ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

সংযুক্ত আরব আমিরাতের ঐকমত্য ঐতিহাসিক জলবায়ু চুক্তি স্বাক্ষর

কাওসার রহমান, দুবাই থেকে ফিরে

প্রকাশিত: ২১:৩৯, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৩

সংযুক্ত আরব আমিরাতের ঐকমত্য ঐতিহাসিক জলবায়ু চুক্তি স্বাক্ষর

ঐতিহাসিক জলবায়ু চুক্তি স্বাক্ষর।

জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে ঐতিহাসিক দুবাই জলবায়ু চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। টানা ২৪ ঘণ্টার দীর্ঘ লাড়ই শেষে বুধবার (১৩ ডিসেম্বর) সকালে দুবাই এক্সিবিশন সেন্টারে দুইশ দেশের প্রতিনিধিরা সর্বসম্মতিক্রমে এই জলবায়ু প্যাকেজ অনুমোদন করেন। 

বিশ্বের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে দূরে সরে আসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল দেশগুলো। যা বিশ্বের ৮০০ কোটি মানুষকে জলবায়ু পরিবর্তনের চলমান ভয়াবহ দুর্যোগের হাত থেকে কিছুটা হলেও পরিত্রাণ দেবে। 

মঙ্গলবার সকাল থেকে বুধবার সকাল পর্যন্ত টানা ২৪ ঘণ্টা লাড়াই করেও শতাধিক উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ চুক্তিতে ‘জীবাশ্ম জ্বালানির অবসান’ শব্দটি সন্নিবেশ করতে পারেননি। এক্ষেত্রে তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর বিশেষ করে বিশ্বের প্রধান তেল উৎপাদনকারী দেশ সৌদি আরব শেষ পর্যন্ত বাধা দিয়ে গেছে। চারটি চুক্তির দলিল সংশোধন করে পঞ্চম দলিলে ‘জ্বালানি ব্যবস্থা থেকে জ্বীবাশ্ম জ্বালানির উত্তরণ ঘটানোর’ ঘটানোর কথা বলা হয়েছে, যাতে বিশ্বে ২০৫০ সাল নাগাদ একটি কার্বন শূন্য পরিস্থিতি তৈরি হয়। চুক্তিতে জীবাশ্ম জ্বালানির উত্তরণ ঘটানোর ক্ষেত্রে জলবায়ু বিজ্ঞানকে অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। 

এই চুক্তির মাধ্যমে বিশ্বকে সবুজ বাতির আওতায় নিয়ে আাসর পরিকল্পনা করা হয়েছে। যার পুরোটা নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে আসবে। এক্ষেত্রে আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ নবায়নযোগ্য জ্বালানি বর্তমানের চেয়ে তিনগুণ এবং জ্বালানি সক্ষমতা দ্বিগুণ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে।      

বুধবার সকালে জলবায়ু সম্মেলনের নীতি নির্ধারণী ফোরাম প্লানারি অধিবেশনে এই চুক্তি অনুমোদনের পর বাংলাদেশসহ বিশ্বের দুইশ’ দেশের প্রতিনিধিরা মুহুমুহু করতালির মধ্য দিয়ে চুক্তিকে অভিনন্দিত করেন। এই চুক্তি অনুমোদনের আগে বৈশ্বিক মুল্যায়ন দলিল অনুমোদন করা হয়। পরবতীতে বৈশ্বিক মুল্যায়ন দলিলসহ দুবাই জলবাযু চুক্তির প্যাকেজ অনুমোদ করা হয়। এই প্যাকেজ অনুমোদনের পর পুরো দুবাই এক্সিবিশন সেন্টারের প্ল্যানারি অধিবেশন মুহুমুহু করতালিতে ফেটে পড়ে। বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা এই চুক্তির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন।  
দুবাই জলবায়ু সম্মেলনের (কপ) প্রেসিডেন্ট আল জাবের এই চুক্তিকে ‘ইউএই ঐকমত্য’ হিসাবে চিহ্নিত করেন। তিনি চুক্তিটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেন, জলবায়ু চুক্তির এই ঐতিহাসিক প্যাকেজ বিশ্বের জলবায়ু সংকট নিরসনে একটি ব্যাপক ভিত্তিক পরিকল্পনা, যা বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি দেড় ডিগ্রি সেলসিয়ারে মধ্যে সীতিম রাখতে সক্ষম হবে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের তেল কোম্পানি এডনকের প্রধান সুলতান আল জাবের বলেন, এই প্রথম বারের মতো অমরা চূড়ান্ত চক্তিতে ‘জীবাশ্ম জ্বালানি’ শব্দ প্রতিস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছি।  

বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরাও এই চুক্তিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, ‘বিশ্বে জীবাশ্ম জ্বালানি যুগের অবসানের পথে এটি প্রথম পদক্ষেপ। আমাদের ঐতিহাসিক পদক্ষেপে জলবায়ু সামিট গর্ববোধ করতে পারে।’
চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশ এই চুক্তিতে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, ‘এই চুক্তি বিশ্বকে শক্তিশালী বার্তা দেবে।’ জলবায়ু সংকটের প্রভাবের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর মতে, এই চুক্তিতে এখন ফাঁক রয়েছে। যা বিশ্বে গ্রিনহাউস গ্যাস যথেষ্ট পরিমাণে হ্রাস করতে বাধা সৃষ্টি করবে।

২৮তম জলবায়ু সম্মেলন শেষে জাতিসংঘের জলবায়ু সংস্থার প্রধান সাইমন স্টিয়েল বলেন, ‘দুবাইতে আমরা একটি বড় অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। এই কপ আমাদের পরিস্কার বার্তা দিচ্ছে যে, আগে আমাদের বাঁচতে হবে।’ 

তিনি বলেন, এই চুক্তিতে বৈশ্বিক অভিযোজন গোলের (লক্ষ্য) একটি কাঠামো পেয়েছি। আমরা এই কপ থেকে জলবায়ুর লস এন্ড ডেমেজ তহবিলকে প্রাথমিক অর্থায়নের মাধ্যমে কার্যকর করতে পেরেছি। এই চুক্তি লাইফলাইন হবে জলবায়ুর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ। এখন এই সুযোগকে ব্যবসায়ী এবং দেশগুলোকে অর্থনীতিতে রূপান্তর করতে হবে। 

তিনি জীবাশ্ম জ্বালানি সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমরা দুবাইতে জীবাশ্ম জ্বালানির অবসান ঘটাতে পারিনি। তবে অবসারে পথে যাত্রা শুরু করেছি। এ ধরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ খুবই কঠিন। কিন্তু আমরা কিছুটা হলেও করতে পেরেছি। যা গত এক দশকের মধ্যে এটি আমাদের বড় অর্জন।  

সাইমন স্টিয়েল আরও বলেন, এই চুক্তি করতে না পারলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ৫ ডিগ্রীতে চলে যেতো। পৃথিবী থেকে অনেক জীবজন্তুর মৃত্যু ঘটত। এখন আমরা যে চুক্তি করতে সক্ষম হয়েছি, তাতে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বদ্ধি অন্তত ৩ ডিগ্রীর মধ্যে সীমিত রাখতে সক্ষম হব। তবে এটি আমাদের মানব জাতিকে নানা দুর্ভোগের মধ্যে ফেলে দেবে। ফলে ২৮তম জলবায়ু সম্মেলনের সিদ্ধান্তগুলোকে আগামী দিনে আরও জোরদার করতে হবে।    

বাংলাদেশের প্রতিনিধি সাবের হোসেন চৌধুরী এই চুক্তি সাক্ষরের জন্য কপ প্রেসিডেন্টের দলকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানান। তিনি বলেছেন, ‘জাতিসংঘের প্রক্রিয়া ঐক্যমতের উপর নির্ভর করে। অতীতে আমরা ঐক্যমত্য শব্দটির আড়ালে লুকানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু এই প্রথম আমরা আমাদের স্বস্তির জোন থেকে বেরিয়ে এসে বড় ছবি দেখার চেষ্টা করেছি। যখন প্রথম খসড়াটি উপস্থাপন করা হয়েছিল তখন আমরা অত্যন্ত হতাশ হয়েছিলাম। গত দুই দিন ধরে, আমাদের সম্মিলিত ইচ্ছায় আমরা সেই  মেঘগুলোকে সরিয়ে দিতে পেরেছি।’

 

এম হাসান

×