ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১০ মে ২০২৫, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২

মধুময় মৌসুমে ফলের সমাহার

প্রকাশিত: ১৯:২১, ৯ মে ২০২৫

মধুময় মৌসুমে ফলের সমাহার

বিক্রির জন্য বাজারে আনা হচ্ছে লিচু

অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলে দেশি ফলের বেশি উৎপাদন হয়েছে। প্রতিটি উপজেলার হাট-বাজারে এখন দেশী ফলের সমাহার। বিভিন্ন এলাকার বাগান ঘুরে দেখা গেছে, আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, জামরুলের পাশাপাশি হারিয়ে যাওয়া অনেক দেশী ফল গাছে থোকায় থোকায় ঝুলে রয়েছে।
প্রবীণদের মতে, ফলের মৌসুম গ্রীষ্মকাল। এ সময় আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, জামরুলসহ নানান জাতের দেশীয় ফল পাওয়া যায়। এরমধ্যে একটি ফলের নাম গোলাপজাম। গাঢ় সবুজ রঙের ছোট আঁকারের জামটিতে গোলাপজলের ন্যায় ঘ্রাণ বলেই এ জামের নাম হয়েছে গোলাপজাম। প্রথমে ফলের রং সবুজ থাকে। পরে হাল্কা সাদা বর্ণ হয়। আগের দিনে বনে জঙ্গলে জন্মানো গোলাপজাম গাছে থোকা থোকা ফল ঝুলে থাকতো। শিশু-কিশোররা গাছ থেকে গোলাপজাম সংগ্রহ করে সুমিষ্ট এ ফল মজা করে খেত। নির্বিচারে বন জঙ্গলের গাছ কর্তন করায় এখন আর আগের মতো এ ফল পাওয়া যায় না। গত কয়েক বছর পূর্বে বরিশাল জেলার দুইবারের শ্রেষ্ঠ ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত গৌরনদী উপজেলার মাহিলাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সৈকত গুহ পিকলুর নিজস্ব উদ্যোগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া বিভিন্ন প্রকারের কয়েক হাজার ফলের গাছ যেমন, গোলাপজাম, কাউ, ডেউয়া ইত্যাদি সংগ্রহ করে বিভিন্ন সড়কের পাশে ও হাট-বাজারের পরিত্যক্ত স্থানে রোপণ করা হয়। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানেই এবার বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া গোলাপজাম গাছে ফল ধরেছে। এছাড়াও হাট-বাজারে দেখা গেছে, সাদা, লাল ও সবুজ রঙের জামরুল। পাশাপাশি রয়েছে কাউ, ডেউয়া ও খেজুরের মতো চিরচেনা সব ফল।
চন্দ্রদ্বীপ সাহিত্য সমাজের সম্পাদক কবি ও সাহিত্যিক শিকদার রেজাউল করীম বলেন, পহেলা জ্যৈষ্ঠ থেকে শুরু হবে মধু মাস। এ মাসে বাংলাদেশে পাওয়া যায় হরেক রকম ফল। ফল মানুষের শরীরে ভিটামিনের চাহিদা পূরণ করে। মন ও প্রাণকে চাঙ্গা রাখে। রোগ প্রতিরোধ করে। ফলে রয়েছে অন্যান্য খাদ্যপ্রাণ। এসব মৌসুমী ফলে এক শ্রেণির মানুষরূপী পশু ফরমালিন মিশিয়ে ফলকে মরণ খাদ্যে পরিণত করছে। তাদের থেকে সবাইকে সাবধান থাকতে হবে।
বরিশালের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেন, কাঁঠাল আমাদের জাতীয় ফল। বর্তমানে বাজারে ছোট-বড় নানা ধরনের কাঁঠাল বিকিকিনি হতে দেখা যায়। কাঁঠাল এমন একটি ফল যা কাঁচা-পাকা দুটি অবস্থাতেই খাওয়া যায়। কাঁচা কাঁঠালকে এচোর বলা হয়। এতে তরকারি বা সবজি হয়। পাকা কাঁঠালের সবই খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হয়। কাঁঠালের বিচি সকলের প্রিয় খাবার। এর ছাল বা চোচা পশুর প্রিয় খাদ্য। তিনি আরও বলেন, আমেরও বহুবিধ ব্যবহার হয়ে থাকে। কাঁচা আমের আচার, জ্যাম, জেলি, হয়। পাকা আমের জ্যাম, জেলি, আমসত্ত্ব, জুস হয়। আবালবৃদ্ধবণিতা সকলের প্রিয় ফল আম। এছাড়া মৌসুমি ফল লিচুও সকলের প্রিয় ফল। তবে শিশু-কিশোররা লিচু বেশি পছন্দ করে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বিশেষ করে গ্রামগঞ্জের পরিত্যক্ত স্থানগুলোতে বেশি করে দেশী ফলের চারা রোপণের জন্য তিনি (জেলা প্রশাসক) সকলের প্রতি অনুরোধ করেন। জেলা প্রশাসক আরও বলেন, যারা মৌসুমি ফলে ফরমালিন নামের বিষ মিশিয়ে বাজারে বিক্রি করে তাদের ধরতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
বরিশাল কৃষি অঞ্চলের বিভাগীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েক বছর ধরে দেশী ফলের চারা বেশি পরিমাণে রোপণ করায় চলতি মৌসুমে এ অঞ্চলের সর্বত্র দেশী ফল বেশি পাওয়া যাচ্ছে। এরমধ্যে মাহিলাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের নিজস্ব উদ্যোগে বিভিন্ন প্রজাতির কয়েক হাজার দেশী ফলের গাছ রোপণের পর অন্যান্য এলাকায়ও দেশী ফলের চারা রোপণের ধুম পড়েছে। যে কারণে এখন বরিশালে দেশী ফলগাছের বাগান বেশি সৃজন হয়েছে। চলতি মৌসুমে প্রতিটি গাছে ফলও ধরেছে। ইতোমধ্যে স্থানীয় বাজারে প্রচুর পরিমাণে দেশী ফলের সমাহার দেখা যাচ্ছে। বাজারে দেশী ফলের দামও রয়েছে অনেকটা সহনীয়। সূত্রটি আরও জানিয়েছে, আগামীতে দেশী ফলের গাছের চারা মানুষ আরও বেশি পরিমাণে রোপণ করবেন।

