ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৯ মে ২০২৫, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২

ভারত ও পাকিস্তান

কার সামরিক শক্তি কতটা

জনকণ্ঠ ডেস্ক

প্রকাশিত: ২৩:৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৫

কার সামরিক শক্তি কতটা

ভারত ও পাকিস্তান

দক্ষিণ এশিয়ার চিরবৈরী দুই প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তান। দেশ দুটির মধ্যে সামরিক শক্তির তুলনা করা হলে সেখানে জনবল, অস্ত্রশস্ত্র, বাজেট, পারমাণবিক ক্ষমতা ও কৌশলগত নীতি-আদর্শের এক জটিল হিসাব উঠে আসে।  ১৯৪৭ সালে বিভক্তির পর থেকে উভয় দেশ একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। একাধিক যুদ্ধে জড়িয়ে যায় দেশদুটি। ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে উভয় দেশ উল্লেখ করার মতো সামরিক শক্তিও বজায় রেখে চলেছে।
মঙ্গলবার কাশ্মীরের জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র পেহেলগাঁওয়ে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ পর্যটক  নিহত হওয়ার পর দুই প্রতিবেশীর মধ্যে নতুন উত্তেজনার সূচনা। এ হামলায় পাকিস্তানের মদত থাকার অভিযোগ তুলে ভারত দেশটির বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছে। পাল্টা ব্যবস্থা ঘোষণা করেছে পাকিস্তানও। চলমান প্রেক্ষাপটে ভারত ও পাকিস্তান সামরিকভাবেও সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে। প্রাসঙ্গিকভাবে উভয় দেশের সামরিক সক্ষমতার বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসছে।

