
বাচ্চাদের পঙ্গুত্বে
পোলিও ভাইরাসের কারণে ইনফেকশাস জাতীয় যে রোগটি হয়, তাকে বলা হয় পোলিও। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় তার আরেকটি নাম পোলিওমাইলাইটিস। সংক্ষেপে সহজ করে বলা হয় পোলিও। মাইলাইটিস মানে স্পাইনাল কর্ডের প্রদাহ। আর পোলিও ভাইরাসের কারণে শরীরের স্পাইনাল কর্ড সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়। স্পাইনাল কর্ড হল শরীরের স্নায়ুতন্ত্রের একটি অংশ।
নার্ভ বা স্নায়ু মাইলিন নামক একটি আবরণ দ্বারা আবৃত থাকে এবং এই মাইলিনের কাজ স্নায়ুর মধ্যে দিয়ে স্নায়ু সংবেদনটি এক অংশ থেকে আরেক অংশে পৌঁছান। পোলিও আক্রান্ত হলে এটি স্পাইনাল কর্ড এমনকি ব্রেনেরও স্নায়ু কোষের মাইলিনকে আক্রমণ করে সংবেদন পৌঁছান কাজকে বাধা দেয়, আর তাতে শরীরে দেখা দেয় প্যারালাইসিস। শরীরের নার্ভগুলো ঠিকমতো কাজ না করলে পেশিগুলো ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। এমনকি কিছু কিছু প্যাশেন্টের ক্ষেত্রে ফুসফুস চালনার মাসলগুলো প্যারালাইজড হয়ে মৃত্যুবরণ করতে পারে।
পোলিও ভাইরাস এক ধরনের এন্টারোভাইরাস। ১৯০৯ সালে অস্ট্রিয়ান দুজন ডাক্তার কার্ল ল্যান্ডস্টেইনার এবং এরউইন প্রপার প্রথম আলাদাভাবে পোলিও ভাইরাসকে চিহ্নিত করেন। ১৯৮১ সালে পোলিও ভাইরাসের পূর্ণাঙ্গ জেনেটিক গঠন বের করা সম্ভব হয়। ভাইরাসের জেনেটিক কোড বোঝার ক্ষেত্রে এই পোলিও ভাইরাস এক সময় সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছিল।
পোলিও ভাইরাসের ইনকুবেশন পিরিয়ড এক সপ্তাহ থেকে তিন সপ্তাহ। ইনকুবেশন পিরিয়ড মানে হল শরীরে কোন জীবাণু ঢোকার সময় থেকে সিম্পটম প্রকাশ করার সময় সীমা।
এটি সচরাচর পাঁচ বছরের নিচের বয়সের বাচ্চাদের বেশি হয়ে থাকে। শরীরের নার্ভাস সিস্টেমকে আক্রমণ করে প্যারালাইজড করা থেকে শুরু করে পঙ্গুত্ব, অনেক সমস্যাই পোলিওর কারণে হয়ে থাকে।
এটি সহজে একজন থেকে আরেকজনের মধ্যে ছড়াতে পারে। বিশেষ করে কেউ পোলিও আক্রান্ত হলে তার পায়খানা দিয়ে সহজে জীবাণু কিন্তু ছড়াতে পারে। আক্রান্তের শরীরের গলায় এবং অন্ত্রে জীবাণুটি থাকে।
তাই কাশি দিলে অথবা যেখানে-সেখানে কফ ফেললে তার থেকে বেরিয়ে আসা ড্রপলেট ছড়িয়ে অন্যকে সহজে আক্রান্ত করতে পারে এবং সেই সঙ্গে অন্ত্রে থাকার কারণে পায়খানা দিয়ে জীবাণুটি অতি সহজে ছড়ায়। এমনকি আক্রান্তের শরীর ভাল হয়ে গেলেও জীবাণুটি অনেকদিন পর্যন্ত, প্রায় ২০ সপ্তাহ পর্যন্ত অন্ত্রের থেকে গিয়ে পায়খানার মধ্য দিয়ে ছড়াতে পারে।
দুই-তৃতীয়াংশ আক্রান্তের শরীরে শুরুতে পোলিও কোন সিমটম প্রকাশ করে না। এক তৃতীয়াংশের শরীরে জ্বর গলাব্যথা, মাথাব্যথা, ঘাড় নাড়াতে না পারা, সারা শরীরজুড়ে ব্যথা করা এমন সবকিছু সমস্যাসহ আরও কিছু সমস্যা দেখা দেয়। সচরাচর লক্ষণ উপসর্গগুলো কারও ক্ষেত্রে তিন থেকে পাঁচ দিন, কারও ক্ষেত্রে এক সপ্তাহ থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে নিজে নিজে চলে যায়।
তবে অল্প কিছুসংখ্যক আক্রান্তের দেহে সমস্যাটি মারাত্মক আকার ধারণ করে। বিশেষ করে শরীরের স্পাইনাল কর্ড এবং ব্রেন পোলিও ভাইরাসের তারা আক্রান্ত হলে সমস্যা তখন মারাত্মক হয়ে ওঠে।
