
ছবিঃ সংগৃহীত
ইসলামি বিপ্লবের সর্বোচ্চ নেতার উপদেষ্টা ড. আলী আকবর ভেলায়াতি বলেছেন, প্রস্তাবিত ‘জাঙ্গেজুর করিডোর’ প্রকল্পটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলি শাসকগোষ্ঠীর নেতৃত্বে একটি কৌশলগত ষড়যন্ত্র, যার লক্ষ্য ইরানের জাতীয় নিরাপত্তা ক্ষুণ্ণ করা এবং রাশিয়ার সঙ্গে ইরানের কৌশলগত সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা।
তেহরানে আয়োজিত বিশিষ্ট সুফি সাধক শেখ সাফি আল-দীন আরদেবিলীর স্মরণসভায় বক্তব্য রাখার সময় ভেলায়াতি এসব মন্তব্য করেন। সেখানে তিনি আজারবাইজান প্রজাতন্ত্র এবং জাঙ্গেজুর করিডোর ঘিরে বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক উদ্বেগের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, “ইরানের ঐতিহাসিক ঐক্য ও সাংস্কৃতিক গভীরতায় দীর্ঘদিন ধরে অস্বস্তি বোধ করে আসছে বিশ্ব সায়োনিজম ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তারা ইরানি পরিচয়ের ভিত্তিকে দুর্বল করে জাতীয় নিরাপত্তায় আঘাত হানতে চায়।”
ভেলায়াতি বলেন, জাঙ্গেজুর করিডোর প্রকল্পের আড়ালে আরও গভীর ভূ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্য লুকিয়ে রয়েছে। এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হচ্ছে প্রতিরোধ জোটকে দুর্বল করা, ককেশাস অঞ্চলের সঙ্গে ইরানের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা, এবং দক্ষিণে ইরান ও রাশিয়াকে কার্যত স্থল অবরোধে ফেলা।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, "ইরানের জাতীয় নিরাপত্তা একটি লাল রেখা—এর কোনো আপস নেই।"
ভেলায়াতির বক্তব্যের পূর্ণ বিবরণ:
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আজারবাইজানের সাহসী ও সংস্কৃতিমনা জনগণ, বিশেষ করে গর্বিত আরদেবিল প্রদেশের প্রতি সালাম ও শুভেচ্ছা। এই অনুষ্ঠানের আয়োজনের জন্য আমি সর্বোচ্চ নেতার প্রতিনিধি এবং আরদেবিলের সম্মানিত ইমাম জুমা আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ হাসান আমেলির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। তিনি যেভাবে শেখ সাফি আল-দীন আরদেবিলীর মর্যাদা রক্ষায় ভূমিকা রেখেছেন, তা প্রশংসার যোগ্য।
আজকের এই সমাবেশে সম্মানিত অতিথিবৃন্দ, জ্ঞানী ও চিন্তাবিদদের সামনে আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই—ইরানের জাতি অতীতেও যেমন মার্কিন ও ইসরায়েলি আগ্রাসনের মুখে ঐক্য, সাহস ও প্রজ্ঞা দেখিয়েছে, আজও সে ঐতিহ্য বহন করছে।
ইরানি সংস্কৃতির দুটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য—বহু জাতিগোষ্ঠীর অভ্যন্তরীণ ঐক্য এবং ইতিহাসের ধারাবাহিকতা—ইরানের প্রাচীন সভ্যতাকে একটি পার্সিয়ান কার্পেটের বুননের মতো সুদৃঢ় করে রেখেছে।
ইরানি জাতিসত্তার ভিত্তি হলো একেশ্বরবাদ। ইতিহাসবিদ শাহরাস্তানি ও মাসউদীর মতো গবেষকরা লিখেছেন, প্রাচীন ইরানি রাজারা নিজেদেরকে নবী ইব্রাহিম (আ.)-এর বংশধর মনে করতেন। ইসলামের আবির্ভাবের পর ইরানিরা পূর্বের জরতুষ্ট্রবাদ ত্যাগ করে একেশ্বরবাদী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে।
