ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৮ মে ২০২৫, ১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

হারিকেনের বিদায় কি কেবল প্রযুক্তির জয়, নাকি গ্রামীণ সময়বোধের মৃত্যু?

তানিম মল্লিক, কনট্রিবিউটিং রিপোর্টার, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত: ১১:২৫, ২৭ মে ২০২৫

হারিকেনের বিদায় কি কেবল প্রযুক্তির জয়, নাকি গ্রামীণ সময়বোধের মৃত্যু?

ছবি: জনকণ্ঠ

একটা সময় ছিল, যখন সন্ধ্যা নামলেই উঠোনজুড়ে জ্বলে উঠত একেকটা প্রাণ। কাঁচের ঘেরাটোপে জ্বলত আগুনের নরম শিখাতার নাম হারিকেন। একধরনের কেরোসিনচালিত বাতি, যার ভিতরে সলতে জ্বালিয়ে লোহার কাঠামোয় আলো জ্বালানো হতো। শুধু আলো নয়সে ছিল সময়চেতনার প্রতীক, পারিবারিক গল্পের শ্রোতা, নিঃশব্দ সঙ্গী। সেই আলোয় রান্না হতো, শিশুরা বই পড়ত, আর বাড়ির বড়রা গল্প করতেন সেই নির্ভরতার ভাষায়।

আজ আর সেই আলো জ্বলে না। হারিকেন এখন শুধুই জাদুঘরের জিনিস, পুরনো দিনের দীর্ঘশ্বাস। খুলনার রূপসায় এক খড়ের ঘরে রাখা আছে একটি ধুলোধরা হারিকেন। ৮৫ বছর বয়সী মোতাহার হোসেন বলেন, “এটা আমার বাবার সময়ের। এখন আর জ্বালানো হয় না, কিন্তু এটা দেখলেই মনে পড়েসন্ধ্যা মানেই হারিকেন, মানেই মানুষ হওয়া।তার কণ্ঠে ছিল স্মৃতির ভার, চোখে এক ধরনের আর্দ্রতাযেটা হয়তো শুধু আলোর নয়, সময়ের প্রস্থানেরও দাগ।

প্রযুক্তির উজ্জ্বল আলোর কাছে হেরে গেছে হারিকেনের মৃদু দীপ্তি। বিদ্যুৎ, চার্জার লাইট, মোবাইলের ফ্ল্যাশসবকিছু মিলিয়ে আমরা যেন এতটাই আলোকিত হয়ে গেছি, যে চোখের গভীরতা হারিয়ে ফেলেছি। আর সেই সঙ্গে হারিয়ে গেছে ধীরতা, অপেক্ষা আর আন্তরিকতার বাতাস।

হারিকেন নিভেছে ঠিকই, কিন্তু তার সঙ্গে নিভে গেছে অনেক কিছুনিভে গেছে উঠোনে বসে গল্প করার সংস্কৃতি, নিভে গেছে ঠাকুরমার মুখ থেকে ছড়া শোনার বিকেল, নিভে গেছে চুপচাপ বসে থাকার অবসর।

নাসিমা খাতুন, জোয়ার গ্রামের এক ষাটোর্ধ্ব গৃহিণী জানান, হারিকেনে কেরোসিন দিতে গিয়ে হাতে গন্ধ লেগে থাকত। কিন্তু সেই গন্ধেই ছিল সংসারের ঘ্রাণ। এখন বিদ্যুতের আলোতে রান্না করেন ঠিকই, কিন্তু সেই গন্ধ, সেই অনুভূতি আর পান না।

হারিকেন ছিল আলো, কিন্তু তার মধ্যে ছিল অপেক্ষা, ছিল ধৈর্য। সে সময়কে ধীরে চলতে শেখাত। আর এখন? এখন সময় দৌড়ায়, আলো ঝলমল করে, কিন্তু মানুষ একা। সবাই যার যার পর্দায় বন্দি। হারিকেনের আলো হয়তো চোখে ধরা পড়ত কম, কিন্তু সে আলো ছুঁতে পারত হৃদয়।

হারিকেন নিভে গেছেএটা নিছক এক প্রযুক্তির অগ্রগতির গল্প নয়। এটা এক সময়ের মৃত্যু, এক সংস্কৃতির বিদায়, এক নীরব শোক। শহরের আলোয় আমরা হয়তো অনেক দূর এগিয়ে গেছি, কিন্তু হারিয়ে ফেলেছি সেই কুয়াশা-ছোঁয়া প্রান্তরের বিকেল, হারিয়ে ফেলেছি হারিকেনের শিখায় জ্বলজ্বলে পরিবারগুলোর কোমলতা।

প্রযুক্তি আমাদের জীবনে গতি এনেছে, আলো এনেছে, কিন্তু আমরা কি সেই আলোয় নিজেদের মুখ এখনো চিনতে পারি? হয়তো সময় এসেছে আলো নয়আলোর মানুষগুলোকে খুঁজে নেওয়ার, আবারও একসাথে বসে গল্প বলার, আর হারিয়ে যাওয়া সেই সময়বোধকে অন্তত স্মৃতির ভেতর বাঁচিয়ে রাখার।

মুমু

×