ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৬ মে ২০২৫, ১২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

প্যারিসেই হতে যাচ্ছে শিল্পী তুফান চাকমার প্রথম একক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী

হাবিবুর রহমান সুজন, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, খাগড়াছড়ি

প্রকাশিত: ০৮:১০, ২৬ মে ২০২৫

প্যারিসেই হতে যাচ্ছে শিল্পী তুফান চাকমার প্রথম একক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী

ছবি: জনকণ্ঠ

মাধ্যমিকে পাঠ্যবইয়ে অন্নদাশঙ্কর রায়েরপারীপড়ে প্রথম জেনেছিলেন প্যারিসের কথা। সেই থেকে মনের কোণে স্বপ্নের নগরী হিসেবে জায়গা করে নেয় প্যারিস। সোমবার (২৬ মে) সেই প্যারিসেই হতে যাচ্ছে শিল্পী তুফান চাকমার প্রথম একক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী।

শিরোনাম ‘Lullabies of the Hill বা পাহাড়ের ঘুমপাড়ানি গান জলরং, স্কেচ, তেলরং, ডিজিটাল পেইন্টিংসহ বিভিন্ন মাধ্যমে করা মোট ৩০টি শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে। আছে অ্যানিমেশন ভিডিও। আয়োজক ফ্রান্সে বসবাসরত  সংগঠন ‘La Voix des Jummas বা জুম্মদের কণ্ঠস্বর

এর আগে বেশ কয়েকটি দলীয় প্রদর্শনীতে অংশ নেন তুফান। তবে একক প্রদর্শনী এই প্রথম। তাও প্যারিসের মতো জায়গায়। তুফানের জন্য তা কল্পনা আর বাস্তবের মিশেল এক অনুভূতি।

আঁকার খাতাও ছিল না: তুফানের জন্য খাগড়াছড়ির দীঘিনালার দুর্গম উদালবাগান থেকে এত পথ পাড়ি দেওয়া মোটেও সহজ ছিল না। কৃষক পরিবারে জন্ম তুফানের। মা-বাবা ভাইকে নিয়ে সংসার। অভাবের সঙ্গে লড়ে বড় হয়েছেন।

শৈশবে পাহাড়ি ঝিরির জলের কলকল, ঘন সবুজ বনের শ্যামল ছায়া, হরেক পাখির ডাক, মেঘেদের ছোটাছুটি, শেষ বিকেলে সূর্যের লুকিয়ে পড়ার রূপ দেখে কাটত দিন। হাতের কাছে যা পেতেন, তাতেই ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করতেন সেসব। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কোথাও আঁকা শেখার সুযোগ পাননি। নিজে নিজেই আঁকতেন। ছিল না কোনো আঁকার খাতা। তাই বলে তুফান থেমে থাকেননি। আঁকতেন পাঠ্যবইয়ের ফাঁকা জায়গায়।

তুফান বলেন, ‘একদম প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম আমার। আসলে বিষয়ে যে কারো কাছে গিয়ে বা কোথাও ভর্তি হয়ে শেখা যায়, সেটাই তো জানতাম না। নিজে নিজেই আঁকতাম।আঁকাআকির ব্যাপারে বন্ধুরা সবসময় উৎসাহ যোগাত। তবে মা শোভা রানী চাকমা চেয়েছিলেন, ছেলে যেন একাডেমিক পড়াশোনায় ভালো করে।

গ্রাম থেকে শহরে: পড়াশোনায় বরাবরই ভালো তুফান। ২০১২ সালে উদাল বাগান হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন তুফান। এরপর অনেক দূরে খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজে ভর্তি হন। গ্রাম ছেড়ে এই প্রথম তাঁর শহরে যাত্রা। ২০১৪ সালে জিপিএ পেয়ে এইচএসসি পাশ করেন।