এই সক্ষমতার গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো নিয়ে বিশ্লেষণমূলক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মালয়েশিয়াভিত্তিক ‘ডিফেন্স সিকিউরিটি এশিয়া’। ‘গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার সূচক (জিএফপি) ২০২৫’ অনুসারে করা এ প্রতিবেদন ডিফেন্স সিকিউরিটি এশিয়ার ওয়েবসাইটে শুক্রবার প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনের চুম্বকাংশ জনকণ্ঠ পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো-
সামগ্রিক সামরিক র‌্যাঙ্কিং ও সক্ষমতা সূচক ॥ ‘জিএফপি ২০২৫’-এ ৬০টির বেশি বিষয়ের ভিত্তিতে ১৪৫ দেশকে মূল্যায়ন করা হয়েছে। সে অনুযায়ী, সামগ্রিক র‌্যাঙ্কিংয়ে ভারত বিশ্বের মধ্যে চতুর্থ ও পাকিস্তান বিশ্বে ১২তম অবস্থানে রয়েছে। 
র‌্যাঙ্কিংয়ে ভারতের এ অবস্থান দেশটির বড় জনসংখ্যা, বৃহত্তর প্রতিরক্ষা বাজেট ও বিস্তৃত পরিসরের সামরিক সম্পদের প্রতিফলন। অন্যদিকে পাকিস্তান ছোট অর্থনীতির কারণে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা ও বৈদেশিক সরবরাহকারী, বিশেষ করে চীনের ওপর নির্ভরশীলতা সত্ত্বেও ভারতকে মোকাবিলায় কৌশলগত বিষয়গুলোয় মনোযোগী। ফলে নির্দিষ্ট খাতগুলোয় প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে রয়েছে দেশটি।
সামরিক-বেসামরিক শক্তি ॥ প্রচলিত যুদ্ধে জনবল গুরুত্বপূর্ণ এক বিষয়। ভারত ও পাকিস্তানের জন্যও তা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বিশাল জনসংখ্যা ও স্থলবাহিনীর ওপর উভয় দেশেরই নির্ভরতা রয়েছে।
ভারতের জনসংখ্যা ১৪০ কোটি। সক্রিয় জনশক্তি ৬৬ কোটি ২০ লাখ। সক্রিয় সেনা ১৪ লাখ ৬০ হাজার।  রিজার্ভ সেনা ১১ লাখ ৬০ হাজার। আধা সামরিক বাহিনীর সদস্য ২৫ লাখ ৩০ হাজার। মোট সামরিক  জনবল ৫১ লাখ।
অপরতিকে পাকিস্তানের জনসংখ্যা ২৫ কোটি ২০ লাখ। সক্রিয় জনবল ১০ কোটি ৮০ লাখ। সক্রিয় সেনা ৬ লাখ ৫৪ হাজার। রিজার্ভ সেনা ৬ লাখ ৫০ হাজার। উল্লেখযোগ্য রেঞ্জার্স ও ফ্রন্টিয়ার কোরসহ। মোট সামরিক শক্তি ১৭ লাখ। 
ভারতের জনবল পাকিস্তানের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি এবং রিজার্ভ ও আধা সামরিক বাহিনীও বড়। পাকিস্তান যদিও কম জনবল নিয়ে কাজ করে, তবে তাদের মধ্যে ‘মুজাহিদ’-এর মতো আইএসআই-নিয়ন্ত্রিত অনিয়মিত বাহিনীগুলো রয়েছে।
প্রতিরক্ষা বাজেট ॥ ভারতের বাজেট ৭ হাজার ৯০০ কোটি ডলার। এটি জিডিপির ২ দশমিক ১ শতাংশ। এ ব্যয় পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ৯ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি।
পাকিস্তানের বাজেট ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি ডলার। এ ব্যয় জিডিপির ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। বৈদেশিক সামরিক সহায়তা ১০ কোটি ডলার। 
ভারতের প্রতিরক্ষা বাজেট পাকিস্তানের ৬ থেকে ৮ গুণ। এ বিপুল প্রতিরক্ষা ব্যয় ভারতের সামরিক খাতে প্রযুক্তি ও অবকাঠামোগত এবং জনশক্তির আধুনিকীকরণে আরও বেশি বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে সহায়ক হচ্ছে। পাকিস্তান বাজেট-সংকটে ভুগলেও চীনের সহায়তা এটিকে সামাল দিচ্ছে। পাকিস্তানের সামরিক ব্যয়ের বড় অংশ ব্যয় হয় বৃহৎ সেনাবাহিনী ও পারমাণবিক অস্ত্রের সুরক্ষায়।
স্থলবাহিনী ॥ পাক-ভারত সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে স্থলবাহিনী। দেশ দুটির মধ্যে ৩ হাজার ৩২৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত। দুদেশের মধ্যে ১৯৪৭, ১৯৬৫, ১৯৯৯ সালে প্রচলিত ঘরানার যুদ্ধের ইতিহাস রয়েছে।
ভারতের ট্যাঙ্ক ৪ হাজার ৬১৪টি। সাঁজোয়া যান ১ লাখ ৫১ হাজার ২৪৮টি। কামান ৯ হাজার ৭১৯টি। বিশেষ বাহিনীর মধ্যে আছে প্যারা এসএফ, ঘাতক ফোর্স, এমএআরসিওএস।
পাকিস্তানের ট্যাঙ্ক ৩ হাজার ৭৪২টি। সাঁজোয়া যান ৫০ হাজার। কামান ৪ হাজার ৪৭২টি। বিশেষ বাহিনীর মধ্যে আছে স্পেশাল সার্ভিস গ্রু, এসএসজি নৌ ও স্পেশাল সার্ভিস উইং। এগুলো আকারে তুলনামূলক ছোট হলেও তারা যুদ্ধক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। ট্যাঙ্ক, সশস্ত্র যান ও কামানে সংখ্যাগত দিক থেকে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে ভারত। পাকিস্তানেরও ট্যাঙ্কবহর প্রতিযোগিতামূলক। এ বহর চীনের ভিটি-৪-এর মাধ্যমে আধুনিকায়ন করা। রয়েছে এম-১১৩ ও আল-ফাহাদের স্থল সমরযান।
বিমানবাহিনী ॥ আধুনিক যুদ্ধে, বিশেষত দ্রুত সাড়া দেওয়া ও নির্ভুল আক্রমণের জন্য বিমান বাহিনীর শ্রেষ্ঠত্ব খুব গুরুত্বপূর্ণ।
