী থেকে নতুন করে আলোড়ন তৈরি করছে প্রাকৃতিক দূষণ। শিল্প সহায়ক প্রযুক্তি বিশ্বকে এগিয়ে নিয়েছে বারবার। কিন্তু তার বিপরীত প্রভাবে শান্ত, স্নিগ্ধ নিসর্গ তার সহজাত বৈশিষ্ট্য থেকে চ্যুত হয়ে কোলের সন্তানদের দিশেহারা করে তুলছে। সেখানে নারী ও শিশুরাই সবচাইতে বেশি বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়, আর উপকূলীয় নারী ও শিশুরা থাকে চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়।

সেখান থেকে প্রতিকূল পরিবেশকে সামাল দিয়ে কিভাবে নারীরা তাদের জীবনকে নতুন মাত্রায় এগিয়ে নিচ্ছে ছবির ক্যানভাসে তাই পুরো প্রদর্শনী জুড়ে দর্শনার্থীর দৃষ্টি আকর্ষণে জোরালো ভূমিকা রাখে। উপকূলীয় এলাকায় নারীদের নিত্য সংগ্রামের কাহিনীই শুধু নয় নিজেদের সফলভাবে টিকিয়ে রাখা ছাড়াও কর্মক্ষেত্রে সফলতা নিয়ে আসার গল্পই চিত্রিত হয়েছে  অঙ্কন শিল্পীদের নান্দনিক ছোঁয়ায়। এ শুধু শিল্পকর্ম কিংবা নন্দনতত্ত্বই নয় বরং বিপরীত আবহে মোকাবিলা করে অপার সম্ভাবনায় স্বাবলম্বী হওয়ার কাহিনীও দর্শকদের অভিভূত করছে।

এই ব্যাপক আয়োজনে উন্মোচন করা হয় ‘ফ্রম হোয়্যার আই স্ট্যান্ড’ বইটির মোড়ক। যেখানে দুর্যোগের শিকার হয়ে সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর  জোরালো প্রত্যয়ে নারীদের অসম সাহসিকতাকেই বিশদভাবে উপস্থাপন করা হয়। উপকূলীয় প্রান্তিক নারীদের অসহায়ত্ব এবং সম্মুখ বিড়ম্বনাকে ভয়ের পরিবর্তে জয়ের অগ্রযাত্রায় যে বলিষ্ঠ পদচারণা তারই সুসংবদ্ধ কাহিনী সম্ভার এই অসাধারণ গ্রন্থটি। বিভিন্ন  প্রাকৃতিক সংহার সমাজ কখনো স্থিতিশীল অবস্থায় বিরাজ করে না।

ধ্বংসযজ্ঞ, প্রাণহানি, পানির ঢলে সংশ্লিষ্ট অঞ্চল তলিয়ে যাওয়া সবই যেন রুদ্র প্রকৃতির বিমাতাসূলভ আচরণ। সেখানে মানুষের সঙ্গে সৌহার্দ্যরে পরিবর্তে বৈষম্যের যে চিত্র উন্মোচিত হয় সেটাও স্বস্তিদায়ক নয়। নিজেকে লড়াই করে টিকে থাকতে অন্য কারোর দিকে নজর দেওয়ার সময়ের অভাব থেকেই যায়। তাই শুধু বৈষম্য নয় ফারাকও তৈরি হয় সংশ্লিষ্ট অধিবাসীদের সঙ্গে। নিঃস্ব, হতাশাগ্রস্ত এবং সুবিধাবঞ্চিত অংশ যেখানে সিংহভাগই শিশু ও নারী তাদের বিপর্যয় সামাল দেওয়া পরিস্থিতির দাবি হয়ে যায়।

বিপদাপন্ন সময়ে দারিদ্র্যের হার বেড়ে যাওয়াও এক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া, সেখানে তৃণমূল পর্যায়ের নারীদের জন্য কাজ করে যাচ্ছে ইউএন উইমেন। গত ৫ বছর ধরে তাদের এই মহৎ ও ব্যাপক কার্যক্রমে প্রান্তিক নারীরা সাহায্য সহযোগিতা পেয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। আর এমন নজরকাড়া প্রকল্পের সহায়তায় তৃণমূল নারীদের সাফল্য উঠে এসেছে গুরুত্বপূর্ণ এই বইটিতে। ঝুঁকিপূর্ণ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মপ্রকল্পের আওতায় উপকূলীয় সুবিধাবঞ্চিত নারীরা নিত্যনতুন কর্মযোগের অংশীদার হয়ে সফলতার গল্পও নজরকাড়া।

নদীবিধৌত বাংলাদেশের উপকূলীয় জনগোষ্ঠীকে প্রতিনিয়তই প্রকৃতির বিরূপ চেহারার সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয়। আবার বিশ্বব্যাপী তোলপাড় করা দূষণ প্রক্রিয়াকেও সামাল দিতে হচ্ছে। সেখান থেকে নারীরা বিভিন্ন মাত্রার কর্মযোগে ভূমিকা রেখে শুধু পরিবেশকেই উপযোগী করছে না বরং নিজেদের প্রতিষ্ঠা অর্জনেও রীতিমতো সংগ্রামী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে জয়ী হওয়ার নজরকাড়া দৃষ্টান্তও স্থাপন করে যাচ্ছে। যা সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বেগবান করছে। অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া নারীরা নতুন করে বাঁচার পথ তৈরি করছে যা সম্ভাবনাময় আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার অনন্য বার্তা তো বটেই।

×