ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৬ মে ২০২৫, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ড. আকতার বানু আলপনা

নারীর আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির কৌশল?

প্রকাশিত: ১৩:১৫, ২৫ অক্টোবর ২০১৯

নারীর আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির কৌশল?

আত্মবিশ্বাস যে কোন মানুষের সফলতার চাবিকাঠি। সব আত্মবিশ্বাসী মানুষরা সফল। তাঁরা সবার শ্রদ্ধা ও ঈর্ষার পাত্র। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আরও দুটো শব্দ জড়িত। আত্মধারণা ও আত্মশ্রদ্ধা, যা আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করে। আত্মধারণা (ঝবষভ পড়হপবঢ়ঃ) বলতে বোঝায়, নিজের সম্পর্কে ধারণা বা নিজের দোষ ও গুণ সম্পর্কে জ্ঞান। আত্মশ্রদ্ধা (ঝবষভ বংঃববস) হলো নিজের গুণ, যোগ্যতা, ব্যক্তিত্ব ইত্যাদির জন্য নিজেই নিজেকে শ্রদ্ধা করা। আর আত্মবিশ্বাস (ঝবষভ পড়হভরফবহপব) হলো নিজের যোগ্যতা, ক্ষমতা, সামর্থ ইত্যাদির উপর পরিপূর্ণ আস্থা যা ব্যবহার করে মানুষ সফলতার শিখরে পৌঁছে যায়। প্রতিটা মানুষের উচিত, এই তিনটি বিষয় সম্পর্কে সর্বদা সজাগ থেকে নিজের মধ্যে এগুলোর প্রতিফলন ঘটানো। বিশেষ করে নারীদের। তাহলে আপনি যে বয়সের, যে অবস্থার মধ্যেই থাকুন না কেন, আপনার জীবন সফল ও সুন্দর হতে বাধ্য। ছাত্র থেকে শুরু করে বেকার গৃহিণী পর্যন্ত সবার উচিত আত্মবিশ্বাস বাড়ানো। আত্মবিশ্বাস এমন একটা জিনিস, যেটা ছাড়া মানুষ মাথা উঁচু করে বাঁচতে পাওে না। আমরা জানি, আমাদের সবার আত্মবিশ্বাস সমান নয়। অনেকেরই নিজের প্রতি আস্থা নেই। ফলে তারা নিজেদের দুর্বল ভাবেন, হীনম্মন্যতায় ভোগেন, হতাশায় ভোগেন, কোন উদ্যোগ নিতে ভয় পান, সব সময় নিজেকে গুটিয়ে রাখেন। নিজের স্বাধীন মত প্রকাশ করেন না, সব সময় অন্যের অনুগত থাকেন, সমালোচনার ভয়ে নিজের যোগ্যতাকে পরখ করেন না। যাদের আত্মবিশ্বাস কম, সেসব শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায়, বিশেষ করে মৌখিক পরীক্ষায় খারাপ করে। এসব মানুষরা অল্পতেই নার্ভাস হয়। অথচ অল্প কিছু প্রচেষ্টা আপনার মানসিকতার আমূল পরিবর্তন করে আপনাকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে পারে। যথা : ১। প্রথমেই মনে রাখুন, আপনি কারও চেয়ে কম নন। সবার মতো আপনারও এমন কিছু গুণ বা যোগ্যতা আছে যা অন্যদের নেই। (এখানে উল্লেখ্য, মানুষের নিজের সম্পর্কে ধারণা (ঝবষভ পড়হপবঢ়ঃ) গড়ে ওঠে তার চার পাশের মানুষরা তাকে কিভাবে মূল্যায়ন করে, তার ওপর। ছোটবেলা থেকে আপনাকে আপনার চার পাশের মানুষরা (পরিবার, আত্মীয়, প্রতিবেশী, শিক্ষক, সহপাঠী, বন্ধু ইত্যাদি) কিভাবে মূল্যায়ন করে, তার ওপর ভিত্তি করে আপনি