পোলিও ভাইরাসের দ্বারা আক্রান্ত পোলিও রোগের অস্তিত্ব পাস থেকে তিন হাজার বছর আগেও ছিল বলে ধারণা করা হয়। বিশেষ করে ইজিপশিয়ানদের মাঝে এই রোগ ছিল বলে তাদের তৈরি আঁকা দেয়াল চিত্রের মধ্যে তার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। রোগটির কারণ আবিষ্কার করতে না পারলেও ১৭৮৯ সালে ব্রিটিশ চিকিৎসক মাইকেল আন্ডার উড লোকটিকে আলাদা একটি সমস্যা হিসেবে প্রথম চিহ্নিত করেন। তার প্রায় ১০০ বছর পরে রোগের কারণ হিসেবে পোলিও ভাইরাস আবিষ্কৃত হয়।
পোলিও ভাইরাস আক্রান্ত হলে আক্রান্তের শরীরে রোগের কিছু উপসর্গ, পায়খানা পরীক্ষা, অথবা গলা থেকে সোয়াব নিয়ে ল্যাবে পরীক্ষা করেই নিশ্চিত হওয়া যায় ভাইরাস এর অস্তিত্ব। সঙ্গে রক্তের ভাইরাসটি এর এ্যান্টিবডি খুঁজে পেলে শরীরে ভাইরাসের উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায়। কখনও কখনও আক্রান্তের সেরিব্রাল স্পাইনাল ফ্লুয়িড বের করে তার প্রোটিন লেভেল এবং সাদা রক্ত কণিকার বেড়ে যাওয়া থেকে পোলিও নিশ্চিত করা হয়।
পোলিও আক্রান্ত হলে এর সরাসরি তেমন একটা চিকিৎসা নেই, সিমতম্যেটি কিছু সাপোর্ট ট্রিটমেন্ট ছাড়া। সঙ্গে একবার পোলিও আক্রান্ত হয়ে সিরিয়াস হয়ে গেলে, বিশেষ করে প্যারালাইসিসের দিকে গেলে, পূর্ণাঙ্গ নিরাময় এ তেমন কোন চিকিৎসা নেই। তাই আগে থেকে পোলিও ভ্যাকসিন দেয়ার মাধ্যমে ভাইরাসের আক্রমণ থেকে শরীরকে রক্ষা করার প্রস্তুতি তৈরি করে রাখা হয়।
বিশ শতকের প্রথমার্ধে সবচেয়ে বেশি শিশু মারা যাবার অথবা পঙ্গুত্ববরণ এর পেছনে অন্যতম একটি কারণ ছিল এই পোলিও। ১৯৫০ সালে আমেরিকান চিকিৎসক উইলিয়াম হেমন পিটসবার্গ ইউনিভার্সিটিতে পোলিও ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেন এবং তারপর থেকে বর্তমান পর্যন্ত এশিয়া ছাড়া আর সবগুলো কন্টিনেন্ট পোলিওমুক্ত।
পোলিও ভাইরাস শরীরে মুখের মধ্য দিয়ে প্রথমে প্রবেশ করে গলায় বসে থাকে। তারপর আস্তে আস্তে শরীরের ভেতরে প্রবেশ করে অন্ত্রের মধ্যে স্থায়ীভাবে গেড়ে। মুখে ঢোকার পরে গলার মধ্যে থাকা কোন কোষের আবরণে এই ভাইরাসের একটি স্পেসিফিক রিসেপ্টরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কোষের ভেতরে প্রবেশ করে।
যেহেতু এটি একটি আরএনএ ভাইরাস, সহজে কোষের ভেতরের কাজের সঙ্গে মিশে গিয়ে হাইজ্যাক করতে পারে তার কাজকে। তখন কোষ নিজের কাজ মনে করে ভাইরাসটি কে সংখ্যা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া ভাইরাসটি তারপর রক্তের মধ্য দিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশে ছড়াতে থাকে।
এখনও পৃথিবীর বেশ কিছু জায়গায় বিশেষ করে এশিয়া আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার কিছু দেশে, শত ভাগ পোলিওমুক্ত করা সম্ভব হয়নি। যদিও গত শতাব্দীর ৯০ দশকের মধ্যেই পৃথিবীর ৯৯ ভাগ অংশকে পোলিওমুক্ত করা হয়েছে।
পোলিও থেকে নিস্তারের উপায় পোলিও ভ্যাকসিন দেয়া।
জন্মের পর বাচ্চার বয়স যখন দুই মাস হয় তখন থেকে তাকে দুই মাস অন্তর মিনিমাম তিনটি ডোজ, পরে ১৮ মাস, ৪ বছর এবং ছয় বছর সময়ে অতিরিক্ত আরও তিনটি ডোজ দিলে শরীর পূর্ণাঙ্গভাবে পোলিও প্রটেকটেড থাকে।
লেখক : চিকিৎসক, কথাসাহিত্যিক ও বিজ্ঞান লেখক লন্ডন, ইংল্যান্ড