
আজকাল তরুণদের মধ্যেও উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন বেড়ে চলেছে, যার পেছনে রয়েছে মানসিক চাপ, অতিরিক্ত সোডিয়াম গ্রহণ ও ঘুমের অভ্যাসের মতো বিষাক্ত সংমিশ্রণ। এই ত্রিমুখী হুমকি নীরবে রক্তচাপ বাড়ায় যা একসময় হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক কিংবা কিডনির জটিলতায় রূপ নেয়। অথচ জীবনযাপনে কিছু ছোট ছোট পরিবর্তন যেমন, স্ট্রেস কমানো, লবণ নিয়ন্ত্রণে রাখা ও ঘুমকে অগ্রাধিকার দেওয়া এই রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে অনেকটাই সহায়তা করতে পারে।
জেনেটিক্স নয়, জীবনযাপনই দায়ী
রোগটা কেবল বংশগত নয়। গল্পটা অনেকেরই পরিচিত,মা উচ্চ রক্তচাপে ভোগেন, বাবা প্রতিদিন ওষুধ খান, আর এখন ডাক্তার আপনার দিকে তাকিয়ে বলছেন, “চাপটা একটু নজরে রাখবেন।” আপনি হাসপাতাল থেকে একটা লিফলেট হাতে পান,খাদ্যাভ্যাস পাল্টাতে হবে, লবণ কমাতে হবে। বয়স ৩৫ বা ৪৫,এখনই এসবের চিন্তা করতে হবে, ভাবতেই অবাক লাগতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, হাইপারটেনশন এখন বয়সের অপেক্ষা করে না। কর্মব্যস্ততা আর গভীর রাতে স্ক্রিনে চোখ রেখে দিন পার করার মধ্যেই চাপ জমে উঠছে রক্তে।
আমেরিকার প্রায় অর্ধেক প্রাপ্তবয়স্কই উচ্চ রক্তচাপে ভোগেন, অথচ তাদের অনেকেই তা জানেন না। অনেকে ভাবেন,লবণতোলা না হলে বা অতিরিক্ত চিন্তায় না থাকলে বুঝি বিপদ নেই। কিন্তু হাইপারটেনশন চুপিসারে আসে। মাথাব্যথা বা হৃদস্পন্দনের মতো স্পষ্ট লক্ষণ না-ও থাকতে পারে। যখন সেটা দেখা দেয়,তখন তা স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক বা কিডনির সমস্যার রূপ নেয়। তখন হয়তো অনেক দেরি হয়ে যায়।
ত্রিমুখী বিপদের নেপথ্যে কী?
এটা কেবল লবণের কারণে নয়, কেবল স্ট্রেস নয়, কেবল ঘুমের ঘাটতিও নয়,এই তিনটি একসঙ্গে যখন কাজ করে, তখন তা হয়ে ওঠে ভয়াবহ। এই 'টক্সিক ট্রায়ো' আমাদের রক্তচাপকে প্রতিদিন একটু একটু করে হুমকির দিকে ঠেলে দেয়।
স্ট্রেসে কেবল মন নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় হৃদপিণ্ডও
আজকের দিনে কর্মজীবী মানুষেরা প্রচণ্ড মানসিক চাপে রয়েছেন। কাজের অনিশ্চয়তা, মূল্যস্ফীতি, পরিবার ও কর্মক্ষেত্রের দায়িত্বে ক্লান্ত মস্তিষ্ক সারাক্ষণ ‘চলতে হবে’ সিগন্যাল দেয়। কিন্তু আমাদের হৃদযন্ত্র এতটা চাপ নিতে প্রস্তুত নয়।
স্ট্রেস হলেই শরীর “ফাইট অর ফ্লাইট” মোডে চলে যায়,যার ফলে অ্যাড্রেনালিন ও কর্টিসল বেড়ে যায়, রক্তনালীর সংকোচন হয়, হৃৎস্পন্দন বাড়ে। যেন আপনি কোনো হিংস্র পশুর সামনে পড়েছেন অথচ আপনি হয়তো বসে বসে ইমেইলের জবাব দিচ্ছেন।