লিচুর যত গুণাগুণ

রসে টইটম্বুর গ্রীষ্মের ফল লিচু। ফলটি যেমন খেতে সুস্বাদু, তেমনি পুষ্টিগুণেও এর জুড়ি মেলা ভার। ১০০ গ্রাম লিচুতে রয়েছে ৬৬ ক্যালোরি, ১৬.৫ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ১৫.২ প্রাম চিনি, ৭১.৫ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি ও ১.৩ গ্রাম ডায়াটারি ফাইবার। এছাড়া কপার, পটাশিয়াম ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের উৎস লিচু। লিচুতে পানির পরিমাণ অনেক বেশি। ফলে গ্রীষ্মের গরমে আপনাকে হাইড্রেট রাখতে পারে এই ফল। একটি লিচুতে ১.৫-১.৭ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট থাকে। বেশিরভাগ কার্বোহাইড্রেট শর্করা থেকে আসে। ফলে অতিরিক্ত লিচু খেলে কিছু স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে। বিশেষ করে ডায়াবেটিস রোগীরা অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী লিচু খাবেন। হার্টের জন্য খুবই উপকারী লিচু। এতে রয়েছে অলিগোনল, যা নাইট্রিক অক্সাইড তৈরি করতে সাহায্য করে। এই নাইট্রিক অক্সাইড আবার রক্ত চলাচলে সাহায্য করে। এতে ফ্ল্যাভোনয়েড রয়েছে যা ভাসকুলার ফাংশন উন্নত করে এবং হৃদরোগ প্রতিরোধ করে। প্রচুর পরিমাণে পানি এবং পটাসিয়াম পাওয়া যায় লিচু থেকে। কিডনিতে জমা হওয়া টক্সিন বের করে দিতে সাহায্য করে এগুলো। লিচু ইউরিক অ্যাসিডের ঘনত্বও কমায়, যা কিডনির ক্ষতির ঝুঁকি হ্রাস করে। লিচুতে থাকা প্রচুর পরিমাণে অ্যাসকোরবিক অ্যাসিড ও ভিটামিন সি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।

