
ছবি: সংগৃহীত
“বিশ্বকাপ থেকে কোনও ফুটবল ভক্তকে বাদ দেওয়া অপমানজনক, শুধু ইরানিদের জন্যই নয়,” বলছেন তেহরানের বরনা নিউজ এজেন্সির আলি রেজায়ি। মার্চে, ইরানের জাতীয় দল ২০২৬ বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জনকারী দ্বিতীয় দল হিসেবে জায়গা নিশ্চিত করে। তবে জুন মাসে, ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের ওপর বোমা হামলার অনুমোদন দেন এবং দেশটির ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী, ইরানি জাতীয় দল হয়তো আগামী গ্রীষ্মে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে পারবে, কিন্তু সমর্থকরা—এমনকি সম্ভবত সংবাদকর্মীরাও—প্রবেশের সুযোগ পাবে না।
তেহরানসহ অন্যান্য শহরের মানুষ সম্প্রতি নানা সংকটে জর্জরিত হলেও, বিশ্বকাপের মতো আয়োজনে নিষিদ্ধ হওয়া তাদের জন্য বড় আঘাত। যদিও ইরানিদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ বরাবরই কঠিন ছিল। ভারযেশ৩ নামের শীর্ষস্থানীয় ক্রীড়া সাইটের লেখক বেনাম জাফারজাদেহ বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ইরানি শাসকদের সঙ্গে যদি কোনো সমস্যা থাকে, তা সাধারণ ইরানি নাগরিকদের ওপর প্রভাব ফেলা উচিত নয়। যদি কেউ কোনও অবৈধ কাজ না করে, তাকে কেন শাস্তি পেতে হবে? এটা শুধু বিশ্বকাপের বিষয় নয়—পুরো নীতিটাই বদলানো দরকার।”
তেহরানপ্রবাসী সমর্থক সিয়াভাশ পাকদামান বলছেন, “বিশ্বকাপ বর্জন কোনও সমাধান নয়। যুক্তরাষ্ট্রে খেলতে অস্বীকৃতি জানানো অত্যন্ত বিপজ্জনক নজির তৈরি করবে—এতে কোনও আয়োজক দেশ নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী দল বাদ দিতে শুরু করতে পারে। যেমনটা জাতিসংঘ অধিবেশনে ইরানি প্রতিনিধিদের উপস্থিতি স্বাভাবিক বিষয়, ঠিক তেমনই বিশ্বকাপ ড্র অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রে খেলাও স্বাভাবিকভাবে অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত, স্থান পরিবর্তনের প্রশ্নই ওঠে না।”
তবে অনেকেই মনে করেন, বিশ্বকাপ বর্জন করলে ইরানেরই বেশি ক্ষতি হবে। জাফারজাদেহ বলেন, “এটা কেবল জাতীয় দলকে একটি বড় টুর্নামেন্ট থেকে বঞ্চিত করবে এবং শেষ পর্যন্ত ইরানেরই ক্ষতি হবে। বরং এটা হয়তো কিছু মার্কিন কর্মকর্তার জন্য সুবিধাজনক হবে। কিছুদিন শিরোনামে থাকলেও, বিশ্বকাপ শুরু হলে সেটি হারিয়ে যাবে, কোনও ফলও আসবে না।”
ইরানেও প্রশ্ন উঠছে—যেখানে দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি দীর্ঘদিন ধরেই ইসরায়েলি ক্রীড়াবিদদের সঙ্গে খেলা নিষিদ্ধ রেখেছেন—যদি ২০২২ কাতার বিশ্বকাপে কিছু দেশের সমর্থকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হতো, তখন বিশ্ব প্রতিক্রিয়া কেমন হতো?
