
ছবি: সংগৃহীত।
হেপাটাইটিস ডি ভাইরাস (HDV)–কে মানবদেহে ক্যানসার সৃষ্টিকারী (কার্সিনোজেনিক) হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং আন্তর্জাতিক ক্যানসার গবেষণা সংস্থা (IARC)। এর ফলে হেপাটাইটিস বি (HBV) ও হেপাটাইটিস সি (HCV)-এর মতোই HDV এখন লিভার ক্যানসারের একটি বড় উৎস হিসেবে গণ্য হচ্ছে।
এই পুনঃশ্রেণিবিন্যাসের পেছনে রয়েছে ক্রমবর্ধমান প্রমাণ, যা দেখায় যে HDV সংক্রমণ গুরুতর লিভার ক্ষতি এবং ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়, বিশেষ করে যেসব রোগী HBV ও HDV-তে একযোগে সংক্রমিত হন। গবেষকেরা বলছেন, এই গুরুত্বপূর্ণ আপডেট থেকে বোঝা যাচ্ছে, HDV সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো, পরীক্ষার সুযোগ প্রসারিত করা এবং উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি।
হেপাটাইটিস ডি ভাইরাস (HDV) কী এবং এর লক্ষণ
HDV একটি ব্যতিক্রমী ও বিপজ্জনক ভাইরাস, যা একা একা সংক্রমণ ঘটাতে পারে না-এটির সংক্রমণ ও বংশবৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন হেপাটাইটিস বি ভাইরাস (HBV)। এই ভাইরাসটি HBV-কে “হাইজ্যাক” করে শরীরে প্রবেশ করে এবং যৌথ সংক্রমণের ফলে লিভারের ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেশি তীব্র হয়ে ওঠে।
HDV সংক্রমণের লক্ষণগুলো অন্যান্য লিভার রোগের সঙ্গে মিলে যেতে পারে, ফলে রোগ প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়ে না। সাধারণ লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে:
অতিরিক্ত ক্লান্তি ও দুর্বলতা, বমিভাব ও ক্ষুধামন্দা, পেটের ডান পাশে ব্যথা বা অস্বস্তি, গা dark-colored urine, চোখ ও ত্বক হলুদ হয়ে যাওয়া (জন্ডিস), ওজন হ্রাস, জ্বর। এসব উপসর্গ অনেক সময় মৃদু বা বিভ্রান্তিকর হওয়ায় অনেকেই দেরিতে চিকিৎসা নেন, যা লিভারের গুরুতর ক্ষতির ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
হেপাটাইটিস ডি কীভাবে ছড়ায়
HDV মূলত সংক্রমিত রক্ত বা শরীরের তরলের মাধ্যমে ছড়ায়। সংক্রমণের সাধারণ মাধ্যমগুলো হলো:
আক্রান্ত রক্ত বা রক্তজাত পণ্য ব্যবহার, অসুরক্ষিত যৌন সম্পর্ক, ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক গ্রহণে ব্যবহৃত সিরিঞ্জ ভাগাভাগি করা, জীবাণুমুক্ত নয় এমন চিকিৎসা উপকরণ ব্যবহারে, মায়ের দেহ থেকে নবজাতকের মধ্যে সংক্রমণ (কম দেখা যায়)।
HDV শুধুমাত্র HBV আক্রান্ত ব্যক্তিকেই সংক্রমিত করতে পারে। ফলে যাদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি হেপাটাইটিস বি রয়েছে, তাদের জন্য HDV একটি গুরুতর ঝুঁকি।
নিম্নোক্ত গোষ্ঠীগুলো HDV সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছেন:
দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা ও আমাজন উপত্যকার মতো উচ্চ হেপাটাইটিস বি সংক্রমণ এলাকায় বসবাসকারী মানুষ, যারা ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক গ্রহণ করেন, যারা রক্ত ডায়ালাইসিস নেন বা নিয়মিত রক্ত সঞ্চালন পান, যাদের একাধিক যৌন সঙ্গী আছে বা অসুরক্ষিত যৌন সম্পর্ক করেন, HDV ও HBV-তে সংক্রমিত মায়েদের নবজাতক। এই ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীর মধ্যে সচেতনতা ও স্ক্রিনিং বাড়ানো জরুরি।
বৈশ্বিক প্রভাব: কতটা ছড়িয়েছে হেপাটাইটিস ডি?
