ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৩ জুন ২০২৫, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ব্যাংক খাতকে খাদের কিনারা থেকে টেনে তুলেছেন গভর্নর

নাজমুল ইসলাম

প্রকাশিত: ০০:১০, ১২ জুন ২০২৫

ব্যাংক খাতকে খাদের কিনারা থেকে টেনে তুলেছেন গভর্নর

ব্যাংক খাতকে খাদের কিনারা থেকে টেনে তুলেছেন গভর্নর

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো করতে নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। বিশেষ করে ব্যাংক খাতকে খাদের কিনারা থেকে টেনে তুলতে গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর নিরলসভাবে পরিশ্রম করে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় লুটপাটের সেই ধারা এখন বন্ধ হয়ে গেছে। যে সকল ব্যাংক লুটপাটের শিকার হয় ও অব্যবস্থাপনার মধ্যে ছিল, তার ১৪টির পরিচালনা পর্ষদ বদল করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। সার্বিকভাবে বলা যায়, ব্যাংক খাতের কিছুটা উন্নতি হয়েছে। ব্যাংক খাত নিয়ে আগের মতো কোনো শঙ্কা নেই।
সরকার বদলের পর ব্যাংক খাতে তদারকি বাড়ানোর পাশাপাশি নড়েচড়ে বসে বাংলাদেশ ব্যাংক। সমস্যায় পড়া ব্যাংকগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ অনুমোদন দিয়েছে। যার অধীন ব্যাংক একীভূত, অধিগ্রহণ ও অবসায়নের সুযোগ রাখা হয়েছে। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার পরিবর্তন আনা হচ্ছে। তবে কতদিনে এসব কার্যকর হবে ও গ্রাহকেরা নির্বিঘেœ লেনদেন করতে পারবেন, তা নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।
কারণ, ব্যাংকগুলো নিয়ে এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আবার নামে-বেনামে নেওয়া ঋণ আদায় করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। এদিকে অর্থ পাচার রোধে সমন্বয়কের দায়িত্ব থাকা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এখন কিছুটা সক্রিয় হয়েছে। 
ব্যাংকাররা বলছেন, ‘ব্যাংক খাতে যে অতুলনীয় ক্ষত হয়েছে, তা অপূরণীয়। বর্তমান সরকার সেটা থামাতে পেরেছে, এটা বড় অর্জন। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক যে পরিকল্পনাগুলো করছে, এটা বাস্তবায়ন করতে হবে।’  
ড. আহসান এইচ মনসুরের সাফল্য ॥ সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলারের বিদেশি বকেয়া কিস্তি পরিশোধ। টাকা ছাপিয়ে দুর্বল ব্যাংকে ঋণ সহায়তা। ১৪ ব্যাংকের পর্ষদ পরিবর্তনের ফলে এখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছে ব্যাংকগুলো। অধ্যাদেশের মাধ্যমে ব্যাংক রেজ্যুলেশন অ্যাক্ট কার্যকরের অপেক্ষা। এছাড়া হু-ি রোধে রেকর্ড  রেমিটেন্সে আদায়। যে কারণে ডলার বাজার এখন স্থিতিশীল রয়েছে। আমদানিতে ওভার ইনভয়েস হ্রাস এখন দৃশ্যমান। খেলাপি ঋণের প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে। নতুন ডিজাইনের নোট বাজারে ছাড়ার সিদ্ধান্তকেও সবাই স্বাগত জানিয়েছে। এদিকে দশ গ্রুপের ঋণ অনিয়ম তদন্তে যৌথ তদন্ত কমিটি গ্রহণ। ঋণ অনিয়মের জড়িতদের বিরুদ্ধে দেড় সহ¯্র্রাধিক মামলাও করা ও খেলাপিদের সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা জব্দ। 
ব্যাংক খাতের আলোচিত বিষয় অনিয়মে যুক্ত থাকা সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুরকেও কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। শিল্পগ্রুপ সাদ-মুসা গ্রুপের এমডি মহসিনের ৫ বছর জেল, কারাগারে প্রেরণ এবং কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় কৃষি ব্যাংক শাখা ব্যবস্থাপক কারাগারে রয়েছে।  মূল্যস্ফীতি কমাতে নীতি সুদহার বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা। ৩৫ ব্যাংকের ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি চিহ্নিত করা এবং পাচার অর্থের তথ্য চেয়ে দুই শতাধিক দেশে চিঠি, তার জবাব মিলেছে ২৭টির। 
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুনাফা কে মুজেরী বলেন, ‘ব্যাংক খাতের ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে, পাশাপাশি জড়িত ব্যক্তিদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে। অনেক দিন ধরে নানা ঘোষণা শোনা যাচ্ছে, তবে কার্যকর তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। বাস্তবে আমানতকারীদের আস্থা ফিরিয়ে এনে ব্যবসায় ঋণ বাড়াতে হবে। কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে উদ্যোগ নিতে হবে। তাহলেই কাজের কাজ হবে।’
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে যা হয়েছিল ॥ ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর প্রথম মেয়াদেই সোনালী ব্যাংকে হলমার্ক ও বেসিক ব্যাংকে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম হয়। তখন ব্যাংক খাতে দাপট ছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের। বেক্সিমকো ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো বিপুল পরিমাণ ঋণ নেয়। তবে তখন ব্যাংক দখল করার ঘটনা শুরু হয়নি। দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ও সুবিধাভোগী হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ সাইফুল আলম (এস আলম) এ কে কমার্স, ইসলামী, সোশ্যাল ইসলামী ও ন্যাশনাল ব্যাংক দখল করে ব্যাপক লুটপাট চালান, পাশাপাশি ওই সব ব্যাংকে ছাপিয়ে টাকা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

এই সময়ে আওয়ামী-সমর্থিত আরও অনেকে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে মাত্রাতিরিক্ত ঋণ নেন। বিদায়ী সরকারের সময় খেলাপি ঋণ কম দেখানোর নানা কৌশল নেওয়া হয়। সরকার পরিবর্তনের পর সেই নীতি থেকে সরে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যা এখন বের হয়ে আসছে। ব্যাংক খাতে এমন ঋণের পরিমাণ প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। সূত্রগুলো বলছে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ও সুবিধাভোগী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়া ব্যাংকগুলো ঋণের প্রকৃত চিত্র দেখাতে শুরু করেছে।
এদিকে গত ডিসেম্বরেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকা ছুঁই ছুঁই ছিল। দেশের ব্যাংক-ব্যবস্থায় গত ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। ডিসেম্বর শেষে মোট বিতরণ করা ঋণের ২০ দশমিক ২০ শতাংশ খেলাপি হয়ে গেছে। ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। এরপর থেকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলছে। অর্থনীতিবিদেরা অনেকদিন ধরেই অভিযোগ করছেন, তৎকালীন সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটপাট হয়েছে, যার একটা বড় অংশই বিদেশে পাচার হয়েছে।

×