
ছবি: সংগৃহীত
৬০ বছরেরও বেশি সময় আগে, এক ঠান্ডা রাত। চারদিকে চীনা সেনাদের ঘিরে ফেলা, গোলাগুলির গর্জন, আর সেই মুহূর্তে এক সন্ন্যাসী সৈনিকের বেশে গোপনে নিজের প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে পড়েন। তিনি ছিলেন তিব্বতের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা, ১৪তম দালাই লামা।
চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল একটাই—বাঁচা। সেই যাত্রা ছিল দুঃসাহসিক, দুই সপ্তাহ ধরে হিমালয়ের দুর্গম পথ পেরিয়ে ভারতের মাটিতে পৌঁছান তিনি। এই ঘটনা তিব্বতের ইতিহাসকে যেমন বদলে দিয়েছে, তেমনি চীন-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্কেও গভীর ছায়া ফেলেছে।
চীনের ‘নাটকীয় আমন্ত্রণ’ থেকেই শুরু
১৯৫০ সালে চীন তিব্বত দখল করে নেয়ার পর থেকেই উত্তেজনা বাড়তে থাকে। যদিও ১৯৫১ সালের সেভেন্টিন পয়েন্ট চুক্তিতে তিব্বতকে স্বায়ত্তশাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল চীন, বাস্তবে তা মানা হয়নি। এরই মধ্যে এক চীনা জেনারেল দালাই লামাকে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানান, শর্ত ছিল দেহরক্ষী ছাড়া আসতে হবে।
তিব্বতের প্রশাসনে তখনই উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় গুজব দালাই লামাকে হয়তো অপহরণ বা হত্যা করার পরিকল্পনা।
লাখো মানুষের মানববর্ম ও বিদ্রোহ
১৯৫৯ সালের ১০ মার্চ, লক্ষাধিক তিব্বতি নাগরিক নরবুলিঙ্গা প্রাসাদের চারপাশে মানবশৃঙ্খল গড়ে তোলেন দালাই লামাকে রক্ষা করতে। এরপর শুরু হয় বিদ্রোহ। তিব্বতি যোদ্ধাদের সঙ্গে চীনা সেনার সংঘর্ষ ঘটে। চীন প্রাসাদে গোলাবর্ষণ করে। এমন অবস্থায় রাজ্য ওরাকলের নির্দেশে পালানোর সিদ্ধান্ত নেন দালাই লামা।
রাতের অন্ধকারে হিমালয় পাড়ি
১৭ মার্চ, রাতের অন্ধকারে তিব্বতি সামরিক পোশাকে দালাই লামা, তাঁর পরিবার, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ও দেহরক্ষীদের নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। দুর্গম পার্বত্য পথ, বরফঢাকা গিরিপথ, চীনা টহল এড়িয়ে তাঁরা সামনে এগিয়ে যান। তাঁদের সাহায্য করে স্থানীয় বিদ্রোহীরা ও ধর্মীয় প্রার্থনা।
কথিত আছে, সন্ন্যাসীদের প্রার্থনায় হিমালয়ের কুয়াশা ঘন হয়ে ওঠে, যাতে চীনা বিমানের নজর এড়ানো যায়।
১৩ দিন পর, ৩১ মার্চ ১৯৫৯, তাঁরা অরুণাচলের খেনজিমানে ভারতের সীমানায় প্রবেশ করেন। সেখানে আসাম রাইফেলসের সেনারা তাঁদের অভ্যর্থনা জানান। পরদিন চুতাংমু চৌকিতে তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাগত জানানো হয় এবং নেওয়া হয় তাওয়াং মঠে।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু প্রবল চীনা চাপের মধ্যেও ৩ এপ্রিল, দলাই লামাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেন। নেহরু সংসদে বলেন, “এটি একটি কঠিন ও বেদনাদায়ক যাত্রা ছিল। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে তিনি তাঁর সঙ্গীদের সঙ্গে তিব্বতের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে পারেন—এটাই উপযুক্ত।”
তাওয়াং থেকে তাঁকে প্রথমে তেজপুরে নেওয়া হয়, সেখানে ১৮ এপ্রিল দলাই লামা ভারতের মাটিতে প্রথম বিবৃতি দেন। তিনি চীনের আগ্রাসনের নিন্দা করেন এবং জানান, তিনি নিজের ইচ্ছায় পালিয়েছেন—চীনের দাবিকে নাকচ করেন।
এরপর তাঁকে মুসৌরি এবং পরে ১৯৬০ সালে ধর্মশালায় স্থানান্তর করা হয়, যেখানে তিনি “লিটল লাসা” নামে পরিচিত তিব্বতি নির্বাসিত সরকার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় কেন্দ্র গড়ে তোলেন।
১৯৮৯ সালে দলাই লামা শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন।
ভারতের এই আশ্রয় প্রদান ছিল চীনের দৃষ্টিতে হস্তক্ষেপ। চীন কড়া ভাষায় নিন্দা করে। এর ফলেই ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের মাটিও তৈরি হয়।
মুমু ২