
ছবিঃ সংগৃহীত
যুক্তরাজ্যের একদল স্বেচ্ছাসেবীর শরীরের ওপর করা এক বিলিয়নেরও বেশি স্ক্যানের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা এখন মানুষের বার্ধক্য প্রক্রিয়া আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বিস্তারিতভাবে বুঝতে পারছেন।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানব চিত্রায়ন গবেষণা প্রকল্প ‘ইউকে বায়োব্যাংক’ সম্প্রতি ঘোষণা করেছে, তারা মস্তিষ্ক, হৃদযন্ত্র এবং অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ১ লক্ষ মানুষের স্ক্যান সম্পন্ন করেছে—এটি এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী ১১ বছরের গবেষণার এক মাইলফলক।
"গবেষকরা ইতোমধ্যেই এই চিত্রায়ন তথ্য এবং আমাদের অন্যান্য তথ্য ব্যবহার করে রোগ আগেভাগে শনাক্ত করার পদ্ধতি তৈরি করছেন, যেন দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা যায়," বলেন ইউকে বায়োব্যাঙ্কের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক নাওমি অ্যালেন।
এই তথ্য বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কাছে স্বল্প মূল্যে উন্মুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে, যাতে হৃদরোগ থেকে ক্যানসারের মতো সাধারণ রোগ প্রতিরোধে নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করা যায়।
প্রকল্পের ১ লক্ষতম স্বেচ্ছাসেবক ছিলেন দক্ষিণ ইংল্যান্ডের স্টিভ (পুরো নাম প্রকাশ করা হয়নি), যিনি সদ্য অবসর নিয়ে মেয়ের পরিচালিত একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন।
বিবিসি দেখতে পায়, কীভাবে তিনি রিডিং শহরের এক শিল্প পার্কে অবস্থিত একটি পূর্ণদেহ এমআরআই স্ক্যানারে প্রবেশ করেন এবং তার মস্তিষ্ক, রক্তনালি, হাড় ও অস্থিসন্ধির বিশদ ছবি স্ক্রিনে ভেসে ওঠে।
"আমার মা কয়েক বছর আগে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হন। সেজন্যই আমি চাই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন আমার মতো মানুষের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে পারে," বলেন স্টিভ।
ইউকে বায়োব্যাংক কী?
২০০৩ সালে শুরু হওয়া ইউকে বায়োব্যাংক বিশ্বের বৃহত্তম জীববৈজ্ঞানিক নমুনা ও স্বাস্থ্য তথ্যভাণ্ডারগুলোর একটি।
এ পর্যন্ত মোট ৫ লাখ মধ্যবয়সী স্বেচ্ছাসেবককে শারীরিক পরীক্ষার পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও জীবনধারাভিত্তিক প্রশ্নপত্র পূরণ করতে বলা হয়েছে, এবং তাদের ডিএনএ ও অন্যান্য জৈবিক নমুনা (রক্ত, প্রস্রাব, লালা) সংগ্রহ করা হয়েছে।
এই নমুনাগুলো গ্রেটার ম্যানচেস্টারের স্টকপোর্ট শহরে -৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষিত রয়েছে।
২০১৪ সাল থেকে শুরু হওয়া চিত্রায়ন প্রকল্পে এ পর্যন্ত স্ক্যান করা হয়েছে ১ লক্ষ স্বেচ্ছাসেবককে, যাদের শরীরের পাঁচটি অংশের উপর MRI, এক্স-রে ও আল্ট্রাসাউন্ড প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিশদ চিত্র সংগ্রহ করা হয়েছে।
এই স্ক্যান করা স্বেচ্ছাসেবকদের আগামী বছরগুলোতে আবার ডাকা হবে, যাতে তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করা যায়।
প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক প্রভাব
ওয়েস্টমিনস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লুইস থমাস বলেন, "আগে ভাবতাম এত মানুষকে স্ক্যান করা অসম্ভব। কিন্তু এখন আমরা পুরো শরীরের ডেটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিশ্লেষণ করতে পারছি, কয়েক মিনিটেই।" এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে এই বিপুল পরিমাণ তথ্য বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।
২০০৩ সাল থেকে ইউকে বায়োব্যাঙ্কের সবধরনের তথ্য ব্যবহার করে প্রায় ১,৭০০টি পিয়ার-রিভিউড গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে, এবং প্রতি সপ্তাহেই নতুন গবেষণা প্রকাশ পাচ্ছে।
এই স্ক্যান ও ডেটাগুলোর ব্যবহার ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল দিয়েছে, যেমন:
MRI ও অন্যান্য স্বাস্থ্য তথ্য মেলালে ৩৮টি সাধারণ রোগ আগেভাগে শনাক্ত করা সম্ভব।
প্রতিদিন অল্প পরিমাণ অ্যালকোহল সেবন করলেও স্মৃতিভ্রংশের ঝুঁকি বাড়ে।
একটি বিস্তারিত MRI স্ক্যান দিয়ে যকৃতের এক সাধারণ রোগ শনাক্ত ও পর্যবেক্ষণ করা যায়, যেখানে আগে অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হতো।
হৃদযন্ত্রের গঠনে পরিবর্তন মানসিক রোগ যেমন ডিপ্রেশনের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
গোপনীয়তা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা
এই প্রকল্পে অংশ নেওয়া স্বেচ্ছাসেবকদের তথ্য সম্পূর্ণভাবে গোপন রাখা হয়। তাদের নাম বা ঠিকানা প্রকাশ করা হয় না।
বায়োব্যাংকের তথ্য ৩০ পেটাবাইটেরও বেশি (৩০,০০০ টেরাবাইট)। গবেষণা কাজে ব্যবহারের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়, দাতব্য সংস্থা, সরকার ও বেসরকারি খাতে যারা আবেদন করে, তাদের কাছে ৩,০০০ থেকে ৯,০০০ পাউন্ডের বিনিময়ে ডেটা দেওয়া হয়, যা মূলত পরিচালন ব্যয় কভার করে।
যুক্তরাজ্যের বাইরেও জার্মানি, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের বড় স্বাস্থ্য তথ্য প্রকল্প রয়েছে, তবে ইউকে বায়োব্যাংকের মতো এভাবে বৈশ্বিক গবেষকদের জন্য উন্মুক্ত নয় সবকিছু।
অর্থায়ন
এই প্রকল্পের অর্থায়ন করেছে যুক্তরাজ্যের মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল, ওয়েলকাম ট্রাস্ট, স্বাস্থ্য বিভাগ, স্কটিশ সরকার এবং আরও কয়েকটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান।
চিত্রায়ন অংশটি আরও অর্থায়ন পেয়েছে ব্রিটিশ হার্ট ফাউন্ডেশন, গুগলের মূল প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেটের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ক্যালিকো, এবং ফেসবুক প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ ও তার স্ত্রী প্রিসিলা চ্যানের 'চান জাকারবার্গ ইনিশিয়েটিভ'-এর পক্ষ থেকেও।
সূত্রঃ বিবিসি
নোভা