আমের ১০ উপকারিতা

আম এ দেশের একটি জনপ্রিয় মৌসুমি ফল। এটি আমাদের দেশীয় ফল। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি উপাদান। আম কাঁচা অবস্থায় আচার, চাটনি, জুস ইত্যাদি তৈরি করে খাওয়া যায়। পাকা আম এমনি খেতেই সুস্বাদু। তবে এটি দিয়েও তৈরি করা যায় আমসত্ত্ব, জুস, পুডিং, কেক, কাস্টার্ডসহ মজার মজার খাবার। আমে রয়েছে ভিটামিন এ.সি.ই, পটাশিয়াম, ভিটামিন বি, কপার, ফলেট, ফাইবার ও প্রোটিন। পুষ্টিবিদরা বলেছেন, কাঁচা বা পাকা দুই ধরনের আমই শরীরের জন্য ভালো। আমের রসে পটাশিয়াম থাকায় প্রচন্ড গরমে তা শরীর ঠান্ডা রাখতে সহায়তা করে।


আমে ভিটামিন এ, সি এবং ই-এর ভালো উৎস থাকায় ত্বক ও চুল ভালো রাখতে সাহায্য করে। আমে থাকা ভিটামিন-এ দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখে। চোখের চারপাশের শুষ্কভাবও দূর করে। আয়রন ও সোডিয়ামের ঘাটতি পূরণে বেশ কার্যকরী আম। দেহে নতুন রক্ত তৈরি করতে সাহায্য করে আম। রক্তে ক্ষতিকারক কোলেস্টেলের মাত্রা কমায় আম। ডায়াবেটিসের সঙ্গে লড়াই করার পাশাপাশি আম ক্যান্সার কোষকে মেরে ফেলতে সাহায্য করে।
আমে রয়েছে উচ্চ পরিমাণ প্রোটিন, যা জীবাণু থেকে দেহকে সুরক্ষা করে। আম পুরুষের শুক্রাণুর গুণগত মানকে ভালো রাখে। এছাড়া পুরুষের গোপন শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে এবং শরীর ফিট রাখে। পাশাপাশি ওজন কমাতে চাইলে কাঁচা আম খেতে পারেন। কেননা পাকা আমে শর্করার পরিমাণ বেশি থাকে। কাঁচা আম দেহের শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, দুপুরে খাওয়ার পর কাঁচা আম খেলে বিকালের তন্দ্রাভাব কাটে। লিভারের সমস্যায় কাঁচা আম খাওয়া বেশ উপকারী। এটি বাইল অ্যাসিড নিঃসরণ বাড়ায় এবং অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়াকে পরিষ্কার করে।

কাঁঠালের ১২ উপকারিতা

কাঁঠালে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন। এই ভিটামিন দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখে। ফাইবারের ভালো একটি উৎস কাঁঠাল। কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো সমস্যা থেকে দূরে থাকা সম্ভব হয় নিয়মিত কাঁঠাল খেলে। আলসারের সমস্যা প্রাকৃতিক উপায়ে কমাতে সাহায্য করে কাঁঠালে থাকা এক ধরনের উপকারী উপাদান। বেশ কয়েক ধরনের অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের উৎস কাঁঠাল। এসব উপাদান হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের মতো রোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। কাঁঠালে থাকা পটাসিয়াম উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। এতে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে। প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি মেলে কাঁঠাল থেকে।