এই বাড়তি চাপ যদি নিয়মিত হয়, তাহলে রক্তনালী শক্ত হয়ে যায়, হৃদয়কে বাড়তি পরিশ্রম করতে হয়। ফলে দীর্ঘমেয়াদে উচ্চ রক্তচাপের আশঙ্কা বাড়ে। আর সত্যি কথা হলো আমরা এই স্ট্রেসকে মোকাবিলা করি জাঙ্ক ফুড, মদ্যপান, অলসতা, কিংবা স্ক্রিনে ডুবে থাকার মতো হৃদয়বিধ্বংসী অভ্যাস দিয়ে।
লবণ: যতটুকু দরকার, তার বহু গুণ বেশি খাচ্ছেন আপনি
লবণ কম খেতে হবে এই উপদেশ অনেকবার শুনেছেন। কিন্তু বর্তমান খাদ্যতালিকায় এমনকি ব্রেকফাস্ট সিরিয়াল, সালাদ ড্রেসিং বা ‘হেলদি’ বার্গারেও সোডিয়াম লুকিয়ে থাকে। একজন আমেরিকান গড়ে দিনে ৩৪০০ মিলিগ্রাম সোডিয়াম খান যেখানে সুপারিশকৃত মাত্রা ২৩০০ মিলিগ্রাম।
আর মজার ব্যাপার এই সোডিয়ামের বেশিরভাগই আসে প্যাকেটজাত খাবার থেকে, টেবিলের লবণদানি থেকে নয়। সোডিয়াম শরীরে পানি ধরে রাখে,ফলে রক্তনালীর ভেতর রক্তের পরিমাণ বাড়ে এবং চাপও বাড়ে। এভাবে হার্টকে বেশি কাজ করতে হয়।
যদিও সবাই সমানভাবে লবণ সংবেদনশীল নন, কারও কারও রক্তচাপ লবণে দ্রুত বাড়ে। তাই নিজে কতটা সংবেদনশীল তা না জানা থাকলে নিরাপদ পথ হলো প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলা ও ঘরে রান্না করা।
ঘুম: বিলাসিতা নয়, ওষুধ
তৃতীয় অপরাধী ঘুমের ঘাটতি। মাত্র ৪ ঘণ্টা ঘুমিয়েছেন? বাহ, আপনি হয়তো নিজেকে কর্মঠ মনে করছেন। কিন্তু আসলে তা একেকটা স্বাস্থ্যবিপর্যয়ের বোমা।
ঘুমের সময় রক্তচাপ স্বাভাবিকভাবে কিছুটা কমে যা হার্ট ও রক্তনালীর জন্য বিশ্রামের সুযোগ। কিন্তু ঘুম কম হলে, বা ঘুমের মান খারাপ হলে (যেমন স্লিপ অ্যাপনিয়া বা রাতজাগা) এই স্বাভাবিক ‘ডিপ’ আর হয় না। ফলাফল: ‘নন-ডিপিং হাইপারটেনশন’ যেটা স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা বহুগুণ বাড়ায়।
এছাড়াও কম ঘুম কর্টিসল ও ইনসুলিন হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে, দেহে ইনফ্লেমেশন বাড়ায়, সিম্প্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেমকে উত্তেজিত করে। এই সমস্তই রক্তচাপ বাড়ায়, এমনকি অন্য কিছু ঠিক থাকলেও।
ত্রিমুখী বিপদের ভয়াবহতা
এই তিনটি স্ট্রেস, লবণ ও ঘুমের অভাব।আলাদাভাবে বিপজ্জনক, কিন্তু একসঙ্গে হয়ে গেলে তা হয়ে ওঠে চক্রাকারে ধ্বংসাত্মক। স্ট্রেস আপনাকে বাড়তি লবণ খেতে বাধ্য করে। অতিরিক্ত লবণ ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায়। কম ঘুম স্ট্রেস বাড়িয়ে দেয়। এই চক্র প্রতিদিন কোটি কোটি মানুষের মধ্যে ঘুরে চলেছে।
আর সবচেয়ে ভয়ের বিষয় হলো, এই বিপদ অনেক সময় চোখে পড়ে না। আপনি ভাবছেন আপনি স্ট্রেসে নেই, অথচ শরীর ফাইট-অর-ফ্লাইট মোডে আছে। আপনি ভাবছেন আপনি ঘুমিয়েছেন, অথচ সকালে ক্লান্ত হয়ে উঠছেন। আপনি ভাবছেন আপনি লবণ খান না, অথচ খাদ্যের লেবেল কখনো পড়েন না।
