ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১০ অক্টোবর ২০২৪, ২৪ আশ্বিন ১৪৩১

কাজে ফিরেছেন শ্রমিকরা, বন্ধ কারখানাও আজ খুলে দেওয়া হবে

গার্মেন্টস শিল্পাঞ্চল গাজীপুর আশুলিয়া শান্ত

জনকণ্ঠ রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০০:২১, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪

গার্মেন্টস শিল্পাঞ্চল গাজীপুর আশুলিয়া শান্ত

ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসছে গার্মেন্টস শিল্পাঞ্চল

ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসছে গার্মেন্টস শিল্পাঞ্চল গাজীপুর ও সাভারের আশুলিয়া। রবিবার অধিকাংশ শ্রমিক কাজে ফিরেছেন। নতুন করে কোনো কারখানা বন্ধ করা হয়নি। তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে এখনো বন্ধ রয়েছে ২০টির মতো পোশাক কারখানা। আশা করা হচ্ছে, আজ সোমবারের মধ্যে সব কারখানাই খুলে দেওয়া হবে।

পোশাক খাতের মালিকদের ঘোষণা ছিল রবিবারের মধ্যে পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আজ সোমবার থেকে বন্ধ রাখা হবে কারখানা। তবে চলমান পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় স্বস্তি ফিরে আসছে এ খাতের উদ্যোক্তাদের। এ রিপোর্ট লেখার সময় বিজিএমইএ নেতারা জানিয়েছেন, আশুলিয়া পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে। 
উল্লেখ্য, চলমান শ্রমিক অসন্তোষের মধ্যে সাভারের আশুলিয়ায় শিল্পাঞ্চলে বেশ কিছুদিন ধরে অস্থিরতা বিরাজ করছিল। এর মধ্যে দফায় দফায় বৈঠকের পরও শ্রম পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছিল না। কোনো কারখানায় অস্থিরতা হলে ওই কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য শনিবার বন্ধের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বিজিএমইএ। এরই মধ্যে রবিবার পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। এদিন দুপুর পর্যন্ত অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ আছে ১৮টি কারখানা। আর দুটি কারখানায় সাধারণ ছুটি ছিল।

এদিকে চলমান শ্রমিক অসন্তোষ নিরসনের পরিপ্রেক্ষিতে শ্রম সংক্রান্ত অভিযোগ পর্যবেক্ষণ কমিটি শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ার কয়েকটি পোশাক কারখানা পরিদর্শন করেছেন। আশুলিয়া শিল্প পুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার মো. সারোয়ার আলম এসব তথ্য নিশ্চিত করেন। এদিকে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসায় স্বস্তি ফিরছে এ খাতে। এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএর পরিচালক আশিকুর রহমান তুহিন জনকণ্ঠকে জানান, আশুলিয়া পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসছে। ইতোমধ্যে বেশিরভাগ কারখানা খুলে দেওয়া হয়েছে।

যেগুলো এখনো বন্ধ আছে আশা করছি আজ সোমবারের মধ্যে খুলে দেওয়া হবে। তিনি বলেন, শ্রমিকরা কাজে ফিরে আসায় পোশাক খাতের মালিকদের মধ্যেও স্বস্তি ফিরে আসতে শুরু করেছে। 
জানা গেছে, গত শুক্রবার আশুলিয়ায় স্থানীয় নেতা ও মালিকদের সঙ্গে এক বৈঠকের পর বিজিএমইএ সকল পোশাক কারখানা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় পরদিন শনিবার এই অঞ্চলে সব মিলিয়ে ৪৯টি পোশাক কারখানা বন্ধ রাখা হয়। রবিবার বন্ধ কারখানার সংখ্যা কমে এসেছে ২০টিতে। এমনকি কোথাও কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। এদিন সকাল ৮টা থেকে খোলা কারখানার শ্রমিকরা বৃষ্টি উপেক্ষা করেই কর্মস্থলে যোগ দিয়ে উৎপাদন শুরু করেন।

শিল্পাঞ্চলে যে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে কারখানাগুলোর সামনে  মোতায়েন রয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ। এ ছাড়া যৌথ বাহিনীর টহলও অব্যাহত রয়েছে। শিল্প পুলিশ জানায়, কাজ শুরুর প্রথম ঘণ্টায় ৪-৫টি কারখানার শ্রমিকরা কারখানার ভেতরে মালিক পক্ষের সঙ্গে বিভিন্ন দাবির বিষয়ে আলোচনা করতে কাজ বন্ধ করে রাখলেও পরবর্তীতে এসব কারখানার শ্রমিকরাও কাজ শুরু করেছেন। শ্রম আইনের ১৩ (১) ধারায় বন্ধ থাকা কারখানাগুলোর মধ্যে রয়েছে জেনারেশন নেক্সট, সান সোয়েটার, মাসকট ফ্যাশন, পার্ল গার্মেন্টস, মনগো টেক্স, মারমা কম্পোজিট লিমিটেড ও জিনজিয়া ব্যাগ অ্যান্ড ক্যাপস লিমিটেড।

