
আজকাল অনেকেই জামদানি শাড়িকে ‘ঢাকাই জামদানি’ বলে অভিহিত করেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো- এটা কি আদৌ সঠিক? ‘ঢাকাই’ শব্দটি ব্যবহার করে আমরা কি নিজেদের ঐতিহ্যকেই এক অদ্ভুত কূটনৈতিক জটিলতায় জড়িয়ে ফেলছি না?
প্রথমেই বলা দরকার, জামদানি ঐতিহাসিকভাবে একটি সুতির কাপড়। ১৯ শতকের শুরুতে নবাব খাজা সলিমুল্লাহ জামদানি নিয়ে গবেষণার সময় এতে সিল্কের তানা ব্যবহার করেন এবং সেখান থেকেই ‘হাফসিল্ক জামদানি’র প্রচলন শুরু হয়। এই হাফসিল্ক জামদানিগুলো দেখতে চকচকে এবং তুলনামূলকভাবে হালকা, তাই বর্তমানে এগুলোর চাহিদা বেশি। তবে কটন জামদানি অনেক বেশি টেকসই ও দীর্ঘস্থায়ী।
মূলত ঢাকায় তৈরি যে কোনো শাড়িকেই ‘ঢাকাই’ বলা হতো। রবীন্দ্রনাথের গানে, প্রাচীন সাহিত্যে, ‘ঢাকাই শাড়ি’র উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু ২০০০ সালের পর থেকে ‘ঢাকাই জামদানি’ নামটি হঠাৎ করে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। সিনেমা, নাটক, ফ্যাশন ডিজাইন ও ব্যবসায়িক প্রচারণায় এ নামটি এতটা ছড়ায়, যেন এটিই জামদানির প্রকৃত নাম। অথচ ‘ঢাকাই জামদানি’ বলে আলাদা করে কোনো প্রথাগত ধারা নেই।
এদিকে অনেক আগেই ভারতে জামদানির আদলে শাড়ি তৈরি শুরু হয়েছিল। অন্ধ্রপ্রদেশের ‘উপাধ্যা জামদানি’ আসলে জ্যাকার্ড মেশিনে বোনা একটি কাপড়। এর নকশা, বুনন কৌশল এবং গঠন- কোনোটিই আমাদের পিটলুমে তৈরি জামদানির সঙ্গে মিলে না। তবুও ২০০৯ সালে ‘উপাধ্যা জামদানি’ জিআই স্বীকৃতি পায় এবং তখন থেকেই ভারতের পক্ষ থেকে ‘ঢাকাই জামদানি’ নামটি বিশ্বমঞ্চে প্রতিষ্ঠার জন্য এক সুসংগঠিত প্রচারণা শুরু হয়। এটি ছিল একটি সুপরিকল্পিত বয়ন-কূটনৈতিক চাল।
ভারতের প্রচেষ্টার মূল উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের উৎপাদিত উপাধ্যা শাড়িকে ‘জামদানি’ পরিচয়ে পরিচিত করা, যাতে তারা আন্তর্জাতিক বাজারে এই ঐতিহ্যবাহী নামটি ব্যবহার করতে পারে। অথচ উপাধ্যায় কোনোদিন জামদানি তৈরি হতো না, সেখানকার তাঁতিরা প্লেইন শাড়ি বুনতেন। বাংলাদেশ থেকে তাঁতিদের প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা কিছুটা জামদানির আদল বুনলেও, তা কখনোই মূল জামদানি ছিল না। আজ টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, পাবনার কিছু কারখানায় জ্যাকার্ড বা মেশিনে জামদানি নকশার অনুকরণে শাড়ি তৈরি হয়, যেগুলো অনেক সময় ‘হাফসিল্ক জামদানি’ নামে বিক্রি করা হয়। একইভাবে, ভারতে পলিয়েস্টার বা নাইলনের তৈরি শাড়িও ‘হাফসিল্ক জামদানি’ নামে প্রচারিত হচ্ছে। এতে ক্রেতারা বিভ্রান্ত হন এবং আসল জামদানি সম্পর্কে ভুল ধারণা তৈরি হয়।
জামদানি একসময় মসলিনের উত্তরসূরি হিসেবে বিবেচিত ছিল। মসলিন বোনা হতো ‘ফুটি কার্পাস’ তুলা দিয়ে, যা একমাত্র অবিভক্ত বাংলার পূর্বাঞ্চলে (বর্তমান বাংলাদেশে) চাষ হতো। ফুটি কার্পাসের তুলা থেকে তৈরি হতো সূক্ষ্ম সুতা, যার কাউন্ট হতো ৭০০ থেকে শুরু করে ১২০০ পর্যন্ত। এই সুতার বুননশৈলীই পরবর্তীতে মোটা সুতায় রূপান্তর হয়ে জামদানির রূপ নেয়।
জামদানি সুতার ধরন বুঝে ২ রকম- ১. কটন জামদানি, ২. হাফসিল্ক জামদানি। সুতি সুতা দিয়ে তৈরি শাড়ি কটন জামদানি। লম্বালম্বি বা আড়াআড়ি সুতা কটন হলে সুতি বা কটন জামদানি। রেশম সিল্ক আর কটন সুতা দিয়ে হয় হাফসিল্ক। লম্বা সুতা রেশম সিল্ক আর আড়াআড়ি সুতা সুতি/কটন হলে সেটা হাফসিল্ক। আর লম্বালম্বি ও আড়াআড়ি সুতা যদি সিল্কের হয় সেটা ফুল সিল্ক। এটা রেয়ার, তাই অর্ডার দিয়ে করতে হয়। দাম ৪০,০০০ এর উপরে।
বর্তমানে বাজারে সর্বোচ্চ ১০০-১২০ কাউন্টের জামদানি পাওয়া যায়। ২০২০ সালে বাংলাদেশে পুনরায় ফুটি কার্পাস চাষ ও গবেষণার মাধ্যমে ৬০০ কাউন্টের উপরে মসলিন উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। তাই কাউকে ‘মসলিন জামদানি’ বলার আগে সঠিক কাউন্ট সম্পর্কে জ্ঞান থাকা জরুরি। ২০০ বা ২৫০ কাউন্টের শাড়িকে ‘মসলিন জামদানি’ বলা অনুচিত এবং বিভ্রান্তিকর। বাংলাদেশ ২০১৬ সালে জামদানি ও ২০১৮ সালে মসলিন বাংলাদেশের জিআই স্বীকৃতি পায়। মসলিনের মূল উপাদান ফুটি কার্পাস বীজ, তুলা ও গাছ কে জিআই স্বীকৃতি দেয়া হয় ২০২৫ সালে এসে।
আমরা নিজের ঐতিহ্যকে যথাযথভাবে জানি না বলেই বারবার বিভ্রান্তি তৈরি হয়। ‘ঢাকাই জামদানি’ বলার মধ্য দিয়ে আমরা নিজের অজান্তেই অন্যের অপপ্রচারে শক্তি জুগিয়ে দিচ্ছি। জামদানি শুধুই জামদানি- এটি বাংলার, এটি আমাদের। এতে ঢাকাই, টাঙ্গাইল, বা অন্য কোনো আঞ্চলিক বিশেষণ লাগানোর প্রয়োজন নেই। আমরা যদি নিজের দেশের ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন না হই, তবে কেউ এসে আমাদের ঐতিহ্যকে সম্মান করবে না, বরং তা নিজেদের নামে নিয়ে যাবে।
ছবি: বিবির সিন্দুক
প্যানেল