
বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্কারোপ করেছেন যুক্তরাষ্ট্র
বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্কারোপ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, যা কার্যকর হবে আগামী ১ আগস্ট থেকে। এর আগে ৩৭ শতাংশ শুল্কারোপ করেছিলেন, সেই তুলনায় এবার ২ শতাংশ কম। তবে রপ্তানি পোশাক খাতে বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনামের তুলনায় এটি অনেক বেশি। কারণ ভিয়েতনামের পণ্যে এই শুল্কারোপ হয়েছে ২০ শতাংশ। এর আগে, গত এপ্রিলে বাংলাদেশের পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র।
তখন আগ্রাসী এই শুল্কহার কার্যকর করার আগে সময় দেওয়ার জন্য ট্রাম্পকে চিঠি লিখেছিলেন বাংলাদেশের সরকার প্রধান। এরপর তিন মাস সময় দিয়েছিলেন ট্রাম্প। ওই তিন মাসের সময়সীমা শেষ হওয়ার আগ মুহূর্তে তা আরও বাড়িয়ে ১ আগস্ট পর্যন্ত করেছেন তিনি। বিবিসির এক প্রতিবেদনে জানা যায়, বাংলাদেশ ছাড়াও মিয়ানমার ও লাওসের পণ্যে শুল্ক হবে ৪০ শতাংশ, কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডে ৩৬ শতাংশ, সার্বিয়ার পণ্যে ৩৫ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ার ওপর ৩২ শতাংশ, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় ৩০ শতাংশ এবং জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, কাজাখস্তান, মালয়েশিয়া ও তিউনিসিয়ার পণ্যে বসবে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক।
এ ছাড়া আরও কিছু চিঠি আসতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে। তবে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ভিয়েতনামের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তি। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে সরাসরি প্রতিযোগী এই দুই দেশ। ট্রাম্প জানিয়েছেন, নতুন চুক্তি অনুযায়ী ভিয়েতনামের পণ্যে ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে, যা এর আগে ঘোষিত ৪৬ শতাংশ থেকে অনেক কম। এই ২০ শতাংশ শুল্ক আগামী ৯ জুলাই থেকে কার্যকর হওয়ার কথা। ভিয়েতনাম তাদের বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে কোনো শুল্ক আরোপ না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এ কারণেই এই দেশটির ওপর কম শুল্কারোপ করেছেন বলে জানিয়েছেন ট্রাম্প।
এদিকে সরকারি হিসাব মতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি করা পণ্য থেকে প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করেছে বাংলাদেশ। শুল্ক বা ট্যারিফ হলো আমদানি করা পণ্যের ওপর আরোপিত কর, যা আমদানিকারককে দিতে হয়। এতে বিদেশি পণ্যের দাম বাড়ে, ফলে সেগুলো স্থানীয় বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে, যদি আমদানিকারকরা বাড়তি শুল্ক দিতে না চান, তবে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের বাধ্য হয়ে দাম কমাতে হতে পারে।
ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার আগে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রে গড় শুল্কহার ছিল ১৫ শতাংশ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বর্তমান ঘোষিত অতিরিক্ত ৩৫ শতাংশ শুল্ক আগের ৩৮ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণার চেয়ে ৩ শতাংশ কম। তবে যেহেতু বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি শুল্কের গড় হার ১৫ শতাংশ, তাই এ অতিরিক্ত ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপিত হলে বাংলাদেশের জন্য প্রকৃত শুল্কহার হবে ৫০ শতাংশ। এ শুল্কহার বৃদ্ধি আগামী দিনগুলোয় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিরাট প্রভাব ফেলবে। বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির একক বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশ ৮৭০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যা দেশের রপ্তানি আয়ের ১৮ শতাংশ।
বাংলাদেশের ২ হাজার ৩৩৭ প্রতিষ্ঠান রপ্তানির সঙ্গে সম্পৃক্ত। বাংলাদেশের পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক ঘোষণায় দেশের আট শতাধিক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত শুল্ক বৃদ্ধিতে আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতিতে বিশাল বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলার আশঙ্কা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানিকৃত বাংলাদেশি পণ্যের ৮৭ শতাংশেরও বেশি তৈরি পোশাক। এ দেশের ১ হাজার ৮২১ পোশাক তৈরিকারক প্রতিষ্ঠান বিদেশে পোশাক রপ্তানি করে।