বিশেষজ্ঞদের সতর্ক বার্তা
ডা. সঞ্জীব চৌধুরী বলেন, “হাইপারটেনশনের পেছনে মূল তিনটি কারণলবণ, ঘুম ও স্ট্রেস। তরুণ কর্পোরেটদের মধ্যে ঘুমের সময় কমে যাওয়ায় তাদের দেহঘড়ি বিঘ্নিত হচ্ছে, যার ফলে রক্তচাপ বেড়ে যাচ্ছে। স্ট্রেস আবার ঘুমকেও নষ্ট করে এবং হৃদরোগের জন্য ক্ষতিকর হরমোন বাড়িয়ে দেয়। এর সঙ্গে ধূমপান যুক্ত হলে ঝুঁকি আরও বাড়ে। একসময় তা হার্ট, কিডনি এবং চোখের মারাত্মক ক্ষতি করে।”
ডা. গৌরব গুপ্ত, সিনিয়র সাইকিয়াট্রিস্ট বলেন, “স্ট্রেস, অতিরিক্ত লবণ ও খারাপ ঘুম একটি ভয়ানক ত্রিভুজ, যা নীরবে উচ্চ রক্তচাপ বাড়িয়ে তোলে। দীর্ঘমেয়াদি স্ট্রেস দেহকে স্থায়ী উত্তেজনায় রাখে। লবণ রক্তনালীর ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করে। অপর্যাপ্ত ঘুম আবার দেহের স্বাভাবিক রিকভারি প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। তাই এই তিনটিকে নিয়ন্ত্রণ করাই হৃদয় ও মানসিক সুস্থতার প্রথম পদক্ষেপ।”
কীভাবে রক্ষা পাবেন?
না, শুধু যোগা বা সবুজ স্মুদি দিয়ে হাইপারটেনশন দূর হবে না। কিন্তু সত্যি হলো ছোট ছোট পরিবর্তনই বড় ফল দেয়।স্ট্রেস কমানোর মানে নিজেকে গুরুর মতো শান্ত করা নয়, বরং এমন অভ্যাস তৈরি করা যা কর্টিসলের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে হাঁটাহাঁটি, গান শোনা, না বলা শেখা।
লবণ কম মানে চিপস ছেড়ে দেওয়া নয় বরং খাবারের লেবেল পড়া, ঘরে রান্না করা, প্রক্রিয়াজাত খাবারের বদলে আসল খাবার বেছে নেওয়া।
ঘুম ঠিক রাখার মানে নিখুঁত হওয়া নয়, বরং তাকে অগ্রাধিকার দেওয়া। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে শোয়া, অন্ধকার ও ঠান্ডা ঘরে ঘুমানো, ঘুমানোর এক ঘণ্টা আগে স্ক্রিন বন্ধ করা এসবেই পার্থক্য আসে।
উচ্চ রক্তচাপ শুধু একটি সংখ্যা নয়। এটি শরীরের সতর্ক ঘণ্টা। যখন শরীর ফিসফিস করে কিছু বলতে চায় তার আগে শুনুন। কারণ একবার যখন শরীর চিৎকার করে ওঠে, তখন হয়তো অনেক দেরি হয়ে গেছে।
লাইফস্টাইল বদল অবশ্যই জরুরি, তবে তা চিকিৎসকের পরামর্শে করা উচিত। স্ট্রেস মোকাবিলার স্বাস্থ্যকর উপায় যেমন মনোযোগচর্চা, ব্যায়াম, থেরাপি এসব চর্চা করতে হবে। লবণ কম খাওয়া ও প্রতিরাতে ৭–৮ ঘণ্টা ঘুম উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে বড় ভূমিকা রাখতে পারে,” বলেন ডা. আস্তিক জোশী।
এককালে হাইপারটেনশন ভাবা হতো বয়স্কদের রোগ। এখন তা হয়ে গেছে সবার সমস্যা। এটা শুধু জিনগত নয়, জীবনযাপনের প্রতিক্রিয়া। তাই আলাদা করে লবণ, স্ট্রেস বা ঘুম নয় তাদের মিলিত প্রভাবকে বুঝে নিয়ন্ত্রণ করাই একমাত্র পথ।
সূত্র:https://tinyurl.com/2uwext6r
আফরোজা