গবেষকদের মতে, জরতুষ্ট্র নিজেই আজারবাইজান অঞ্চলের ছিলেন।
ইরানিরা যুগে যুগে নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়েছে—আবু মুসলিম খোরাসানির উমাইয়া বিরোধী বিদ্রোহ, খাজা নাসির আল-দীন তুসির মনগোল আমলে ভূমিকা, এবং সাফাভি পূর্ববর্তী শিয়া আন্দোলন ছিল এর প্রমাণ।
শেখ সাফি আল-দীন আরদেবিলী ছিলেন একজন সুফি, মুজতাহিদ ও ইমাম মূসা আল-কাজিম (আ.)-এর বংশধর। তিনি একটি প্রকৃত আধ্যাত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন, যা শিয়াবাদ, সুফিবাদ ও ইরানি পরিচয়ের মধ্যে এক দৃঢ় বন্ধন তৈরি করেছিল। তাঁর দেখানো পথেই শাহ ইসমাইল সাফাভি ইরানকে একত্রিত করেছিলেন।
আজও আজারবাইজান অঞ্চল ঈমান, শিয়াবাদ, এবং ইরানি-ইসলামী পরিচয়ের একটি মজবুত ঘাঁটি। এই অঞ্চল সবসময়ই ইরানের অখণ্ডতা, স্বাধীনতা ও ইসলামী বিপ্লবের মূল্যবোধ রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে এসেছে।
কিন্তু ইরানের এই ঐতিহাসিক ঐক্য ও কৌশলগত সাংস্কৃতিক গভীরতা দীর্ঘদিন ধরে ইরানের শত্রুদের, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্ব সায়োনিজমকে অস্বস্তিতে ফেলেছে।
আজকের “জাঙ্গেজুর করিডোর” প্রকল্পও একটি গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ, যার মাধ্যমে তারা ককেশাস অঞ্চলে ইরানের প্রভাব হ্রাস এবং ভূখণ্ডিক অবরোধের মাধ্যমে রাশিয়া ও ইরানকে কৌশলগতভাবে দুর্বল করতে চায়।
এই ষড়যন্ত্র মার্কিন পরিকল্পনার একটি অংশ, যার লক্ষ্য ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে মনোযোগ সরিয়ে ককেশাসে চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে রণকৌশলগত অবস্থান পরিবর্তন করা। এটি ন্যাটো এবং কিছু চরম প্যান-তুর্কি আন্দোলনের সমর্থনও পেয়েছে।
তবে ইরান প্রথম থেকেই এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। সীমান্তে বাহিনী মোতায়েন ও মহড়া পরিচালনার মাধ্যমে স্পষ্ট করে দিয়েছে—জাতীয় নিরাপত্তা আমাদের লাল রেখা।
ইরান একটি ‘সক্রিয় প্রতিরোধ’ নীতির অনুসারী, যেখানে প্রতিক্রিয়াশীল মনোভাবের পরিবর্তে অগ্রিম পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।
আরদেবিলের সাহসী জনগণ অতীতেও যেমন অটোমান ও জারশাসিত রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, কলোনিয়াল চক্রান্ত রুখে দিয়ে ইরানের ভূখণ্ডকে অখণ্ড রেখেছে—আজও তারা সে ঐতিহ্যের ধারক।
আজও শত্রুরা তথাকথিত অর্থনৈতিক প্রকল্পের আড়ালে ইরানের ভূ-রাজনৈতিক গভীরতা ভেদ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।
কিন্তু ইরানি জাতি, শেখ সাফি আল-দীনের মতো মহাপুরুষদের শিক্ষা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে, ঐক্য, সচেতনতা ও ঈমানের শক্তিতে এই ষড়যন্ত্র রুখে দেবে।
ইমরান