WHO-এর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ৩০ কোটিরও বেশি মানুষ হেপাটাইটিস বি, সি অথবা ডি ভাইরাসে সংক্রমিত, যার ফলে প্রতিবছর প্রায় ১৩ লাখ মানুষ লিভার সিরোসিস বা লিভার ক্যানসারে মারা যান। অনুমান করা হচ্ছে, বিশ্বের প্রায় ১.২ কোটি মানুষ দীর্ঘমেয়াদি হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের পাশাপাশি হেপাটাইটিস ডি ভাইরাসেও আক্রান্ত।
কেন হেপাটাইটিস ডি এতটা বিপজ্জনক?
গবেষণায় দেখা গেছে:
HBV একা সংক্রমিত রোগীদের তুলনায় HDV সহ-সংক্রমিত রোগীদের মধ্যে লিভার ক্যানসারের ঝুঁকি দুই থেকে ছয় গুণ বেশি।
দীর্ঘমেয়াদি HDV রোগীদের প্রায় ৭৫% মানুষ ১৫ বছরের মধ্যে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হন, যা HBV-র একক সংক্রমণের চেয়ে অনেক বেশি।
HDV সংক্রমণে লিভার দ্রুত প্রদাহ ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ফলে জটিলতা ও মৃত্যুঝুঁকি বাড়ে।
হেপাটাইটিস ডি-র বর্তমান চিকিৎসা
যেখানে HBV চিকিৎসার জন্য দীর্ঘমেয়াদি অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ রয়েছে, সেখানে HDV-এর চিকিৎসা এখনো সীমিত, তবে অগ্রগতি হচ্ছে:
Bulevirtide: ইউরোপে অনুমোদিত এই ওষুধটি লিভার কোষে HDV প্রবেশ বন্ধ করতে সাহায্য করে। এটি পেগাইলেটেড ইন্টারফেরনের সঙ্গে ব্যবহার করলে আরও ভালো ফল পাওয়া যায়।
Pegylated Interferon: মাঝে মাঝে HDV প্রতিরোধে ব্যবহৃত হয়, তবে এর কার্যকারিতা ভিন্ন ভিন্ন রোগীর ক্ষেত্রে ভিন্ন হতে পারে।
HDV-র বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট কোন ভ্যাকসিন নেই। তবে হেপাটাইটিস বি-র টিকাই HDV প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর, কারণ HDV সংক্রমণ ঘটাতে HBV প্রয়োজন।
বিশ্বব্যাপী হেপাটাইটিস বি টিকাদান ও পরীক্ষার অগ্রগতি
২০২৫ সালের তথ্য অনুযায়ী:
১২৯টি দেশ গর্ভবতী নারীদের জন্য হেপাটাইটিস বি পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছে (২০২৪ সালে যা ছিল ১০৬টি)
১৪৭টি দেশ নবজাতকদের জন্য হেপাটাইটিস বি টিকার জন্মমাত্র ডোজ সরবরাহ করে (২০২২ সালে যা ছিল ১৩৮টি)
এই উদ্যোগগুলো HBV এবং পরোক্ষভাবে HDV প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ: হেপাটাইটিস ডি মোকাবেলায় করণীয়
WHO-এর ২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিস নির্মূলের লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে নিচের পদক্ষেপগুলো জরুরি:
বিশ্বব্যাপী হেপাটাইটিস বি টিকাদান কভারেজ বৃদ্ধি, হেপাটাইটিস বি পজিটিভ সব রোগীর জন্য HDV স্ক্রিনিং নিশ্চিত করা, নতুন HDV চিকিৎসা ও ওষুধের প্রাপ্যতা বাড়ানো, স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও তথ্য পরিকাঠামো উন্নত করা, হেপাটাইটিস নিয়ে কুসংস্কার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, এসব লক্ষ্য অর্জন করতে পারলে ২০৩০ সালের মধ্যে ২৮ লাখ প্রাণ বাঁচানো ও প্রায় ৯৮ লাখ নতুন সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।
সূত্র: দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া।
মিরাজ খান