নিজেকে মূল্যায়ন করেন। আপনার চারপাশের মানুষরা আপনার সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য করলে (তুমি খুব ভাল ছেলে/মেয়ে, তুমি পড়াশোনায় ভাল, তুমি দুষ্টমি কর না, তুমি পরোপকারী ইত্যাদি) আপনার আত্মধারণাও ইতিবাচক হয়। ফলে আত্মশ্রদ্ধা ও আত্মবিশ্বাস বাড়ে। অন্যদিকে আপনার চার পাশের মানুষরা আপনার সম্পর্কে অধিকাংশ সময় শুধু নেতিবাচক মন্তব্য করলে (তুমি দুষ্টু ছেলে/মেয়ে, তুমি পড়াশোনায় ভাল না, তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না, তুমি কিছুই পার না ইত্যাদি) আপনার আত্মধারণাও নেতিবাচক হয়। ফলে আত্মশ্রদ্ধা ও আত্মবিশ্বাস কমে যায়। তাই ছোটবেলা থেকে সব সময় শিশুদের দোষ না ধরে তার ভাল গুণগুলোর প্রশংসা করুন।) ২। নিজের যে কোন ক্ষমতাকে কাজে লাগান। আপনি যে কাজ সবচেয়ে ভাল পারেন, সেটাকেই নিষ্ঠার সঙ্গে করে নিজের যোগ্যতার পরিচয় দিন। পড়াশোনা, অফিস বা বাড়ির কাজ, লেখালেখি, গান, নাচ, ছবি আঁকা, অভিনয়, সেলাই, রান্না, এমন কি ঘর গোছানো দিয়েও আপনি যে কাউকে মুগ্ধ করতে পারেন, নিজেকে অন্যদের কাছে আদর্শ হিসেবে তুলে ধরতে পারেন। (আমার বাসায় প্রথমবার আমার সহকর্মীদের সবাইকে দাওয়াত করেছিলাম। সেদিন ওরা আমার বাড়ি দেখে মুগ্ধ হয়েছে। কোথাও এতটুকু ময়লা নেই। গোটা বাড়ি সাজানো-গোছানো, ঝকঝকে-তকতকে। প্রতিটা জিনিস রুচিসম্মত। এমনভাবে রাখা, যেন ওই জায়গাটি ওই জিনিসটির জন্য সবচেয়ে যথার্থ। লম্বা বারান্দার এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত ইনডোর প্লান্ট দিয়ে সাজানো। শিকায় ঝোলানো বাহারি গাছ। বারান্দায় দোলনা আর ইজিচেয়ার। গাছ দেখতে দেখতে ইজিচেয়ারে বা দোলনায় বসে চা খাবেন। মন ভাল হয়ে যাবে। দোলনার পাশে তোষকের ওপরে আমার মেয়ের হারমোনিয়াম, তবলা। মেয়ে যখন গান করে, আমি পাশে বসে শুনি। বেসিনের পাশে, কিচেনে, টয়লেটের ওয়াল শেলফেও নানা রকম গাছ। সাদা ধবধবে কুরুশ কাঁটার টেবিলক্লথের উপরে রাখা সুন্দর সুন্দর শোপিস। সব ঘরের দেয়ালে আমার হাতের কাজের ওয়ালম্যাট, বড় মেয়ের আঁকা পেইন্টিং। সবাই অবাক হয়েছে। অফিস-বাড়ি সামলিয়ে এত ব্যস্ততার মাঝেও আমি এতকিছু করি কী করে!) ৩। আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করুন। আপনার সাধ্যমতো কোন কাজ করে আয় করুন। সঞ্চয় করুন। ছাত্র জীবন থেকেই কিছু ভবিষ্যত কর্মপন্থা স্থির করে রাখুন। ৪। বিপদে স্থির থাকুন। ভয় পাবেন না। অন্যদের সাহস দিন। বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে শিখুন। এটা ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে। ৫। নিজের শরীরের যতœ নিন। ফিট থাকুন। ৬। নিজেকে কারও কাছে সস্তা বা তুচ্ছ করে তুলবেন না। সব সময় আত্মসম্মান