রেজায়ি বলেন, “যদি যুক্তরাষ্ট্র সত্যিই সমর্থকদের প্রবেশে বাধা দেয়, তাহলে আয়োজক দেশ বদলানো উচিত। এতে বিশ্বকাপের নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের সুনাম নষ্ট হবে। তবে কঠোর প্রবেশ বিধি থাকলে আমাদের উচিত ফুটবলকে রক্ষা করা। বিশ্বকাপ তো খেলাধুলার উৎসব।”
তবে জাফারজাদেহ মনে করেন না, এ বিষয়টি নিয়ে ফিফা বা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনো কোনও পদক্ষেপ নেবেন। “ফিফা এই ধরনের কঠিন চ্যালেঞ্জে জড়াতে চাইবে না,” বলেন তিনি। তবে অন্য উপায় হতে পারে, “বিশ্বকাপ চলাকালীন অন্তত এই নীতির স্থগিতাদেশ আনতে ফিফা-কে তার সব প্রভাব কাজে লাগাতে হবে।”
অনেকে ধারণা করছেন, ফিফা হয়তো ইরানকে কানাডা বা মেক্সিকোতে খেলতে পাঠিয়ে সমস্যাটা এড়িয়ে যাবে, যাতে তারা টুর্নামেন্টের শেষ দিকে না পৌঁছায়, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে খেলতে হতো। কিন্তু রেজায়ি বলেন, “মেক্সিকো বা কানাডায় খেলানো আসল সমস্যার সমাধান নয়—এটা কেবল বিষয়টা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা।”
তবে অনেকেই মনে করেন, শেষ পর্যন্ত এটা হয়েই যাবে। জাফারজাদেহ বলেন, “কানাডায় ইরানি অভিবাসীর সংখ্যা অনেক, যদিও তাদের অনেকেই ইরানি সরকারের বিরোধী, ফলে জাতীয় দল সেখানেও খুব বেশি সমর্থন পাবে না। বরং মেক্সিকো তুলনামূলক কম বিতর্কিত এবং আকর্ষণীয় গন্তব্য।”
এখানে আরেকটি প্রশ্নও উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রে ইরানি-আমেরিকানদের সংখ্যা ১০ লাখের বেশি, যদিও তাদের বড় একটি অংশ ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের আগে বা পরে দেশ ছেড়েছিলেন।
পাকদামান বলেন, “অনেক ইরানি মনে করেন, জাতীয় দল সরকারের প্রতিনিধিত্ব করে—যা আমার মতে ভুল। আর যুক্তরাষ্ট্রে যেহেতু এমন সরকারের বিরোধীদের সংখ্যা বেশি, তাই ম্যাচ চলাকালে জাতীয় দল হয়তো চাপের মুখে পড়বে। অবশ্য, আমি আশা করি আমার আশঙ্কা ভুল প্রমাণিত হবে।”
রাশিয়া ও কাতার বিশ্বকাপে গিয়েছিলেন জাফারজাদেহ, এবারও যুক্তরাষ্ট্রে যেতে চান। তিনি বলেন, “কিছু মানুষ মনে করে, জাতীয় দল সরকারের প্রতিনিধি, আর বিদেশে বসবাসকারী ইরানিদের মধ্যে এই ধারণা আরও দৃঢ়। অবশ্য, ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ জাতীয়তাবাদী আবেগ উসকে দিয়েছে, তবে এটা কতটা সমর্থনে রূপ নেবে, বলা মুশকিল। কয়েক মাসের মধ্যে পরিস্থিতি বোঝা যাবে।”
তবে এখনই একটা ক্ষীণ আশার আলো রয়েছে, কারণ সময় আছে। ইরান ছাড়াও আরও ১৮টি দেশ রয়েছে, যারা আংশিক বা সম্পূর্ণ মার্কিন ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার আওতায়, এর মধ্যে সুদান, সিয়েরা লিওন, ভেনেজুয়েলা ও হাইতির মতো দেশও আছে, যারা বিশ্বকাপে খেলার আশা করছে।
ইরানের বিষয়টি নিয়ে লেখক ও অনুবাদক ইসা আজিমি বলেন, “বিশ্বকাপ শুরু হতে এখনও প্রায় এক বছর বাকি। তাই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে।” তবে তিনি খুব একটা আশাবাদী নন। “ফিফা সবসময় বলে রাজনীতি থেকে খেলাকে আলাদা রাখতে হবে, কিন্তু বড় বড় রাজনৈতিক শক্তির মুখোমুখি হলে ফিফা কখনই স্বাধীন ভূমিকা নেয় না।”
বিশেষ করে যখন ইনফান্তিনো ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দেন। পাকদামান বলেন, “যদি ফিফা নিজেকে সরকারগুলোর প্রভাবমুক্ত একটি বৈশ্বিক সংগঠন মনে করে, তাহলে এমন আইনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো উচিত, যেন রাজনীতি খেলাধুলায় প্রভাব ফেলতে না পারে। অবশ্য, আমরা সবাই জানি, দুঃখজনকভাবে এমন প্রভাব আগে থেকেই আছে—বিশেষ করে যখন বিপরীতে থাকে এমন কোনও পরাশক্তি, যার জবাবদিহি করার কেউ নেই। সব সদস্য দেশকে সমান চোখে দেখা ফিফার দায়িত্ব, কিন্তু আদৌ কি সেটা হবে?”
আবির