ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০১ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২

যৌন রোগ প্রতিরোধে সচেতনতা ও চিকিৎসা

জ ই বুলবুল

প্রকাশিত: ০০:৫৯, ৫ মার্চ ২০২৪

যৌন রোগ প্রতিরোধে সচেতনতা ও চিকিৎসা

আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে যৌনতা সম্পর্কে রয়েছে ভ্রান্তধারণা

(আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে যৌনতা সম্পর্কে রয়েছে ভ্রান্তধারণা। অথচ সুস্থ সমাজ গঠনে এ বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে হয়; নিজের এবং বিপরীত লিঙ্গের শরীর সম্পর্কে স্বাভাবিকভাবে জানতে হয়। এ জন্য প্রয়োজন যৌনশিক্ষার। নইলে আক্রান্ত হতে হয় নানা ধরনের জটিল রোগে। পুরুষ ও নারীর যৌনরোগ এবং তা থেকে পরিত্রাণের উপায় নিয়ে কথা হয় সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হেয়ার ট্রান্সপ্ল্যান্ট সার্জন, চর্ম ও যৌনরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. জাহেদ পারভেজের সঙ্গে। জনকণ্ঠ সাপ্তাহিক মঙ্গলবার স্বাস্থ্য পাতার আপনার ডাক্তারের পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- জ ই বুলবুল

আপনার ডাক্তার  : যৌনরোগ কী এবং কীভাবে তা ছড়িয়ে পড়ে?।
ডা.জাহেদ পারভেজ : এ রোগ হওয়ার অন্যতম কারণ দৈহিক মিলন বা যৌন সম্পর্ক। যৌনরোগে আক্রান্ত সঙ্গীর মাধ্যমে মূলত এ রোগ একজন থেকে অন্যজনে ছড়িয়ে পড়ে। যৌন সম্পর্কের মাধ্যমেই গনোরিয়া, সিফিলিস, ক্লামাইডিয়া, হার্পিস, এইচআইভি-এইডস, হেপাটাইটিস-বি. সি এবং ডি রোগে  আক্রান্ত হয়ে পড়ে মানুষ ।

তবে অনেক সময় কিছুটা ভিন্নভাবেও ছড়াতে পারে। যৌনরোগ হলে শরীরের বিভিন্ন অংশে সংক্রমণ (ইনফেকশন) হতে পারে। যেমন- সিফিলিস ও গনোরিয়া হলে যৌনাঙ্গে ঘা হয়। একই সঙ্গে স্নায়ুতন্ত্র, হৃৎপি-, চামড়া, গর্ভজাত শিশুও এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। আবার এইডস, হেপাটাইটিস-বি, সি এবং ডি নামে কিছু যৌনবাহিত রোগ আছে। এসব রোগ হলে যৌনাঙ্গে অসুখ হয় না। কিন্তু শরীরের অন্যান্য স্থানে সমস্যা বা লক্ষণ দেখা দেয়। এ রোগগুলো

যৌনমিলন ছাড়াও একজন থেকে অন্যজনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে। যেমন- যৌনরোগ হয়েছে, এমন ব্যক্তির রক্ত বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অন্যজনের দেহে দেওয়া হলে কিংবা প্রতিস্থাপিত হলে, যৌনরোগীর ব্যবহৃত সুচ ও সিরিঞ্জ জীবাণুমুক্ত না করে অন্যজনের দেহে পুশ করলে, যৌনরোগ সংক্রমিত গর্ভবতী মায়ের কাছ থেকে গর্ভাবস্থায়, প্রসবের সময় বা বুকের দুধের মাধ্যমে শিশুর মধ্যেও এ রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে।
আপনার ডাক্তার :  মা যদি যৌনরোগে আক্রান্ত হয়, তা হলে তার সন্তান কোন্ কোন্ ধরনের জটিলতায় ভুগতে পারে?
ডা. জাহেদ পারভেজ : না যদি এইডস ও হেপাটাইটিস-বি’এর মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হয় এবং তার কোনো ধরনের চিকিৎসা করা না হয়, তাহলে মায়ের কাছ থেকে সন্তান পেটে থাকা অবস্থায়, সন্তান জন্মের সময় বা জন্ম হওয়ার পরে নবজাতকও এসব রোগে আক্রান্ত হতে পারে। সিফিলিস, গনোরিয়া রোগ সংক্রমণে নবজাতকের চোখে ইনফেকশন (কনজাঙ্কটিভাইটিস) হতে পারে। তাই কোনো মা যদি যৌনবাহিত কোনো রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তার উচিত সময়মতো যৌনরোগের চিকিৎসা করানো।
আপনার ডাক্তার : এ রোগে আক্রান্ত হলে রোগীর দেহে বিশেষ কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় কি?
ডা. জাহেদ পারভেজ : অনেক সময় যৌনরোগ থাকলেও শরীরে কোনো লক্ষণ বা সমস্যা দেখা দেয় না। সমস্যা না থাকায় যার যৌনরোগ আছে, তিনি নিজেও বুঝতে পারেন না তার এ রোগ হয়েছে। অনেকে আবার যৌনরোগের লক্ষণগুলো ভালোভাবে জানেন না। তাই যৌনরোগ হলে বুঝতেও পারে না। এ অবস্থায় তার সঙ্গে যৌনমিলন হলে যৌনরোগ তার কাছ থেকে অন্যজনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।

