
ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যে চার দিনের সফরে এসে একের পর এক বিস্ময়কর কূটনৈতিক ঘোষণা দিয়েছেন, যা আমেরিকার প্রথাগত পররাষ্ট্রনীতিতে নাটকীয় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছে। রিয়াদে অনুষ্ঠিত মার্কিন-সৌদি বিনিয়োগ ফোরামে বক্তব্য দেওয়ার সময় ট্রাম্প ঘোষণা দেন, তিনি সিরিয়ার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করবেন — এই ঘোষণার পর মুহূর্তেই হলজুড়ে করতালিতে ফেটে পড়ে দর্শকরা, দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানান সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান।
এই ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্র ও সিরিয়ার সম্পর্কের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল। এর আগেই মার্কিন কর্মকর্তারা এক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো দামেস্ক সফর করেন, যেখানে তারা হায়াত তাহরির আল-শামের নেতা আহমাদ আল-শারার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এই গোষ্ঠীই মাত্র দুই সপ্তাহ আগে দীর্ঘ ১৪ বছরের গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে আসাদ সরকারকে উৎখাত করে।
এই বৈঠকের পর যুক্তরাষ্ট্র আল-শারার ওপর থাকা ১ কোটি ডলারের পুরস্কার তুলে নেয় এবং কিছুদিনের মধ্যেই তাকে সিরিয়ার নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
পরদিন, ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবার মতো একটি ছবি প্রকাশ পায়—ট্রাম্প, সৌদি যুবরাজ ও সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আল-শারা, তিনজন একসাথে যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব ও সিরিয়ার পতাকার সামনে দাঁড়িয়ে। এই ছবি ছিল মধ্যপ্রাচ্যের নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতীক।
এরপরের দিন ট্রাম্প বলেন, “আমি কখনো স্থায়ী শত্রুতার বিশ্বাস করি না।” তিনি জানান, তিনি অতীতের দ্বন্দ্ব ভুলে নতুন অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে চান, এমনকি ইরানের মতো দেশের সঙ্গেও, যাদের সঙ্গে মতপার্থক্য গভীর। পশ্চিমা হস্তক্ষেপকারীদের সমালোচনা করে তিনি বলেন, “ওরা আপনাদের শাসন শেখাতে আসে, অথচ নিজেরাই জানে না কীভাবে শাসন করতে হয়।”
দোহায় একটি মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে ট্রাম্প বলেন, তিনি চান ইরান সফল হোক — তবে কোনো পারমাণবিক অস্ত্র ছাড়াই। ইসরায়েলের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, “আমরা ইরানে কোনো পারমাণবিক ধ্বংস চাই না। আমি মনে করি, আলোচনার মাধ্যমে একটা সমাধান আসতে পারে।” তিনি জানান, ওমানে মার্কিন দূত স্টিভ উইটকফের সঙ্গে ইরানি প্রতিনিধিদের গোপন বৈঠক চলছে।
ট্রাম্পের সফরসূচিতে ইসরায়েলের কোনো স্থান ছিল না। সফরের ঠিক আগে যুক্তরাষ্ট্র ওমানের মাধ্যমে ইয়েমেনের হুথিদের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেয়, যা ইসরায়েলকে বাইরে রেখেই হয়। এই চুক্তির আওতায়, যুক্তরাষ্ট্র ইয়েমেনে বিমান হামলা বন্ধ করে এবং হুথিরা লোহিত সাগরে জাহাজ টার্গেট না করার প্রতিশ্রুতি দেয়।
১২ মে, ট্রাম্পের সৌদি আরব আগমনের আগের দিন হামাস গাজা থেকে সর্বশেষ জীবিত মার্কিন বন্দী এডান আলেকজান্ডারকে মুক্তি দেয় — কোনো ইসরায়েলি মধ্যস্থতা ছাড়াই। ট্রাম্প পরে ট্রুথ সোশ্যাল-এ পোস্ট করে কাতার ও মিশরের মধ্যস্থতাকে ধন্যবাদ জানান।
কিংস কলেজ লন্ডনের আহরন ব্রেগম্যান বলেন, “ট্রাম্প আসলে নেতানিয়াহুকে (ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী) ছুঁড়ে ফেলে দিলেন।” তিনি জানান, ট্রাম্পের একের পর এক কূটনৈতিক পদক্ষেপ ইসরায়েলের জন্য অপমানজনক। “আগে হোয়াইট হাউসে ঢুকতে চাইলে ইসরায়েলের দারস্থ হতে হতো। এখন আর সেই দরকার নেই।”
ব্রেগম্যান বলেন, ট্রাম্পের কৌশল একেবারে অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে পরিচালিত। “ট্রাম্পের কাছে অর্থই মুখ্য, আর সেই অর্থ ইসরায়েলে নেই — বরং উপসাগরীয় দেশগুলোতে আছে।” তিনি বলেন, “ট্রাম্প সত্যিই ‘আমেরিকা ফার্স্ট’-এ বিশ্বাসী, আর ইসরায়েল এই নীতির সঙ্গে যায় না।”
ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির ইব্রাহিম আল-মারাশি বলেন, “২০১৯-২০ সালের উত্তেজনার সময় যখন বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার উপক্রম হয়েছিল, তখনকার ট্রাম্প আর এই ট্রাম্প এক নয়। এখনকার ট্রাম্প অনেক বেশি বাস্তববাদী, অনেকটা নিক্সন-কিসিঞ্জারের মত।”
ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের কেলি পেতিলো বলেন, “সৌদি আরব, কাতার, ও সংযুক্ত আরব আমিরাত এখন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অংশীদার — এটা স্পষ্ট। আর ইসরায়েল তাদের একচেটিয়া সুবিধা হারাচ্ছে।”
নিউ লাইনস ইনস্টিটিউটের ক্যারোলিন রোজ বলেন, “এই সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রতিরক্ষা, বিনিয়োগ ও বাণিজ্য খাতে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করা, এবং সেইসঙ্গে ইরান, হামাস-ইসরায়েল এমনকি রাশিয়া-ইউক্রেন ইস্যুতে কূটনৈতিক অবস্থান দৃঢ় করা।”
যদিও সফরের সময় সরাসরি কোনো শান্তি চুক্তির ঘোষণা আসেনি, কিন্তু ট্রাম্প এই সফরের মাধ্যমে আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্য পাল্টে দেওয়ার বার্তা দিয়েছেন। এটি ছিল এক ভবিষ্যত সম্ভাবনার ভিত্তি নির্মাণ — যেখানে নতুন অংশীদারিত্ব ও কৌশলগত ঐক্য আঞ্চলিক শান্তির নতুন চিত্র রচনা করতে পারে।
সূত্র: https://www.arabnews.com/node/2601521/middle-east
এএইচএ