ভারতের মোট বিমান ২ হাজার ২২৯টি। এর মধ্যে যুদ্ধবিমান ৫১৩ থেকে ৬০৬টি। আধুনিক বিমানের মধ্যে রয়েছে এসইউ-৩০এমকেআই, রাফায়েল, তেজস। রয়েছে আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এস-৪০০। হেলিকপ্টার আছে অ্যাপাচি ও চিনুক। আরও আছে চারটি ‘এয়ারবর্ন আর্লি ওয়ার্নিং অ্যান্ড কন্ট্রোল (এইডব্লিউঅ্যান্ডসি)’ ব্যবস্থা।
পাকিস্তানের মোট বিমান ১ হাজার ৩৯৯ থেকে ১ হাজার ৪৩৪টি। এর মধ্যে যুদ্ধবিমান ৩২৮ থেকে ৩৮৭টি। আধুনিক বিমানের মধ্যে রয়েছে এফ-১৬ ফাইটিং ফ্যালকন, জেএফ-১৭ থান্ডার, মিরেজ থ্রি/ফাইভ। আছে ভারতের চেয়ে বেশি যুদ্ধে ব্যবহার উপযোগী হেলিকপ্টার (এএইচ-১এফ কোবরাসহ)। এইডব্লিউঅ্যান্ডসি আছে সাতটি, যা ভারতের চেয়ে বেশি।
ভারতের বিমানবহর আকারে বড় ও বৈচিত্র্যময়। তবে স্কোয়াড্রনের ঘাটতি আছে। পাকিস্তানের বিমানবহর তুলনামূলক ছোট হলেও তার আধুনিকায়ন হচ্ছে। পাকিস্তানের এইডব্লিউঅ্যান্ডসি-সুবিধা বাড়তি নজরদারিতে ব্যবহার করা হয়।
নৌবাহিনী ॥ ভারত মহাসাগরে ভারতের সামুদ্রিক স্বার্থ রক্ষায় ও আরব সাগরে পাকিস্তানের অভিযানের জন্য নৌসক্ষমতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ভারতের জাহাজ রয়েছে ২৯৪টি। বিমানবাহী রণতরী আছে ২টি। সাবমেরিন ১৮টি। ডেস্ট্রয়ার ১৩টি। ফ্রিগেট ১৪টি। প্যাট্রোল নৌযান ১০৬টি। যুদ্ধে ব্যবহারের উপযোগী বিমান ৭৫টি। নৌবাহিনী সদস্যসংখ্যা ৬৭ হাজার ৭০০।
পাকিস্তানের জাহাজ ১২১টি। সাবমেরিন ৮টি। ফ্রিগেট ৯টি। প্যাট্রোল নৌযান ১৭টি। এ বাহিনীর যুদ্ধবিমান ৮টি। নৌবাহিনী সদস্যসংখ্যা ২৩ হাজার ৮০০।
ভারতীয় নৌবাহিনী তুলনামূলক বেশি শক্তিশালী ও গভীর সমুদ্রে অভিযান চালানোর উপযোগী। পাকিস্তানের অপেক্ষাকৃত ছোট নৌবাহিনী মূলত উপকূলীয় প্রতিরক্ষা ও আঞ্চলিক অভিযানে মনোযোগ দেয়। বিমানবাহী রণতরী না থাকা ও সীমিতসংখ্যক যুদ্ধবিমানের কারণে গভীর সমুদ্র দেশটির নৌবাহিনীর অভিযান চালানোয় সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
পারমাণবিক সক্ষমতা ॥ ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশই পারমাণবিক ক্ষমতার অধিকারী। তাদের প্রতিরক্ষা কৌশলে এ সক্ষমতার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
ভারতের পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে ১৩০ থেকে ১৪০টি। ডেলিভারি সিস্টেমের মধ্যে রয়েছে অগ্নি-থ্রি/ফাইভ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (পাল্লা ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার কিলোমিটার), মিরেজ ২ হাজার ও রাফায়েল এবং সামুদ্রিক প্রতিরক্ষায় আইএনএস আরিহান্ট। পারমাণবিক অস্ত্র আগে ব্যবহার না করার (নো ফার্স্ট ইউজ/এনএফইউ) নীতির পক্ষে ভারত। তবে এ ধরনের হামলার শিকার হলে ব্যাপক আকারে প্রতিশোধমূলক হামলার পক্ষে দেশটি।
অন্যদিকে পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা ১৪০ থেকে ১৫০। এদিক থেকে পাকিস্তানের সক্ষমতা ভারতের চেয়ে বেশি। ডেলিভারি সিস্টেমের মধ্যে আছে শাহিন-টু/থ্রি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাত্র, এফ-১৬ যুদ্ধবিমান, বাবর ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র। পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে দেশটি ‘ফুল- স্পেকট্রাম ডেটারেন্স’ নীতি অনুসরণের পক্ষপাতী। এ নীতিতে যুদ্ধক্ষেত্রে দেশটি প্রয়োজনে আগেভাগে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে।
কৌশলগত জোট ॥ ভারতের কৌশলগত জোট রয়েছে ইসরাইল, রাশিয়া ও ফ্রান্সের সঙ্গে। অন্যদিকে পাকিস্তানের রয়েছে চীনের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক। আছে সীমিত পরিসরে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনও।
জনবল, সামরিক ব্যয় ও প্রচলিত অন্যান্য প্রতিরক্ষা খাতে ভারতের এগিয়ে থাকার বিষয়টি স্পষ্ট হলেও পাকিস্তানের সামরিক শক্তিকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। পরমাণু ও কৌশলগত অস্ত্রের সমৃদ্ধ ভা-ার, অপ্রতিসম যুদ্ধকৌশল ও চীনের জোরালো সমর্থন দেশটিকে এক সুবিধাজনক প্রতিরক্ষা অবস্থানে রেখেছে।
প্রতিরক্ষা খাতে ভারতের আধুনিকায়নে অন্যতম বাধা আমলাতন্ত্র। পুরোনো বিমানবহরও দেশটির জন্য একটি বাধা। ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ অভিযানে বেশি মনোযোগও দেশটির আরেক দুর্বলতা। অন্যদিকে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সংগ্রাম, তুলনামূলক ছোট জনশক্তি, পুরোনো সামরিক সরঞ্জাম ও আঞ্চলিক উত্তেজনা তার সামরিক সক্ষমতায় বাধা হয়ে আছে।

×