নিয়মিত ফলটি খেলে ত্বক ভালো থাকে এবং ত্বককে রোদের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে দূরে রাখা যায়। বেশ কয়েক ধরনের অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের উৎস কাঁঠাল। এসব উপাদান হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের মতো রোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে কাঁঠাল খেলে। কারণ কাঁঠালে থাকা শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আমাদের দেহকে ক্ষতিকর ফ্রির‌্যাডিকেলস থেকে রক্ষা করে। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে কাঁঠালে থাকা ভিটামিন সি। কাঁঠালে থাকা ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম হাড়ের গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পাশাপাশি হাড় শক্তিশালী রাখতে সহায়তা করে। আয়রন মেলে ফলটি থেকে। এই খনিজ উপাদান রক্তস্বল্পতা দূর করতেও সাহায্য করে।

জামরুলের যত গুণ

সাধারণত মাঘ মাস থেকে চৈত্র মাসের মধ্যে গাছে ফুল আসে। আর চৈত্র থেকে জ্যৈষ্ঠ মাসের মধ্যে পাকা জামরুল পাওয়া যায়। বর্ষায়ও ফল ধরে। বছরে দুই তিন দফায় ফল ধরে। তবে বর্ষার জামরুলের স্বাদ কম হয়। ডায়াবেটিক রোগীর জন্য খুবই উপকারি এই জামরুল। যারা ওজন কমানোর চেষ্টায় আছেন, তারা এই ফলটিকে পথ্য হিসেবে নিতে পারেন। যতই খাবেন পেট ভরবে কিন্তু খুব বেশি মোটা হওয়ার ভয় থাকবে না। দেখতে ছোট ফল হলেও কাজ করে সাইজে বড় ফলের সমান। এতে আছে তরমুজ ও আনারসের সমান খনিজ পদার্থ। আম ও কমলার চেয়ে তিনগুণ। ক্যালসিয়াম ধারণের দিক থেকেও আঙুরকে হার মানিয়েছে জামরুল। একটি লিচুর সমান ক্যালসিয়াম পাওয়া যায় একেকটি জামরুলে। পেঁপে ও কাঁঠালের চেয়ে বেশি আয়রন এবং আম, কমলা ও আঙুরের চেয়ে বেশি ফসফরাস রয়েছে জামরুলে। যে কারণে দেখতে ছোটখাটো হলেও জামরুলকে হেলাফেলায় নেওয়ার কোনো কারণ নেই।

তাল শাঁস রাস্তার মোড়ে বিক্রি হয়

প্রচন্ড দাবদাহে যখন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে জনজীবন, তখন তীব্র দাবদাহের মাঝে একটু স্বস্তি পেতে শৌখিন ক্রেতা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে মধু মাসের ফল তাল শাঁস। এ বছরও ক্রেতাদের কাছে তাল শাঁসের কদর বেড়েছে বহুগুণ। নগরীসহ বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের বিভিন্ন হাট-বাজারে কিংবা স্কুল-কলেজের পাশে রাস্তার মোড়ে মোড়ে বিক্রেতারা হরদমে বিক্রি করছেন তাল শাঁস। কোনো কোনো বিক্রেতা ভ্যানযোগে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে তাল শাঁস বিক্রি করছেন। জেলার বিভিন্ন উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল ঘুরে তাল শাঁস ক্রয় করে নগরীতে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন প্রায় শতাধিক পরিবারের লোকজন।
নগরীর রূপাতলী এলাকার তাল শাঁস বিক্রেতা আহম্মেদ আলী জানান, প্রতিবছর মধুমাসে সে নগরীর পার্শ্ববর্তী উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকারি দামে তাল শাঁস ক্রয় করে নগরীতে এনে বিক্রি করেন। ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলায় এ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় অসংখ্য তাল গাছ বিনষ্ট হয়ে গেছে। তাছাড়া চলতি মৌসুমে তালের ফলন কম হওয়ায় সর্বত্র তাল শাঁসের সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে চড়া মূল্যে এ মৌসুমি ফল বিক্রি করতে হচ্ছে বলেও সে উল্লেখ করেন। বর্তমানে প্রতিটি তাল শাঁস ১০ থেকে ১৫ টাকায় বিক্রি করে প্রতিদিন সে চার থেকে পাঁচ’শ টাকা আয় করছেন। শৌখিন ক্রেতা থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীরা প্রচন্ড গরমে একটু স্বস্তি পেতে এখন ভিড় করছেন তাল শাঁস বিক্রেতাদের কাছে।