বজায় রেখে চলুন। ৭। মন খারাপ হলে মন ভাল করার এবং হতাশা কাটানোর উপায় স্থির করে রাখুন। (আমি কোন কারণে হতাশ হলে গান শুনি, কবিতা পড়ি, বই পড়ি। বেড়াতে বা শপিংয়ে যাই। প্রিয় কারও সঙ্গে কথা বলি। আপনারাও আপনাদের পছন্দের কোন কাজ ঠিক করে ০রাখুন। যেমন- প্রিয়জনদের সঙ্গে সময় কাটানো, আত্মীয়দের সঙ্গে মিলিত হওয়া, নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে মিশতে চেষ্টা করা, মুভি দেখা, গান শোনা ইত্যাদি।) ৮। কোন কাজে বিফল হলে বিফলতার কারণ খুঁজে বের করে তা কাটিয়ে ওঠার উপায় স্থির করুন। কঠোর পরিশ্রম করার মানসিকতা তৈরি করুন। প্রচুর পরিশ্রম করে সফল হোন। মনে রাখবেন, বিনাশ্রমে কিছু পাওয়া সম্ভব নয়। সব সফল মানুষের সফলতার পেছনেই রয়েছে তাদের দীর্ঘ ও কঠোর পরিশ্রম। ৯। যে কোন পরিস্থিতিতে খুব সহজে মানিয়ে চলার যোগ্যতা তৈরি করুন। অভিযোগ করা ছেড়ে দিন। নিজের সমস্যা নিজেই সমাধান করার অভ্যাস গড়ে তুলুন। কারও ওপর নির্ভরশীল হবেন না। ১০। কারও সাহায্য ছাড়াই সব সময় চলার চেষ্টা করুন, স্বাবলম্বী হোন। ১১। কারও আচরণে খুব বেশি কষ্ট পাবেন না। সবার মন, পরিবেশ, আবেগ, ভাবনা, মূল্যবোধ ইত্যাদি এক রকম নয়। তাই ধরেই নেবেন, সবাই এক রকম হবে না। সবাই আপনার সঙ্গে একই রকম আচরণ করবে না। ১২। আত্মশ্রদ্ধা বাড়ান। কিছু কাজ করলে আত্মশ্রদ্ধা বাড়ে। যেমন- প্রচুর জ্ঞান অর্জন করা, বিপদগ্রস্তদের সাহায্য করা, সৎ থাকা, সব সময় অন্যায়ের প্রতিবাদ করা, কারও ক্ষতি হয়, এমন কিছু না করা ইত্যাদি। ১৩। কারও সঙ্গেই অযথা কলহে জড়াবেন না। আনন্দে থাকুন। কখনই নিরাশ হবেন না। সব সময় ইতিবাচক ভাবুন। উপকারীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন। ভুল করলে নির্দ্বিধায় ‘সরি’ বলুন। ভুলের পুনরাবৃত্তি করবেন না। ১৪। প্রতিটা মানুষের আত্মবিশ্বাস কম হবার একটি বড় কারণ হলো, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্ধারিত কাজগুলো সমাধা করতে না পারা। এটি মানসিক চাপেরও কারণ। এ জন্য রুটিন মেনে চলুন। কোন কাজ ফেলে রাখবেন না। ১৫। অন্যরা আপনার সম্পর্কে কি ভাবে, কি বলে, তা নিয়ে একদম মাথা ঘামাবেন না। আপনি নিজে জানেন, আপনি কি, আপনি কেমন। তাই কে কি ভাবল বা বলল, তাতে কিছু যায় আসে না। ১৬। আপনার চারপাশে কি ঘটছে, সেসব সম্পর্কে সজাগ থাকুন। মনোযোগ দিয়ে অন্যদের কথা, বক্তব্য শুনুন। অন্যদের মানসিকতা বুঝে আচরণ করার ক্ষমতা বাড়ান। ১৭। নেতিবাচক লোক থেকে দূরে থাকুন। মনে রাখবেন, যে আপনাকে কষ্ট দেয় বা আপনাকে ছেড়ে যায়, সে আপনাকে ভালবাসে না। সুতরাং তার জন্য আর যাই থাক, আপনার ভালবাসা থাকা উচিত নয়। খুব খুব ভাল থাকবেন। আর আপনার আশপাশের মানুষদেরও ভাল রাখার চেষ্টা করবেন।
×