পোশাক রপ্তানি বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম উৎস। প্রতি বছর বাংলাদেশ তৈরি পোশাক থেকে ৪০০ কোটি ডলারের বেশি আয় করে। এ খাতে ৪০ লাখেরও বেশি শ্রমিক কাজ করেন, যাদের ৮০ শতাংশেরও বেশি নারী। তাই যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত শুল্ক বৃদ্ধির ফলে একদিকে যেমন বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয় ক্ষতিগ্রস্ত হবে, অন্যদিকে কর্মনিয়োজন কমে যেতে পারে। কারণ পোশাক শিল্পের বহু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে এ প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ছোট ছোট শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং ব্যাপক বেকারত্বের শিকার হতে পারেন নারী শ্রমিকরা।
এই বিষয়ে সমঝোতার জন্য সরকারি প্রতিনিধি যুক্তরাষ্ট্র গিয়েছিলেন এবং বাংলাদেশ পক্ষের নেতৃত্ব দেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী জনাব ফয়েজ তৈয়ব ঢাকা থেকে ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করেন। ভার্চুয়ালি আরও উপস্থিত ছিলেন সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা। তিন দিনের এই আলোচনার পুরো বিষয়টি সমন্বয় করেছে ওয়াশিংটন ডিসির বাংলাদেশ দূতাবাস।
বৈঠকে বেশকিছু বিষয়ে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট মোটামুটিভাবে একমত হয়েছে। কিছু বিষয় রয়ে গেছে অমীমাংসিত। সেখানে বাণিজ্য উপদেষ্টা বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক এবং রপ্তানি পরিস্থিতি তুলে ধরেন। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির পাশাপাশি আমদানির পরিমাণও বৃদ্ধি করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যা এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। শুল্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ন্যায্যতা প্রত্যাশা করে।
মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৮৩৬ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। এর বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২২১ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এই হিসাবে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য-ঘাটতির পরিমাণ ৬১৫ কোটি ডলার। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্ক কমানোর শর্ত হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে যেসব পণ্য বাংলাদেশ আমদানি করে, সেসব পণ্যে পর্যায়ক্রমে শুল্ক, ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক, রেগুলেটরি ডিউটি হ্রাস চেয়েছে।
এরই অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিদ্যমান বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। বিশেষ করে সরকারি খাতে ফুড ড্রিংক, বোয়িং বিমান ও মিলিটারি ইকুইপমেন্ট কেনার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে গুরুত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত গম, সয়াবিন, এয়ারক্রাফট ও অন্যান্য মেশিনারির ওপর ডিউটি খুব কম। তুলা আমদানিকে আরও অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
তুলা আমদানির ওপর ২ শতাংশ এআইটি আছে। সেটি প্রত্যাহার নিয়ে আলোচনা হচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানি যাতে বেশি হয় সেজন্য কিছু সুবিধা দেওয়ার চিন্তা করছে সরকার। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার বাণিজ্য আলোচনা চলমান থাকবে।
কয়েকটি বিষয় এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে। দুই পক্ষই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, নিজেদের মধ্যে আন্ত:মন্ত্রণালয় আলোচনা চালু থাকবে। তারপর আবার দুই দেশের প্রতিনিধিরা আলোচনায় বসবেন। সেই আলোচনা ভার্চুয়ালি এবং সামনাসামনি দুই প্রক্রিয়াতেই হতে পারে। খুব দ্রুতই সেই তারিখ নির্ধারিত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
পরিশেষে বলা প্রয়োজন যে আলাপ-আলোচনার জন্য এখনো কিছুটা সময় আছে এবং সে সময়টাকে অত্যন্ত দক্ষ ও কার্যকরভাবে কাজে লাগাতে পারলে আরও কিছু শুল্ক সুবিধা আদায় করা যেতে পারে। তার জন্য কয়েকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ যেমন বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বুঝতে হবে, কোন কোন ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানো যায়, তা ভেবে দেখা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা ও দরকষাকষিতে যাদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা আছে, তেমন বাংলাদেশি অভিজ্ঞদের বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসা দরকার।
প্যানেল হু