কিছু কিছু যৌনরোগের লক্ষণ যেমন- ক্লামাইডিয়া রোগ হলে রোগীর যোনি ও পুরুষাঙ্গ থেকে অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ হবে। গনোরিয়া ও ক্লামাইডিয়া রোগ সাধারণত একই সঙ্গে হতে পারে। যোনি বা পুরুষাঙ্গ  থেকে অস্বাভাবিক ক্ষরণ, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়াসহ বিভিন্ন লক্ষণ দেখা দিতে পারে। হার্পিস রোগের লক্ষণ প্রথম দিকে বোঝা বড় কঠিন। এটি যৌনাঙ্গে হয়ে থাকে। এটি একটি বিশেষ ধরনের ভাইরাস।

যৌনাঙ্গে ছোট ছোট ফোসকার মতো র‌্যাশ এ রোগের লক্ষণ। ফোসকা ওঠার বেশ কয়েক ঘণ্টা আগে থেকে চুলকানি অনুভূত হয় যৌনাঙ্গে। একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর এ র‌্যাশগুলো বাড়তে থাকে। যৌনাঙ্গ ও পায়ুপথের আশপাশে আঁচিলের মতো র‌্যাশ ওঠাও এক ধরনের যৌনরোগ। এক সঙ্গে অনেক আঁচিল দেখা দেয়।
হিউমান প্যাপিলোমা ভাইরাস, যা সার্ভাইক্যাল ক্যানসারের কারণ এবং যৌন সংসর্গে এক শরীর থেকে অন্য শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। সিফিলিস হলে যৌনাঙ্গ, পায়ু ও মুখে আলসার হয়। আক্রান্ত হতে পারে চোখ ও মস্তিষ্কও। প্রাথমিক অবস্থায় এ রোগের লক্ষণ শরীরে চট করে ধরা পড়ে না। হেপাটাইটিস-বি রোগটিও যৌন সংসর্গের কারণে ছড়ায়।

একইভাবে ছড়াতে পারে হেপাটাইটিস-এ এবং হেপাটাইটিস-সি; তবে তার সংখ্যা খুব কম। লিভার সংক্রান্ত জটিলতা, প্রস্রাবের রঙ পরিবর্তন, বমিভাব ইত্যাদি এ রোগের লক্ষণ হতে পারে। এইচআইভি ভাইরাস মরণ নয়। কিন্তু এ রোগের মূল লক্ষণ শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা ভেঙে যাওয়া।
তাই এই ভাইরাস শরীরে থাকলে অন্য যে কোনো কঠিন রোগ হলে তা মারাত্মক আকার ধারণ করে। ট্রাইকোমোনিয়াসিস নামক যৌনরোগের লক্ষণ হলো যৌনাঙ্গ থেকে অস্বাভাবিক ক্ষরণ, যৌন ক্রিয়ার সময় যৌনাঙ্গে যন্ত্রণা এবং প্রস্রাবের সময় যন্ত্রণা ইত্যাদি। ব্যাকটেরিয়াল ভ্যাজাইনোসিস রোগের লক্ষণ হলো- যোনি থেকে নিঃসরণে দুর্গন্ধ বের হবে। অন্যান্য রোগের তুলনায় এ রোগ অবশ্য খুব সহজেই সেরে যায়।
আপনার ডাক্তার : তাহলে এসব রোগের চিকিৎসা কী?
ডা.জাহেদ পারভেজ : এসব রোগ প্রতিরোধে সচেতনতা এবং প্রতিরোধই মূল চিকিৎসা। শারীরিক মানসিক অক্ষমতা হলেও চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে রাখা ভালো। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছাড়া যত্রতত্র মেডিসিন খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। সচেতন হয়ে  রোগের বিস্তার রোধ করতে হবে।

আর যদি রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়, সঙ্গে সঙ্গে চর্ম ও যৌন রোগ  চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে এবং চিকিৎসকের নির্দেশনা মতোই ওষুধ সেবন করতে হবে। তাহলেই যৌনরোগের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
আপনার ডাক্তার : তাহলে কোন্ কোন্ বিষয়ে সচেতন হলে যৌনরোগ থেকে দূরে থাকা সম্ভব? 
ডা.জাহেদ পারভেজ : সম্পর্কে তরুণদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে এ রোগ সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের ধারণা দিতে হবে। আক্রান্তরা যাতে সহজেই চিকিৎসা পায়, তা-ও নিশ্চিত করতে হবে। সঙ্গী বা সঙ্গিনী যে-ই আক্রান্ত হোক না কেন, উভয়ের ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয় ও একই সঙ্গে চিকিৎসা নিতে হবে। নিরাপদ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে সঙ্গম করতে হবে। এ কথা সবার জানা থাকা প্রয়োজন যে, কনডম সব যৌনরোগ প্রতিরোধে সক্ষম নয়।

তাই যারা বহুগামিতায় বিশ্বাস করেন, তাদের প্রতিহত করতে হবে এবং যৌন রোগের ভয়াবহতা সম্পর্কে জ্ঞান দিতে হবে। অপরের দাঁত মাজার ব্রাশ ও দাঁড়ি কাটার ব্লেড ব্যবহার করা উচিত নয়। রক্ত গ্রহণ বা প্রদানের আগে এইডস, হেপাটাইটিস-বি ও সিফিলিসের পরীক্ষা করাতে হবে। সংক্রমণ পাওয়া গেলে সে রক্ত গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে। শিরাপথে মাদকদ্রব্য গ্রহণ নিবৃত্ত করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। সর্বোপরি ধর্মীয় চেতনা জাগ্রত করতে হবে এবং নৈতিকতার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাবা-মাকে বিশেষ ভূমিকা নিতে হবে। 
আপনার ডাক্তার : আপনার ডাক্তার  থেকে আপনাকে ধন্যবাদ।
আপনাকে ও সময়ের আলোচিত দৈনিক জনকণ্ঠের ‘আপনার ডাক্তার’কেও ধন্যবাদ।

×