
ছবি: সংগৃহীত
গিজার বিখ্যাত পিরামিডের পাদদেশে আর নেই সেই পুরনো কোলাহল, ট্যাক্সি ও ট্যুরিস্টের ভিড়। মোটা দাগে বলা যায়—মিশর এখন তাদের সবচেয়ে আইকনিক প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ রক্ষা করতে যাচ্ছে এক উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে।
২০২৪ সালে মিশরে পর্যটক এসেছেন প্রায় ১.৭৫ কোটি। ২০৩০ সালের মধ্যে এ সংখ্যা ৩ কোটিতে পৌঁছানোর লক্ষ্য নিয়েছে সরকার। গিজার মালভূমিতে একসঙ্গে প্রায় ২৫,০০০ মানুষ, উট, হকার ও বাসের ভিড়ে একসময় চরম বিশৃঙ্খলা ছিল।
সোশ্যাল মিডিয়ায় পিরামিড নিয়ে ছবি নয়, বরং ভুয়া গাইড, প্রতারণা ও প্রাণী নিপীড়নের অভিযোগই হয়ে উঠেছিল আলোচনার কেন্দ্র। মিশরের জিডিপির ১০% আসে পর্যটন থেকে, তাই সরকার বুঝে ফেলে—এই অভিজ্ঞতা না পাল্টালে ভবিষ্যৎ ঝুঁকিতে।
Orascom Pyramids Entertainment নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও মিশরের পর্যটন মন্ত্রণালয় যৌথভাবে ৫১ মিলিয়ন ডলারের প্রকল্পে বদলে দিয়েছে পুরো প্রাঙ্গণ। এখন দর্শনার্থীরা অনলাইনে টিকিট কেটে, ইলেকট্রনিক গেট দিয়ে প্রবেশ করে ৪৫টি ইলেকট্রিক বাসের যেকোনো একটিতে উঠে পিরামিড এলাকায় পৌঁছান।
ডিজেল বাস ও ব্যক্তিগত গাড়ি প্রবেশ নিষেধ। হকারদের জন্য নির্ধারিত ‘মার্কেট জোন’ নির্ধারণ করা হয়েছে। সঙ্গে আছে ক্যাফে, ছায়াযুক্ত বসার স্থান ও স্ফিংক্স দর্শনের জন্য বিশেষ পয়েন্ট।
পূর্বে ১১০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপে ক্লান্ত ঘোড়া ও উটকে পর্যটক টানতে বাধ্য করা হতো, অনেকেই জানতেন, কিন্তু কেউ মুখ খুলতেন না।
নতুন পরিকল্পনায় ব্যাটারি চালিত বাস, ছায়াযুক্ত পশু বিশ্রাম কেন্দ্র, ও ভেট সার্টিফিকেট বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অনুমোদনহীন রাইড বন্ধ।
তবে সব পক্ষ এই সিদ্ধান্তে খুশি না। উটচালকরা প্রতিবাদে বসেছেন, হকাররা বলছেন তাদের আয়ের পথ বন্ধ হয়েছে। এদিকে সরকার বলছে, তাদের পুনঃপ্রশিক্ষণ ও নতুন স্টলের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।
মাচু পিচু বা ভেনিসের মতো বিশ্বখ্যাত পর্যটনস্থলগুলোতে যেখানে প্রতিদিনের দর্শনার্থীর সংখ্যা সীমাবদ্ধ করে দিয়ে ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর স্থায়িত্ব রক্ষা করার চেষ্টা করা হচ্ছে, সেখানে মিশর নিয়েছে সম্পূর্ণ বিপরীত কৌশল। তারা গিজার পিরামিড এলাকায় দর্শনার্থীর সংখ্যা সীমাবদ্ধ না করে বরং অবকাঠামো ও ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের মাধ্যমে পর্যটন প্রবাহকে নিরাপদ ও সুশৃঙ্খলভাবে নিয়ন্ত্রণ করার পরিকল্পনা নিয়েছে।
মিশরের এই উচ্চাভিলাষী প্রকল্পের লক্ষ্য হলো ২০২৪ সালের ১.৭৫ কোটি পর্যটকের সংখ্যা ২০৩০ সালের মধ্যে ৩ কোটিতে উন্নীত করা। তবে, এই প্রবাহ পরিচালনা করতে গিয়ে যাতে পিরামিড বা আশেপাশের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেজন্য নেয়া হচ্ছে প্রযুক্তিনির্ভর পদক্ষেপ যেমন:
-
ইলেকট্রিক বাস চালু করে ডিজেল যানবাহন নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
-
অনলাইন টিকিটিং চালু করা হয়েছে যাতে প্রবেশ দ্রুত ও নিরবিচারে হয়।
-
পরিচ্ছন্নতা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বাড়ানো হচ্ছে নজরদারি।
-
পাথরের কবর ও স্থাপনার সংরক্ষণে বিশেষজ্ঞদের যুক্ত করা হয়েছে।
তবে পরিবেশবিদরা বলছেন, এতো বিপুলসংখ্যক মানুষের পদচারণা বাড়লে যেসব সমস্যা হতে পারে তা হলো:
-
কম্পন (vibration): হাজার হাজার মানুষের চলাফেরা ও যানবাহনের কারণে জমির কম্পন বাড়ে, যা পাথরের প্রাচীন কাঠামোতে ধীরে ধীরে ক্ষয় তৈরি করতে পারে।
-
বর্জ্য (litter): প্রতিদিন যদি হাজার হাজার পর্যটক আসে, তবে তাদের ফেলা প্লাস্টিক, খাবারের প্যাকেট, পানির বোতল ইত্যাদি পিরামিড এলাকার স্বাভাবিক পরিবেশকে ধ্বংস করতে পারে।
-
কার্বন নিঃসরণ (CO₂ emission): যদিও ইলেকট্রিক বাস চালু হয়েছে, তবু বিশাল পর্যটক স্রোতের সাথে থাকা ফ্লাইট, হোটেল, ক্লাইমেট কন্ট্রোলসহ নানা জিনিস পরিবেশে কার্বনের চাপ বাড়ায়।
তবে আশার বিষয় হলো, গিজা মালভূমি অনেকটা খোলা ও বিস্তৃত হওয়ায় সেখানে পর্যটকদের ছড়িয়ে রাখা তুলনামূলকভাবে সহজ। তা ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া প্রতিটি আধুনিক পদক্ষেপ (যেমন এলার্ম সিস্টেম, নিরাপত্তা ক্যামেরা, জনবহুল এলাকায় শীতলায়ন ইত্যাদি) এই ভিড়কে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক হতে পারে।
পরিবেশবিদদের মতে, গিজার এই ‘ওপেন আপ, বাট অর্গানাইজ’ নীতি যদি ঠিকমতো বাস্তবায়ন হয়, তবে এটি হবে এক যুগান্তকারী মডেল, যেখানে ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও পর্যটন উভয়ই সুষ্ঠুভাবে চলতে পারবে। তবে বাস্তবায়নে প্রতিটি পর্যায়ে দরকার যথাযথ তদারকি ও নাগরিকদের সচেতন অংশগ্রহণ।
মুমু ২