নগরীর বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে, গাড়ি থামিয়ে অনেক শৌখিন ক্রেতারা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের জন্য পীড় (একবোটা) হিসেবে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন তাল শাঁস। রিক্সাচালক থেকে শুরু করে সকল শ্রেণি বা পেশার লোকজনই মৌসুমি ফল তাল শাঁস কিনতে ভিড় করছেন বিক্রেতাদের কাছে। চলতি মৌসুমে তালের সংখ্যা কম হওয়ায় মুহূর্তের মধ্যেই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে ক্রেতাদের আনা এ মৌসুমি ফল তাল শাঁস।
দেশীয় বিভিন্ন ফলের পুষ্টি গুণাগুণ সম্পর্কে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রেজিস্ট্রার ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. মাহবুব আলম মীর্জা জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন।


জামের যত উপকারিতা

আমাদের দেশে গ্রীষ্মকালে বিভিন্ন ধরনের রসাল ও মিষ্টি ফল হয়ে থাকে। বিভিন্ন ফলে রয়েছে নানান পুষ্টিগুণ। ফল আমাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করার পাশাপাশি রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে শরীরে শক্তি জোগায়। এছাড়া প্রায় সব ফলেই পানি থাকায় সেগুলো আমাদের শরীরের পানিশূন্যতাও দূর করতে সাহায্য করে। আমাদের দেশীয় ফলগুলোর মধ্যে জাম অন্যতম। এ ফলটিতে রয়েছে খাদ্য শক্তি, আঁশ, ক্যালসিয়াম, লৌহ, শর্করা, ক্যারোটিন, চর্বি, আমিষ ও ভিটামিন-সি’র মতো গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উপাদান। এটি ত্বক টান টান করতে ও স্মৃতিশক্তি বাড়াতে অনেক কার্যকরী। এছাড়া ফলটির রয়েছে অনেক রকম গুণাবলি।
পুষ্টিবিদদের মতে, নিয়মিত জাম খেলে ত্বকের অনেক সমস্যা দূর হয়। এটি ত্বক টান টান করতে সাহায্য করে। এছাড়া এটি ত্বকের ব্রণ, ব্ল্যাকহেডস ইত্যাদির সমস্যা দূর করে ত্বককে উজ্জ্বল রাখতে সাহায্য করে। অনেকেই হজমজনিত নানা সমস্যায় ভুগে থাকেন। হজমের সমস্যার বিপরীতে জাম অনেক উপকারী ফল। বিশেষজ্ঞদের মতে, জাম হজমশক্তি দ্রুত বাড়াতে সাহায্য করে। ডায়েটারি ফাইবারের অন্যতম কার্যকরী উৎস হওয়ার কারণে এটি নিয়মিত খাওয়ার ফলে হজমশক্তি বাড়ে ও হজমসংক্রান্ত নানা সমস্যা দূর করে। এছাড়া এটি লিভারকে ভালো রাখতেও কার্যকরী।
জামে ফসফরাস ও পটাশিয়াম জাতীয় খনিজ থাকার কারণে এটি হৃদযন্ত্রের জন্য অনেক উপকারী হিসেবে কাজ করে। এটি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রেখে হৃদযন্ত্রকে ভালো রাখতে সাহায্য করে। এ কারণে জামের মৌসুমে নিয়মিত এটি খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। জাম শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। এ ফলটিতে থাকা ভিটামিন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে অনেক উপকারী। এছাড়া জামের অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য থাকার কারণে এটি শরীরের ভেতরের এবং বাইরের সংক্রমণকেও প্রতিরোধ করে।
দাঁতকে মজবুত করতে অনেক উপকারী হিসেবে কাজ করে জাম। এতে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম ও আয়রন থাকার কারণে এটি দাঁত ও হাড়কে মজবুত রাখতে সাহায্য করে। জামে কম গ্লাইসেমিক সূচক থাকার কারণে এটি রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। তাই এটি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য অনেক উপকারী। এছাড়া ডায়াবেটিস রোগীদের ঘন ঘন তৃষ্ণা ও প্রসাব এবং দুর্বলতার সমস্যা কমাতেও জাম অনেক উপকারী ফল।

