
ছবি: সংগৃহীত
সবসময়ই বলা হয়—চোখ হল আত্মার জানালা। কিন্তু আধুনিক গবেষণা বলছে, চোখ হতে পারে হৃদয়ের জানালাও। সাম্প্রতিক সময়ে চিকিৎসক ও গবেষকরা চোখের রেটিনায় থাকা সূক্ষ্ম রক্তনালিগুলোর দিকে বেশি গুরুত্ব দিতে শুরু করেছেন। কারণ এসব রক্তনালিতে দেখা যাওয়া কিছু পরিবর্তন আগাম হৃদ্রোগ বা হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি সম্পর্কে ইঙ্গিত দিতে পারে।
রেটিনা এমন একটি অঙ্গ যা সহজেই মাইক্রোভাসকুলার সিস্টেম বা দেহের অতিক্ষুদ্র রক্তনালির অবস্থা সরাসরি চোখে দেখা যায়—যা হৃদপিণ্ডে সম্ভব নয়। এখানেই মূল বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। রেটিনার রক্তনালিতে যে ক্ষতি দেখা যায়, তা প্রায়শই হৃদপিণ্ড বা মস্তিষ্কের রক্তনালির অবস্থার প্রতিফলন ঘটায়। তাই চোখের অবস্থাই হতে পারে হৃদ্স্বাস্থ্য পরিমাপের একটি কার্যকর উপায়।
উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের মধ্যে হৃদরোগের প্রবণতা অনেক বেশি দেখা যায়। তাই উচ্চ রক্তচাপ থাকলে শুধু রক্তচাপ পরিমাপ করাই যথেষ্ট নয়, বরং “হাইপারটেনশন-মেডিয়েটেড অর্গান ড্যামেজ” (HMOD)—অর্থাৎ রক্তচাপে ক্ষতিগ্রস্ত অঙ্গগুলোর অবস্থাও বুঝে নেওয়া জরুরি। দীর্ঘ সময় উচ্চ রক্তচাপ থাকলে চোখের রক্তনালিতে ক্ষতি হয়, যা “হাইপারটেনসিভ রেটিনোপ্যাথি” নামে পরিচিত। এটি দৃষ্টিশক্তি হ্রাসের ঝুঁকি বাড়ায়।
হাইপারটেনসিভ আই ডিজিজ বলতে উচ্চ রক্তচাপজনিত চোখের বিভিন্ন রোগ বোঝায়। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত রোগ হলো হাইপারটেনসিভ রেটিনোপ্যাথি, যেখানে চোখের রক্তনালিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়াও হাইপারটেনসিভ কোরিওপ্যাথি (রেটিনার রক্তনালির নিচের স্তর আক্রান্ত) এবং হাইপারটেনসিভ অপটিক নিউরোপ্যাথি (চোখের স্নায়ু আক্রান্ত) দেখা দিতে পারে।
গত তিন দশকে গবেষণায় উঠে এসেছে, হাইপারটেনসিভ রেটিনোপ্যাথি কেবল চোখ নয়, শরীরের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ—যেমন হৃদয়, মস্তিষ্ক ও কিডনির অবস্থাও প্রতিফলিত করে। রেটিনার রক্তনালিগুলো সহজেই পর্যবেক্ষণ করা যায় বলে চিকিৎসকরা এটিকে হৃদ্স্বাস্থ্য মূল্যায়নের বিকল্প উপায় হিসেবে দেখছেন।
চোখের ফান্ডাস (পেছনের অংশ) বিশ্লেষণে অ্যাডাপটিভ অপটিক্স ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তির অগ্রগতি চিকিৎসাক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছে। এই প্রযুক্তিগুলো চোখের রক্তনালিতে হাইপারটেনশন-সংক্রান্ত ক্ষতির সূক্ষ্ম লক্ষণ ধরতে সক্ষম, যা হৃদপিণ্ড, কিডনি এবং মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের অবস্থাও জানায়।
রেটিনাল ভেইন অক্লুশন (RVO) চোখের প্রধান শিরা (CRVO) অথবা শাখা শিরা (BRVO) বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে ঘটে। এতে আকস্মিক, ব্যথাহীন ও একচোখে দৃষ্টিশক্তি হঠাৎ কমে যেতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে এটি স্থায়ী অন্ধত্বের কারণও হতে পারে। RVO তে চোখের ফান্ডাস পরীক্ষায় একাধিক রক্তক্ষরণ, রেটিনা ও অপটিক ডিস্কে ফোলা এবং শিরায় ফোলাভাব দেখা যায়। এর জটিলতা হিসেবে দেখা দিতে পারে নিওভাসকুলারাইজেশন ও গ্লুকোমা, যেগুলো দৃষ্টিশক্তির জন্য মারাত্মক হুমকি।
হৃদপিণ্ডের ছোট ছোট রক্তনালি, যা করোনারি সার্কুলেশনের অংশ, সেগুলোর গঠন ও কাজ অনেকটাই চোখের রেটিনার রক্তনালির মতো। গবেষণায় দেখা গেছে, রেটিনায় দেখা যাওয়া ক্ষুদ্র পরিবর্তন—যেমন ফোলাভাব বা ক্ষরণ—দেহের অন্যত্র উচ্চ রক্তচাপ বা ধমনীর সংকোচন (Atherosclerosis) ঘটার ইঙ্গিত হতে পারে।
Journal of the American Medical Association (JAMA)-তে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়, রেটিনায় রক্তনালির পরিবর্তন হৃদ্রোগের পূর্বাভাস দিতে পারে। এমনকি সেই রোগ কতটা গুরুতর হতে পারে তাও অনুমান করা যায়। MESA Study-তেও দেখা গেছে, রেটিনার পরিবর্তনের সঙ্গে হৃদ্পিণ্ডে ক্যালসিয়াম জমা এবং রক্তপ্রবাহজনিত জটিলতার সম্পর্ক রয়েছে।
চোখের একটি সাধারণ পরীক্ষা দিয়েই হৃদ্স্বাস্থ্যের সংকেত পাওয়া সম্ভব। বিশেষ করে যারা উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন, তাদের জন্য নিয়মিত চোখ পরীক্ষা হতে পারে একটি কার্যকর ‘ওয়ার্নিং সিগন্যাল’। কারণ চোখেই লুকিয়ে থাকতে পারে হৃদ্রোগের পূর্বাভাস।
আবির