ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৩ ফাল্গুন ১৪৩১

কৃষক কেন হতাশ হবেন?

জলি রহমান

প্রকাশিত: ১৮:৫২, ২৫ জানুয়ারি ২০২৫

কৃষক কেন হতাশ হবেন?

বর্তমানে সবজি বাজারের ক্রেতাদের মধ্যে বেশ সন্তুষ্টি দেখা যায়। কেননা একদম সস্তায় মিলছে শীতের সবজি। অন্যদিকে ভিন্ন চিত্র। ফসলের মূল্য নিয়ে হতাশায় ভুগছেন কৃষক। উৎপাদন খরচ মিললেও দেখতে পাচ্ছে না লাভের মুখ। সম্প্রতি একটি পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে দেখলাম ভরপুর ফলনেও কাঁদছেন চাষি। প্রায় বছরেই এ রকম খবর আমাদের চোখে পড়ে। এর মূল কারণ অব্যবস্থাপনা। এ দেশ ছোট হলেও সম্পদ রয়েছে অসীম। কিন্তু সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এর সদ্ব্যবহার করা সম্ভব হয় না। তাই যখনই কোনো ফলন ভালো হয় তখনই দাম কমে। ফলে ন্যায্য মূল্য না পেয়ে অনেক কৃষক নিজেদের কষ্টে ফলানো ফসল নিজেরাই নষ্ট করেন, যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক।
মালিবাগ বাজারে সবজি কেনার সময় বিক্রেতা বললেন, ‘সব সবজির দাম কম। একটা ফুলকপি মাত্র ২০ টাকা। টমেটোর কেজি ৩০ টাকা। এরপরও মানুষ সস্তায় চায়।’ উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, কৃষকরা কিভাবে লাভ করবে কয়েন? আমাদের দেশের মাটি যথেষ্ট উর্বর। তাই সিজনাল ফলমূল, সবজি বরাবরই ভালো হয়। ইতোমধ্যে দেশের কৃষিপণ্যের রপ্তানি বাজারও হয়েছে সম্প্রসারিত। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য-উপাত্ত অনুসারে, চলতি অর্থছরের (২০২৪-২৫) প্রথম ছয় মাস অর্থাৎ জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে বিভিন্ন ধরনের কৃষিপণ্য রপ্তানি থেকে আয় এসেছে ৬০ কোটি ডলার, দেশীয় মুদ্রায় যা প্রায় সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে এই পরিমাণ ছিল ৫৪ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরে কৃষিপণ্য থেকে ১১২  কোটি ডলার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সরকারের। কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য খাতের সম্ভাবনা নিয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এবং ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের বৈশ্বিক বাজারের আকার ছিল ১৩ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন বা ১৩ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলার। গত বছর বাংলাদেশের প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের বাজার (দেশীয় চাহিদা ও রপ্তানি) ছিল ৪৮০ কোটি ডলারের। আর কৃষিপণ্যের বাজার ছিল চার হাজার ৭৫৪ কোটি ডলারের।
বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে কুয়েত, কাতার, সৌদি আরব, জার্মানি, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্যসহ প্রায় ১৩৭টি দেশে কৃষিজাত পণ্য রপ্তানি হয়। কৃষিজাত পণ্যের মধ্যে রয়েছে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য, তাজা ও হিমায়িত সবজি, ফলমূল ইত্যাদি। কৃষিপণ্যের মধ্যে দ্বিতীয় বড় রপ্তানি খাত হচ্ছে শুকনা খাবার। এসব খাদ্যের মধ্যে রয়েছে মসলা, চানাচুর, ঝালমুড়ি, বিস্কুট, সস, জেলি, আলুপুরি, পাপড়, নুডলস, চকোলেট, বিভিন্ন ধরনের আচার, জুস, ফ্রুট ড্রিংক, চিপসসহ বিভিন্ন পণ্য। গত ছয় মাসে ১১ কোটি ডলারের শুকনা খাবার রপ্তানি হয়েছে বিভিন্ন দেশে। তৃতীয় বড় খাত হচ্ছে ভেজিটেবলস অ্যান্ড এনিম্যাল ফ্যাট। ছয় মাসে প্রায় ১০ কোটি ডলার এসেছে এসব পণ্য রপ্তানি করে।
দেশে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের প্রায় এক হাজার কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে ৯০ শতাংশই অতি ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র। বাকি ১০ শতাংশ মাঝারি ও বড়। এর মধ্যে রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ২৫০টি কারখানা। তবে অবাক করার মতো তথ্য হচ্ছে, কৃষিপণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় তামাক। মোট রপ্তানি আয়ের এক-তৃতীয়াংশই আসে তামাক রপ্তানি থেকে। গত ছয় মাসে এসেছে ১৮ কোটি ডলার বা প্রায় দুই হাজার ২০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশে প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য খাত জিডিপিতে ২ শতাংশেরও কম অবদান রেখেছে, যা পাশের দেশের তুলনায় অনেক কম। যেমন থাইল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কায় জিডিপিতে এই খাতের অবদান ৭ দশমিক ৪ শতাংশ এবং ফিলিপিন্সে ১০ দশমিক ৪ শতাংশ।
শিল্পের অনেক প্রসার ঘটলেও বাংলাদেশ এখনো কৃষি প্রধান দেশ। কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, ৬০ ধরনের ২০০ জাতের সবজি ফলান এ দেশের কৃষক। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশে^র তৃতীয়। রপ্তানিকারকরা মনে করেন, বড় সম্ভাবনা সত্ত্বেও একাধিক কারণে গতি হারাচ্ছে সবজি রপ্তানি। অন্যদিকে বর্ধিত উৎপাদন ব্যয়ের কারণে কৃষকরা হচ্ছে দিশেহারা। এর মূল কারণ চারা ও বীজের দাম বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে পরিবহন খরচও। তাই দেশের কৃষকশ্রেণিকে টিকিয়ে রাখতে হলে তাদের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে এবং কৃষি পণ্যের রপ্তানি বাড়াতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তথ্যমতে, কৃষিপণ্য এবং প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য রপ্তানি উৎসাহিত করতে ১০ শতাংশ হারে নগদ সহায়তা দেওয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে। একসময় এই হার ২০ শতাংশ ছিল। পরে তা ১৫ শতাংশ করা হয়। সর্বশেষ গত জুলাইয়ে তা ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। এ দেশের অর্থনীতির মূল কাঠামো কৃষি খাতের ওপর নির্ভরশীল। তাই এ খাতে সঠিক প্রণোদনা, রপ্তানি বাড়াতে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া, তাজা ফলমূল ও শাকসবজি সংরক্ষণে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা সময়ের দাবি।

×