ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

অপূর্ব কুমার কুণ্ডুু

কারাগারে ২৮৮ দিন

প্রকাশিত: ০০:৪৮, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১

কারাগারে ২৮৮ দিন

শৈশবে পুরান ঢাকার নবাবগঞ্জে নিজ কাঁধে বঙ্গবন্ধুর রাখা হাতের স্পর্শে বুঝেছিলেন, গড়ে তোলার দায়িত্ব তোমারও। পঁচাত্তর পরবর্তী বেদনাময় শূন্যতায়, কঠোরতম নিষেধ অগ্রাহ্য করে বুকে ঝোলানো হারমোনিয়াম আকৃতির ইউরোপীয় এ্যাকোরডিয়ান বাজিয়ে বাজিয়ে দেশময় সঙ্গীত মূর্ছনায় বলে চলেছেন, বঙ্গবন্ধু মরে নাই। তাঁর রচিত-নির্দেশিত নাটক ‘মুজিব মানে মুক্তি’ দেখতে দেখতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাও কান্না চেপে রাখতে পারেননি। সেই নবাবগঞ্জের শিশু, দুর্যোগে হ্যামিলিয়নের বংশীওয়ালা, নির্মাণে স্বাধীনচেতা, বর্তমানে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক নাট্য ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব লিয়াকত আলী লাকীর ভাবনা ও পরিকল্পনায়, সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতায়, ৬৪ জেলার ৬৪টি শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে মঞ্চায়িত হতে চলেছে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম আশ্রিত ৬৪টি মৌলিক নাটক। এরই ধারাবাহিকতায় কবি ও নাট্যকার আসাদুল ইসলাম রচিত, ধীর কিন্তু লক্ষ্যাভিমুখী নির্দেশক রাজ্জাক মুরাদ নির্দেশিত নাটক ‘২৮৮ দিন’ মঞ্চায়িত হলো গত ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২১ (শুক্রবার) রংপুরের ঐতিহ্যবাহী রংপুর টাউন হলে। বঙ্গবন্ধু কারাগারের জীবনের ৪৬৮২ দিন অতিবাহিত করেছেন। এর মধ্যে ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ মধ্যরাত্রিতে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর থেকে গ্রেফতার হয়ে ৭ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পান, এই পর্বের আটকের সময়কাল ছিল ২৮৮ দিন। এই ২৮৮ দিনের সময়কালকে আশ্রয় করে নাট্যকার আসাদুল ইসলামের নাটক ২৮৮ দিন। নাট্যকার আসাদুল ইসলাম তুলনামূলক কম জানা অধ্যায়কে যেভাবে রচনায় তুলে এনেছেন তাতে স্পষ্ট, সাহিত্যের কবিই পারেন বিশ্বরাজনীতির কবিকে যথোপযুক্তভাবে তুলে ধরতে। নাটকে পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র চরিত্র বঙ্গবন্ধু যেভাবে তাঁর তেজদীপ্ত এবং অনমনীয় ব্যক্তিত্ব নিয়ে অবিরাম লড়ে চললেন পশ্চিম পাকিস্তানের চতুর-বুদ্ধিমান-ডিপ্লোম্যাটিক চরিত্রদের সঙ্গে তা অভাবনীয়-মাত্রা নিয়ন্ত্রিত এবং নান্দনিকভাবে যুক্তিগ্রাহ্য। নাটকে নারী চরিত্রের অনুপস্থিতি, গান-কোরিও গ্রাফির গিমিক নেই, এতদসত্ত্বেও সংলাপ আর বিশ্বস্তচরিত্র চিত্রনগুনে নাটকটি যেন তরতরিয়ে এগিয়ে চলল রংপুরের অবিনাশী সংলাপ, ‘জাগো বাহে কোনঠে সবায়’-এর দৃঢ় স্বরে আর সুরেলা সুরে। ভিন্ন ভিন্ন স্বরকে ভিন্ন ভিন্ন সুরে যেভাবে বাঁধলেন নির্দেশক রাজ্জাক মুরাদ তাতে স্থান-কাল-পাত্র মিলে মিশে একাকার। ঐতিহাসিক চরিত্র অঙ্কন যত কঠিন তিনি যেন তত সহজ করে উপস্থাপন করেছেন। তিন অভিনেতার তিন বঙ্গবন্ধু চরিত্র রূপদান আবার দুই অভিনেতার দুই ভুট্টো চরিত্র রূপদান এতটাই সাবলীল যে, কেউ কাউকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে না অথচ প্রতেকেই যেন নাটকের স্বার্থে প্রাসঙ্গিক। নির্দেশকের একই ভাবনার অঙ্গে এত ভিন্ন ভিন্ন রূপ কিভাবে তা অনুধাবনেও যেন ভাবনা জাগে। তবে সিক্রেট ট্রায়াল দৃশ্যে নৃশংসতার গা ছমছমে ভাবের উপস্থিতি যেন আরেকটু দাবি করে। তবে ভুলবার নয়, আলো-আঁধারির সেনা ঘেরা ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে লম্বা-উজ্জ্বল আলোয় বঙ্গবন্ধুর এগিয়ে আসা। হিমালয় কিংবা তাজমহল দেখার আনন্দ তাঁর বিশালতায়। নির্দেশক রাজ্জাক মুরাদ বিশালতাকে ছুঁয়েছেন। কারোনা পরবর্তী সঙ্কটকে সম্ভাবনায় নিতে বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ হয়ে রংপুর জেলা প্রশাসক মোঃ আসিব আহসান ৭১ জন শিল্পীর হাতে তুলে দিলেন প্রণোদনা চেক আর সীমিত ঢাকা আর বৃহত্তর রংপুরের সংস্কৃতি কর্মীরা প্রাণ উজাড় করে তুলে ধরলেন বঙ্গবন্ধুর জীবনের বিরল নাটকীয়তা। নাটক ২৮৮ দিন মঞ্চায়ন ইতিহাসের সঙ্গে সমকালের মেলবন্ধন এবং মঞ্চমায়ার মাঝে মানবতার আদি-অন্তর উন্মোচন।
×