
ফের ডিজিটাল ব্যাংককে লাইসেন্স দেওয়ার পরিকল্পনা
মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস ও ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের অগ্রগতির ধারাবাহিকতায় শতভাগ শাখাহীন ব্যাংকিং ব্যবস্থার দিকে যেতে ফের ডিজিটাল ব্যাংককে লাইসেন্স দেওয়ার পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন ধারার ব্যাংক হিসেবে পরিচিত ডিজিটাল ব্যাংকগুলো প্রতিবেশী দেশগুলোয় তথা সারাবিশ্বে জনপ্রিয় হলেও তা বাংলাদেশে নতুন ধারণা। তবে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী, এমএফএস, এজেন্ট ব্যাংকিং ও ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের জনপ্রিয়তা এবং ডিজিটাল-ফার্স্ট গ্রাহকদের সংখ্যা দিনকে দিন বেড়ে যাওয়ায় আরও ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশ প্রস্তুত বলে মনে হচ্ছে।
২০২৩ সালে বাংলাদেশ ডিজিটাল নীতিমালা জারি করে ব্যাপক সাড়া পায়। এরপর আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হলেও সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার পালিয়ে যাওয়ার পর বর্তমান গর্ভনর আহসান এইচ মনসুর পুরো কার্যক্রম স্থগিত রাখে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর একটি গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকারে জানান, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী আগস্ট মাসে ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্সের জন্য আবেদন গ্রহণ শুরু করতে যাচ্ছে’।
তিনি বলেন, এর আগে যেসব প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছিল, তারাও নতুন করে আবেদন করতে পারবে। এরপরে ‘আমরা আবেদনগুলো যাচাই করে দ্রুতই বাছাইয়ে প্রক্রিয়ায় চলে যাব।’ ঠিক কতগুলো লাইসেন্স দেওয়া হবে, তা নির্দিষ্ট করে না জানালেও, আবেদনের গুণগত মানের ওপরই চূড়ান্ত সংখ্যা নির্ভর করবে। গভর্নর জানান, ‘খুব বেশি লাইসেন্স হবে না। ধাপে ধাপে আমরা এগোব।’
গভর্নর বলেন, সম্ভাব্য ডিজিটাল ব্যাংক পরিচালনাকারীদের ২-৩ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের সক্ষমতা থাকতে হবে। ‘ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে সফল হতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। বিকাশকে মুনাফা করতে ১২ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। নগদকেও হয়ত ১০ বছর অপেক্ষা করতে হবে।’
গভর্নর বলেন, বর্তমানে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি ন্যানো লোন বিতরণ করতে পারবে না। ‘এর জন্য তাদের ডিজিটাল ব্যাংক সাবসিডিয়ারি করতে হবে অথবা আলাদা লাইসেন্স নিতে হবে।’ এখন এমএফএসগুলো ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ দিতে পারে। তবে গভর্নর ইঙ্গিত দিয়েছেন, ভবিষ্যতে সেটা ১ লাখ, দেড় লাখ বা ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত করা হতে পারে। তবে এর জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর পর্যাপ্ত সক্ষমতা, বিনিয়োগ ও দক্ষতা থাকতে হবে।
২০২৩ সালের ১৪ জুন বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ডিজিটাল ব্যাংক’ গঠনের জন্য গাইডলাইন প্রণয়ন করে। পরে একই বছরের ২১ জুন থেকে ১৭ আগস্ট পর্যন্ত আবেদন গ্রহণ করা হয়। এই সময়ে ৫২টি আবেদন জমা পড়ে। এরমধ্যে আটটি প্রাথমিক অনুমোদন পায় এবং দুটি ব্যাংক লেটার অভ কনসেন্ট (এলওসি) পায়। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পরপরই বাংলাদেশ ব্যাংক নগদ ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স স্থগিত করে। পরে গতবছরের আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর আহসান এইচ মনসুর ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার পুরো প্রক্রিয়া পর্যালোচনার ঘোষণা দেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের ৬১টি ব্যাংকের শাখা ছিল ১১ হাজার ২০০টির বেশি। এদের অর্ধেকের বেশি ছিল শহরাঞ্চলে। অর্থনীতিতে হু-ির মাধ্যমে লেনদেন প্রায় ৫২ শতাংশ উল্লেখ করে এই পরিস্থিতি ব্যাংকিং সেবার বাইরে থাকা লাখ লাখ মানুষের কাছে নগদের মতো ডিজিটাল ব্যাংকগুলোকে পৌঁছানোর সুযোগ করে দেবে।’
প্রতি চার গ্রাহকের একজন পুরোমাত্রায় ডিজিটাল ব্যাংক ব্যবহার করছেন। জরিপ করা ২৮ দেশে ডিজিটাল ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট আছে এমন গ্রাহকের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ২৩ শতাংশ। তাদের সংখ্যা আনুমানিক ৪৫ কোটি। বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল ব্যাংকগুলো সঞ্চয়, ক্রেডিট কার্ড, ব্যক্তিগত ঋণ ও বিনিয়োগসহ নানান আর্থিক পরিষেবা দিয়ে থাকে। গ্রাহকরা মোবাইল অ্যাপ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে আরও সহজ ও সুবিধাজনক ব্যাংকিং সেবা নিতে পারছেন।
বৈশ্বিক ডেটা ও বিজনেস ইন্টেলিজেন্স প্ল্যাটফর্ম স্ট্যাটিসটা ডট কমের মতে, চলতি বছরে ডিজিটাল ব্যাংকগুলোর বিশ্বব্যাপী ন্যূনতম সুদ আয় ৮২২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে। আরেকটি সুবিধা হলো ডিজিটাল ব্যাংকগুলো থেকে ২৪ ঘণ্টাই সেবা পাওয়া যায়। প্রযুক্তিপ্রেমী নতুন প্রজন্মের জীবনযাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তারা দ্রুত আর্থিক সেবা দিতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে গ্রাহকরা, বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম ছেলে-মেয়েরা সশরীরে ব্যাংকে যাওয়া এড়িয়ে চলতে চান। মহামারির কারণে এই প্রবণতা আরও বেড়েছে। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সাবেক সভাপতি এ কে এম ফাহিম মাশরুর জনকণ্ঠকে বলেন, ‘ডিজিটাল ব্যাংকগুলো সুবিধা পেলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর নেওয়া ২০ থেকে ২৬ শতাংশ সুদের হারের তুলনায় কম সুদে ঋণ পেতে পারবেন।’
অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, ‘এটি দেশে অনেকটা অপরিচিত। ডিজিটাল ব্যাংকগুলো কী কী সেবা নিয়ে আসছে যা প্রচলিত ব্যাংকগুলো দেয় না এখন তাই দেখার বিষয়।’
প্যানেল হু