ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ৩১ জুলাই ২০২৫, ১৬ শ্রাবণ ১৪৩২

বিদেশমুখী মেধা: কেন উচ্চশিক্ষার জন্য দেশ ছাড়ছেন হাজারো শিক্ষার্থী?

মো. আতিকুর রহমান, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, ঢাকা

প্রকাশিত: ১৩:৩৫, ৩০ জুলাই ২০২৫

বিদেশমুখী মেধা: কেন উচ্চশিক্ষার জন্য দেশ ছাড়ছেন হাজারো শিক্ষার্থী?

ছবি: সংগৃহীত।

উন্নত শিক্ষা ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে প্রতি বছর হাজার হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী পাড়ি জমাচ্ছেন বিদেশে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া—এই দেশগুলো বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার প্রধান গন্তব্য হয়ে উঠেছে। একদিকে যেমন বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিশ্বমানের শিক্ষা ব্যবস্থা ও গবেষণার সুযোগ শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করছে, অন্যদিকে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সীমিত আসন, সেশন জট, এবং অস্থিতিশীল পরিবেশ শিক্ষার্থীদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করছে। ফলে দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ বিদেশে চলে যাচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে ‘ব্রেন ড্রেইন’ বা মেধা পাচারের আশঙ্কা তৈরি করছে।

ইউনেস্কোর সাম্প্রতিক তথ্যমতে, প্রতিবছর উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়া বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। বিশেষ করে কোভিড-পরবর্তী সময়ে এই প্রবণতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। শিক্ষা পরামর্শকরা বলছেন, বিদেশে পড়াশোনার প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহের পেছনে একাধিক বাস্তব কারণ রয়েছে, যার মধ্যে বিশ্বমানের শিক্ষা, গবেষণার সুযোগ, চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতামূলক প্রস্তুতি এবং বিদেশে বসবাসের সম্ভাবনা অন্যতম।

বিদেশে উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী শিক্ষার্থীদের মতে, উন্নত দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আধুনিক কারিকুলাম, পর্যাপ্ত গবেষণা বাজেট, সুসজ্জিত ল্যাব এবং প্রয়োগভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে তারা দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য ভর্তি হওয়া আফরিন সুলতানা জানান, তিনি দেশে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেলেও সেশন জট ও গবেষণার সীমাবদ্ধতার কারণে বিদেশে পড়াশোনা বেছে নেন। সেখানে পড়াশোনার পাশাপাশি কাজের সুযোগও থাকায় তিনি আন্তর্জাতিক চাকরির বাজারে নিজেকে আরও ভালোভাবে প্রস্তুত করতে পারছেন।

শুধু শিক্ষার মানই নয়, পড়াশোনা শেষে পোস্ট-স্টাডি ওয়ার্ক ভিসা ও স্থায়ী নাগরিকত্বের সুযোগও অনেক শিক্ষার্থীকে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য উদ্বুদ্ধ করছে। এই সুবিধাগুলো তাদের উন্নত ও নিরাপদ জীবনযাত্রার নিশ্চয়তা দেয়, যা অনেক সময় দেশে পাওয়া সম্ভব হয় না।

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমিত আসনসংখ্যা। প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিলেও মাত্র অল্পসংখ্যকই সুযোগ পান। তীব্র প্রতিযোগিতা এবং সুযোগের সীমাবদ্ধতা অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীকে হতাশ করে তুলছে। এর পাশাপাশি সেশনজটের কারণে শিক্ষাজীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে এবং অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে শিক্ষার্থীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন।

গবেষণার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে বাজেট ও সুযোগ-সুবিধা তুলনামূলকভাবে অপ্রতুল। ফলে যারা গবেষণা বা শিক্ষকতায় ক্যারিয়ার গড়তে চান, তাদের জন্য বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনেক বেশি আকর্ষণীয়। সেইসঙ্গে দেশের চাকরির বাজারের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলামের অসামঞ্জস্যতার কারণে অনেক স্নাতকই নিজেদের যোগ্যতার অনুযায়ী কাজ পান না। এসব সমস্যার কারণে শিক্ষার্থীরা দেশের বাইরে সুযোগ খোঁজেন।

এই পরিস্থিতিকে দেশের জন্য অশনি সংকেত হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের একজন অধ্যাপক বলেন, "আমরা আমাদের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের হারাচ্ছি। তারা বিদেশে গিয়ে আর ফিরে আসতে চান না। এর ফলে দেশ দক্ষ প্রকৌশলী, চিকিৎসক, গবেষক এবং শিক্ষাবিদ হারাচ্ছে।" তিনি আরও বলেন, দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় মানোন্নয়ন, গবেষণায় বিনিয়োগ, ক্যাম্পাসে নিরাপদ পরিবেশ এবং স্নাতকদের জন্য চাকরির সুযোগ নিশ্চিত না করলে এই মেধাপাচার রোধ করা সম্ভব হবে না।

সব মিলিয়ে বলা যায়, বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ এখন শুধু স্বপ্ন নয়, বাস্তব পরিকল্পনার অংশ হয়ে উঠেছে। তবে এই স্রোত যদি পরিকল্পিতভাবে দেশের উন্নয়নে ফিরিয়ে আনা না যায়, তাহলে তা ভবিষ্যতে দেশের জন্য বড় সংকট তৈরি করতে পারে।

মিরাজ খান

আরো পড়ুন  

×