গোলাপজামের উপকারিতা

গোলাপ জাম ফল ভিটামিন-সি এর চমৎকার উৎস। যা ত্বককে উজ্জ্বল করে এবং রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়ায়। এটি উচ্চ ফাইবার কন্টেন্টের জন্য হজম উন্নত করে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। এছাড়া, গোলাপ জাম ফলের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান শরীরের বিষাক্ত পদার্থ পরিস্কার করতে সাহায্য করে। গোলাপজাম গাছ দীর্ঘদিন বাঁচে (প্রায় ৪০/৫০ বছর) এবং ফল দান করে। গাছ মাঝারী আকৃতির। গাছ লাগানোর ২/৩ বছর পর থেকেই ফল সংগ্রহ করা যায়। গোলাপজাম গাছে মাঘ-ফাল্গুন মাসে ফুল আসে এবং বৈশাখ থেকে শ্রাবণ মাসের মধ্যে ফল পাকে। গোলাপজামের ফুলও খুবই দৃষ্টিনন্দন। গোলাপজাম কাঁচা অবস্থায় সবুজাভ এবং কিছুটা শক্ত হলেও পাকলে নরম ও সাদাটে হয়। ভেতরে দু’টি বীজ থাকে, যা থেকে বংশ বিস্তার হয়। বাড়ির আঙ্গিনায় বা পাহাড়ি এলাকায় একসময় দেখা যেতো দৃষ্টি নন্দন ও খেতে সুস্বাদু গোলাপজাম। টক মিষ্টি স্বাদের এই ফলে প্রচুর ভিটামিন-সি ছাড়াও রয়েছে ভিটামিন বি-১, বি-২, ক্যারোটিন এবং ক্যালসিয়াম। একটি গোলাপজামে প্রায় ৪০ কিলো ক্যালরি খাদ্যশক্তি থাকে। গোলাপ জাম গাছের ছাল ও পাতা সিদ্ধ করে সেবন করলে পেটের পীড়ায় উপকার পাওয়া যায়। গোলাপ জাম গাছের পাতার রস পান করলে ডায়রিয়া ভালো হয়। গোলাপ জাম খেলে বমিভাব দূর হয়। এছাড়াও গোলাপ জাম গাছের ছাল ও পাতা ডায়াবেটিসের জন্য বেশ উপকারী।

