ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৩ জুলাই ২০২৫, ১৯ আষাঢ় ১৪৩২

নজরুলসঙ্গীতে বিদেশী সুরের প্রভাব

প্রকাশিত: ২৩:৪৯, ১৭ ডিসেম্বর ২০২০

নজরুলসঙ্গীতে বিদেশী সুরের প্রভাব

বাংলা গানের ভাণ্ডার সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) একটি উল্লেখযোগ্য অবদান হলো বিদেশী সুর সঙ্গ্রহ এবং তার যথার্থ প্রয়োগ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩) তাঁদের গানে বিদেশী সুরের প্রয়োগ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সঙ্গীত রচনায় পাশ্চাত্য সঙ্গীতের প্রভাব ও ঋণ বহুবার বিভিন্ন প্রসঙ্গে স্মরণ করেছেন। কিশোর রবীন্দ্রনাথ তাঁর দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিদেশী সুর-যন্ত্র অর্গান বাজানোর সময় সে সুরের বাণীরূপ দান করেছেন। দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর গানে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের প্রত্যক্ষ প্রভাবের স্বাক্ষর রেখেছেন। রবীন্দ্রনাথের বাল্মীকি প্রতিভা ও মায়ার খেলা গীতিনাট্যদ্বয়ের একাধিক গানে আইরিশ ও ইতালীয় সুরের আমেজ লেগেছে। আবার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কোরাস গানগুলোতে পাওয়া যায় ইউরোপীয় চার্চ মিউজিকের উঁচু-নিচু স্বরক্ষেপের প্রয়োগ। এই দুই সঙ্গীত রচয়িতার পর বিদেশী সুরের প্রয়োগ দেখা যায় কাজী নজরুল ইসলামের গানে। বিদেশী সুর সঞ্চয়নে নজরুল তাঁদের উত্তরসাধক। তবে পার্থক্য এই যে, রবীন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রলাল দুজনেই গ্রহণ করেছেন পাশ্চাত্য সুর আর নজরুল গ্রহণ করেছেন প্রধানত মধ্যপ্রাচ্যের সুর। তাই নজরুলের অনেক গানেই পাওয়া যায় আরবীয়, ইরানীয়, তুর্কি, মিসরীয় প্রভৃতি সুর। পূর্বসূরিদের আমদানিকৃত পাশ্চাত্য সুরের সঙ্গে বাঙালীর পরিচয় থাকলেও নজরুল এক নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মোচন করেন। বিদেশী সুরকে দেশীয় সঙ্গীতের সঙ্গে মিশিয়ে তিনি যে-সব গান রচনা করেন, তা সত্যিই অতুলনীয়। এ প্রসঙ্গে ডক্টর বাঁধন সেনগুপ্ত নজরুল কাব্যগীতি : বৈচিত্র্য ও মূল্যায়ন গ্রন্থে উল্লেখ করেন ‘বিদেশী সুর-সম্পদকে তিনি দেশীয় সঙ্গীতরসে নিষিক্ত করে যে প্রাণ-মাতানো গীতিগুচ্ছ রচনা করেন তার তুলনা আমাদের সঙ্গীতে মেলা ভার। যেমন, ‘রুম্্ঝুম্্ ঝুম্্ঝুম্্ রুম্্ঝুম্্ ঝুম্্’ রচনাটি আরবী সঙ্গীতের সুরকে অবলম্বন করে রচিত। বেদুইন ‘আরবী’ মেয়েদের মনোরঞ্জনী গানের সুরের প্রভাব এই রচনাটির বৈশিষ্ট্য। একই নিয়মে ‘বুলবুলি নীরব নার্গিস বনে’ গানটিতে ‘নৌরচকা’ জাতীয় গানের সুরকে অনুসরণ করা হয়েছে।’ নজরুল বাংলা গজল রচনা করেন পারসিক গজলের ভাবাদর্শে। তবে বিদেশী সুরের প্রয়োগে বাংলা গানকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে পারস্যই তাঁর প্রেরণার একমাত্র উৎস ছিল না। অন্যান্য অনেক দেশ থেকেও তিনি প্রচুর পরিমাণে সুরের আদল গ্রহণ করেছেন। আরবি সুরে তাঁর একাধিক গান রয়েছে। তেমনি আছে জিপসিদের সুরের গান। জিপসিরা দেশে দেশে ঘুরে বেড়ায়। হাঙ্গেরি তাদের আদি বাসস্থান বলে ধারণা করা হয়। জিপসিরা যখন যে দেশে গেছে, সে দেশের সুর আপন কণ্ঠে ধারণ করেছে। এর ফলে তাদের গানের ঢঙে এসেছে একটা আন্তর্জাতিক সুরভঙ্গি। নজরুল তাঁর একাধিক বাংলা গানে এই বিমিশ্র আন্তর্জাতিক সুরভঙ্গিটি গ্রহণ করেছেন। আবার প্রশান্ত মহাসাগরীয় দক্ষিণ সমুদ্র দ্বীপগুলোর সুরেও তাঁর গান রয়েছে। তিনি একটি সচেতন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে নানা দেশের সুরভঙ্গি গ্রহণের মাধ্যমে বাংলা গানের ভাণ্ডারকে পরিপুষ্ট করে তুলেছেন। নজরুলের বিদেশী সুরের গানগুলোতে জনপ্রিয় বিলাপের সুরের প্রাধান্য লক্ষ করে গবেষক নারায়ণ চৌধুরী তাঁর কাজী নজরুলের গান শীর্ষক গ্রন্থে বলেন- ‘নজরুলের বিদেশী সুরভঙ্গিযুক্ত গানগুলোর বৈশিষ্ট্য এই যে, সেগুলোতে জনপ্রিয় বিলাপের সুরের প্রাধান্য। একটা ধিরষরহম বা কান্নার ভাব গানগুলোর সুরের সঙ্গে জড়িয়ে-মিশিয়ে আছে, যেমন তা আছে আমাদের পূর্ববঙ্গের ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া প্রভৃতি গান কিংবা আসামের বিহু গানের মধ্যে। এই কান্নার ভঙ্গিটি নজরুলের বিদেশী ধাঁচের গানগুলোকে একটা অনন্যতা দিয়েছে, যা আর কারও গানে সুলভ নয়। নজরুলের গান সুরে ভরা- সুরের মাদকতায় তাঁর গানের কোন তুলনা হয় না।’কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর গানে কেবল বিদেশী সুরের প্রয়োগ করেননি, যখন যে দেশের সুর গ্রহণ করেছেন, তখন সে দেশের পরিবেশের অনুষঙ্গ রচনার জন্য তিনি যে বাণীর আশ্রয় নিয়েছেন তাও যথার্থ। এ প্রসঙ্গে বিশ্বনাথ দে সম্পাদিত নজরুল স্মৃতি শীর্ষক গ্রন্থে কবি-পুত্র কাজী অনিরুদ্ধের উক্তি স্মরণ করা যেতে পারে: ‘... বাংলা গানের ক্ষেত্রে তিনি যেন মধ্যপ্রাচ্যের সুরা ও সাকি, খেজুর গাছ, প্রখর রৌদ্র এবং ওয়েসিসের শ্যামলিমা নিয়ে হাজির হলেন। বাঙালীর কাছে এর স্বাদ নতুন, সুর নতুনতর।’
×