আশুলিয়া শিল্প পুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার মো. সারোয়ার আলম বলেন, আশুলিয়া এলাকায় ১ হাজার ৮৬৩টি কারখানা আছে। নতুন করে কোনো কারখানা বন্ধ হয়নি। আগের বন্ধ কারখানা থেকেই বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ১৩ (১) ধারায় ১৮টি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ এবং দুটি কারখানায় সাধারণ ছুটি রয়েছে। এর বাইরে শিল্পাঞ্চলের সকল কারখানায় স্বাভাবিক রয়েছে উৎপাদন। তিনি বলেন, গুটি কয়েক কারখানায় যে সমস্যা আছে, তা নিরসনে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। শ্রমিকদের কাজে ফেরাতে মালিক ও শ্রমিক উভয় পক্ষের সঙ্গে আলোচনা চলছে। আশা করি পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
এ ছাড়া শিল্পাঞ্চলের নিরাপত্তায় সতর্ক অবস্থানে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। যৌথ বাহিনীর টহল কার্যক্রমও অব্যাহত রয়েছে। এদিকে চলমান শ্রমিক অসন্তোষ নিরসনের পরিপ্রেক্ষিতে শ্রম সংক্রান্ত অভিযোগ পর্যবেক্ষণ কমিটি আশুলিয়ার কয়েকটি পোশাক কারখানা পরিদর্শন করেন। সকালে প্রথমে তারা নিশ্চিতপুর এলাকার অনন্ত গ্রুপ ও পরে হা-মীম গ্রুপে প্রবেশ করেন। ১১ সদস্যের কমিটির সদস্যরা কথা বলেন শ্রমিক মালিকসহ পোশাক খাতে জড়িত সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিদের সঙ্গে। 
পর্যবেক্ষণ কমিটির নেতৃত্বে থাকা শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সবুর হোসেন জানান, আশা করছি আরও দ্রুত পরিস্থিতির উন্নতি হবে। সব কারখানা ধীরে ধীরে খুলে দেওয়া হবে। কোনো দাবিতে সড়ক ও কাজ বন্ধ করার কোনো প্রয়োজন নেই। সকল অভিযোগ শুনতেই সরেজমিনে এসেছি। প্রয়োজনে হটলাইনেও জানাতে পারবেন অভিযোগ। শ্রম সংক্রান্ত অভিযোগ পর্যবেক্ষণ কমিটির সদস্যরা মালিক শ্রমিক উভয় পক্ষেরই অভিযোগ শুনে সরকারকে অবহিত করবেন।  যে সকল দাবি পূরণ করা যায় তা দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে। 
এ ছাড়া জনকণ্ঠের স্থানীয় রিপোর্টার জানিয়েছেন, রবিবার সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাইয়ের শিল্পাঞ্চলের পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ রয়েছে। আশুলিয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল আগের মতোই অব্যাহত আছে। অনেক কারখানার সামনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দেখা গেছে। 
বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক বাবুল আখতার বলেন, এবার পোশাক শ্রমিকদের অসন্তোষ যেভাবে আমলে নেওয়া হয়েছে, তা ঠিকঠাক হয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। মূল কথা হলো কারখানা চালু রেখে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এক ধরনের ইতিবাচক পরিবেশ আছে। এবার বিক্ষোভের শুরুতে কারখানায় দ্বিপক্ষীয় আলোচনা হয়েছে। এরপর ত্রিপক্ষীয় আলোচনা হয়েছে। সব মিলিয়ে এক ধরনের ইতিবাচক পরিবেশ আছে।
গাজীপুর : কারখানাগুলোতে কয়েকদিনের অস্থিতিশীল পরিবেশের পর রবিবার খুলে দেওয়া হয়েছে প্রায় পোশাক কারখানা। তবে অর্থনৈতিক সংকটে বেতন দিতে না পারাসহ নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন কারণে পাঁচ ভাগ কারখানা বন্ধ রয়েছে। কারখানা খুলে দেওয়ায় সকালে কাজে যোগ দিয়েছে আন্দোলনরতরাসহ পোশাক কারখানাগুলোর শ্রমিকরা। শ্রমিকরা কাজে যোগ দেওয়ায় টঙ্গী, কালিয়াকৈর ও শ্রীপুরসহ পুরো জেলার কারখানাগুলোতে কর্মচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে, স্বাভাবিক হয়েছে উৎপাদন কার্যক্রম। বিকেল পর্যন্ত নতুন করে রবিবার কোথাও শ্রমিক অসন্তোষের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। এদিকে সাভারের আশুলিয়ায় শিল্পাঞ্চলের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। খবর স্টাফ রিপোর্টার ও নিজস্ব সংবাদদাতার।
গাজীপুরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্য মোতায়েন ছিল। এছাড়াও বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য রোধে বিএনপি ও যুবদলের নেতা-কর্মীসহ শ্রমিক-মালিক ও এলাকাবাসী মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় পিকেটিং, মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে। 
গাজীপুর শিল্প পুলিশের এএসপি মোশাররফ হোসেন জানান, গাজীপুরের প্রায় ৯৫ ভাগ পোশাক কারখানা রবিবার হতে খুলে দেওয়া হয়েছে। শিল্পকারখানায় উৎপাদন কার্যক্রম স্বাভাবিক রয়েছে। নতুন করে আজ কোথাও শ্রমিক অসন্তোষের কোনো খবর আসেনি। তবে অর্থনৈতিক সংকট এর কারণে বেতন দিতে না পারায় কিছুসংখ্যক কারখানা বন্ধ রয়েছে, সেটা তাদের নিজস্ব সমস্যা। 
পুলিশ, কারখানা ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কারখানা খুলে দেওয়ার ঘোষণায় রবিবার সকাল থেকেই বৃষ্টি উপেক্ষা করে পোশাক কর্মীরা তাদের নিজ নিজ কর্মস্থলে যোগ দিতে দেখা গেছে। কারখানার নিরাপত্তা রক্ষায় নিজস্ব কর্মী ছাড়াও শিল্প পুলিশ মোতায়েন রাখা হয়েছে। সেনাবাহিনীর ও বিজিবি সদস্যদের দিনভর গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় টহল দিতে দেখা গেছে।
তারা আরও জানান, গত সপ্তাহে গাজীপুরের বেশকিছু কারখানায় বেতন-ভাতার দাবিতে বিক্ষোভ চলে। এতে থমথমে অবস্থা বিরাজ করে শিল্প-নগরীতে। তারা নানা অজুহাতে সড়ক অবরোধ, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ, হামলা ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। এতে পোশাক কারখানাসহ বিভিন্ন কারখানা বন্ধের উপক্রম হয়। অনেকটা অসহায় হয়ে পড়ে কারখানার মালিক পক্ষ। শ্রমিক বিক্ষোভের এ পরিস্থিতিতে জেলার বেশকিছু কারখানা পর্যায়ক্রমে ছুটি ও অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। এর প্রেক্ষিতে শিল্প কারখানায় বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য প্রতিরোধ করতে বিএনপি ও যুবদলের নেতা-কর্মীসহ স্থানীয় শ্রমিক-মালিক ও এলাকাবাসী মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় পিকেটিং ও সমাবেশ করলে আন্দোলনকারীরা পিছু হটে। রবিবার সকালে শ্রমিকরা কাজে যোগ দিলে কারখানাগুলোতে কর্মচাঞ্চল্য পুনরায় ফিরে আসে। এদিন শ্রমিক আন্দোলনের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে এদিন বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশ, র‌্যাব ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা সকাল থেকে মোতায়েন ছিল। তারা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে দিনভর কারখানা এলাকায় টহল দেয়। 
গাজীপুরের শিল্প পুলিশের (শ্রীপুর জোন) এস আই রায়হান মিয়া বলেন, শ্রীপুরে সকালে এস কিউ কারখানায় আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। পরে তাদের বুঝিয়ে কাজে পাঠানো হয়েছে। তাছাড়া অন্য কোনো ঘটনা নেই। 
বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড শিল্প শ্রমিক ফেডারেশন, গাজীপুর মহানগর কমিটি সভাপতি শফিউল আলম বলেন, শ্রমিকরা কর্মস্থলে ফিরে উৎপাদন চালু করেছে। এখন শিল্প অঞ্চলে স্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করছে। 
জেনফার বাংলাদেশ লিমিটেড ওষুধ কারখানার চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান বলেন, কারখানা চালু রয়েছে। কোনো সমস্যা নেই। 
গাজীপুরের মহানগরীর পূবাইলে এপিএস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামীম রেজা বলেন, গত কিছুদিন শ্রমিকরা আন্দোলন করেছেন। কারখানা বন্ধ ছিল। রবিবার সকাল থেকে কারখানা খোলা। আমাদের অবস্থা খুব খারাপ। অর্থনৈতিক সংকট চরমে। সরকার ঘোষণা অনুযায়ী ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ব্যাংক লোন দেয়নি। 
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর গাজীপুর জেলা কার্যালয়ের তথ্যমতে, পুরো জেলায় সব মিলিয়ে নিবন্ধিত কারখানা রয়েছে ২ হাজার ৬৩৩টি। এসব কারখানায় শ্রমিক কাজ করেন প্রায় ২২ লাখ।

×