জিআই স্বীকৃতি পেল বরিশালের আমড়া

বরিশালের ঐতিহ্যবাহী মৌসুমি ফল আমড়া ভৌগোলিক নির্দেশক জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে। ‘জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়ায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে বরিশালের আমড়ার পরিচিতি ও চাহিদা বাড়বে।’ গত ৩০ এপ্রিল শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, শিল্প-নক্সা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরের আয়োজনে বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবস ২০২৫ এর আলোচনা সভায় শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী জিআই স্বীকৃতি পাওয়ার সনদ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেনের হাতে হস্তান্তর করেছেন। সনদ পেয়ে বরিশালের জেলা প্রশাসক বলেন, ‘বরিশালের আমড়ার সুখ্যাতি রয়েছে দেশজুড়ে। বরিশালের সনাতন ধর্মের বহু পুরানো সংস্কৃতি হলো তাদের যেকোনো অনুষ্ঠানে খাবার শেষে আমড়ার টক থাকতে হবে। এটাকে তারা ‘শেষ পাত’ বলে। বরিশালের মিঠা পানির কারণে আমড়ার প্রাকৃতিক গন্ধ বিদ্যমান, স্বাদে মিষ্টি ও সুস্বাদু। যা অন্যান্য অঞ্চলের আমড়া থেকে আলাদা হয়ে থাকে। তিনি আরও বলেন, বরিশালের আমড়া শুধু একটি সুস্বাদু ফল নয়, এটি এ অঞ্চলের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর স্বতন্ত্র স্বাদ, পুষ্টিগুণ এবং বহুমুখী ব্যবহার বরিশালের আমড়াকে সারা দেশে পরিচিতি দিয়েছে। জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়ায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে বরিশালের আমড়ার পরিচিতি ও চাহিদা বাড়বে, যা দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি অর্থনীতিকে আরও সমৃদ্ধ করবে।
আমড়ায় ভিটামিন এ, বি ও সি ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহ ইত্যাদি প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান রয়েছে। এছাড়া বরিশালের আমড়া তুলনামূলক মিষ্টি হওয়ায় সর্বত্র এর চাহিদাও দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বরিশাল বিভাগের এমন কোনো জেলা, উপজেলা কিংবা ইউনিয়নের ঘরবাড়ি নেই যে বাড়িতে আমড়া গাছ নেই। এরমধ্যে দীর্ঘদিন থেকে বিভাগের পিরোজপুরের কাউখালী, নাজিরপুর ও স্বরূপকাঠীতে বাণিজ্যিকভাবে আমড়ার চাষ হচ্ছে। এ অঞ্চলের ছোট-বড় রাস্তার পাশে বাড়ির উঠানে একটি আমড়া গাছ লাগানো যেন এখন প্রতিটি মানুষের নিয়মে পরিণত হয়েছে। বহু মানুষ পতিত জমি কেটে আইল তৈরি করে, আবার কেউ কেউ ফসলি জমিতে বড় বড় আমড়ার বাগান তৈরি করেছেন। কোনো কোনো চাষির বাগান থেকে বছরে লাখ লাখ টাকা আয় হচ্ছে আমড়া বিক্রি করে। শ্রাবণ, ভাদ্র মাসে পরিপক্ক আমড়া পাওয়া যায়। গ্রামের বেশিরভাগ এলাকায় আমড়া কেনা-বেচার পাইকার রয়েছে। তারা ফাল্গুন ও চৈত্র মাসে কুড়ি দেখেই আগাম টাকা দিয়ে বাগান ক্রয় করে রাখেন। আবার অনেক চাষি নিজেরাই ভরা মৌসুমে আমড়া বিক্রি করেন। কাউখালী উপজেলার প্রধান বন্দর লঞ্চঘাট, দক্ষিণ বাজারসহ বিভিন্ন বড় বাজারে রয়েছে অসংখ্য আমড়ার আড়ত। পাইকাররা আড়ত থেকে আমড়া ক্রয় করে ঢাকা, চাঁদপুর, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মেঘনাঘাট এলাকায় চালান করেন।
বরিশাল জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নিঃসন্দেহে আমড়া একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল। আমড়ার বাগান করা বা চাষ করা খুবই সহজ। আমড়ার চারা লাগানোর জন্য উৎসাহিত করা, ফলন বৃদ্ধি ও রোগ-বালাই দমনের জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া হয়। বরিশালের কৃষক বন্ধু অবসরপ্রাপ্ত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য জেলা ও উপজেলায় যে আমড়া বিক্রি হচ্ছে তার বেশিরভাগই বরিশালের। এ অঞ্চলের আমড়া খেতে খুবই সুস্বাদু বলে সবার কাছে বরিশালের আমড়া অনেক জনপ্রিয়।

প্যানেল

×