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিযুদ্ধের সূত্রেই ঢাকায় প্রথম আসেন তুফান। পড়তে চেয়েছিলেন সাংবাদিকতা নিয়ে, সুযোগ মিলল চারুকলায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পেইন্টিংয়ে ভর্তি হলেন। উদাল বাগান গ্রাম থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া প্রথম তরুণ তুফান। তবে ঢাকার জীবনে মানিয়ে নিতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। বিশেষ করে ভাষাগত সমস্যা নিয়ে ভুগেছেন বেশি। অর্থনৈতিক সমস্যা ভুগিয়েছিল আরো বেশি। তুফানের ভাষায়কতবেলা যে না খেয়ে থেকেছি তার হিসাব নাই।টিউশনি করে যুগিয়েছেন পড়ার খরচ।

সমস্যা সম্ভাবনার গল্প: আঁকাআঁকিতে সত্যিকারের মনোযোগ দিতে পারেন ক্যাম্পাসে দ্বিতীয় বর্ষের শেষের দিকে। ক্যাম্পাসে সহপাঠীদের সঙ্গে মিশতে গিয়ে বুঝলেন, তাঁরা চাকমা নৃগোষ্ঠী সম্পর্কে অনেক কিছুই জানেন না। তুফানও নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে খুব একটা সচেতন ছিলেন না। ফলে ধীরে ধীরে এসব বিষয়ে পড়তে থাকেন।

২০১৭-১৮ সালের দিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের তখনকার পরিস্থিতি নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছিল তুফানকে। চারুকলার শিক্ষার্থী হিসেবে তাঁর মধ্যে তখন একধরনের বোধ জেগে উঠেছিল নিজেদের সংকট, সংগ্রামের কথা শিল্পমাধ্যমে বলার। তখন সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে বেছে নেন শিল্পমাধ্যমকে।

সেই থেকে পাহাড়ের গল্প বলছেন ডিজিটাল মাধ্যমে। ২০২০ সালে খোলেন নিজের ফেসবুক পেজতুফান আর্টবিন। নিজের আঁকা ছবিগুলো প্রকাশ করতে থাকলেন সেখানে। সেটা প্রকাশ করেন তাঁর ফেসবুক পেজে—‘তুফান আর্টবিন’-এ। সেখানে তাঁর অনুসরণকারীর সংখ্যা লাখের বেশি। দীর্ঘদিন ধরে আঁকছেন চাকমাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর সংস্কৃতি, ইতিহাস ঐতিহ্যকে বিষয় করে। তুলে ধরছেন তাদের সমস্যা সম্ভাবনার না বলা গল্প।

ইউরোপ যাত্রা: ২০২৩ সালে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন তুফান। এরপর আবেদন করেন ইরাসমাস মণ্ডুজ স্কলারশিপের জন্য। ফুল ফান্ডেড সেই স্কলারশিপের অধীনে বেলজিয়ামের লুকা স্কুল অব আর্টস, ফিনল্যান্ডের আলটো ইউনিভার্সিটি আর পর্তুগালের ইউনিভার্সিটি অব লুসোপনায় দুই বছর মেয়াদি মাস্টার্সের সুযোগ পেলেন। বিষয় অ্যানিমেশন। এখন তিনি ফিনল্যান্ডে মাস্টার্সের সেকেন্ড সেমিস্টারে অধ্যয়নরত। পড়ালেখার পাশাপাশিতুফান আর্টবিন’- নিয়মিত সরব থাকেন আর্টওয়ার্ক দিয়ে। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সংকটের কথা বলেন।

এবার প্যারিসে: প্যারিসে তুফানের প্রদর্শনীর আয়োজক La Voix Des Jumma সংগঠনটির সঙ্গে তুফানের পরিচয় ইউরোপে আসার পর। মূলত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুফানের কাজ দেখে প্রদর্শনী আয়োজনে আগ্রহ দেখায় তারা। এতে সাড়া দিয়ে তিনি ক্যানভাস রঙিন করেছেন জুম্ম সংস্কৃতি, জীবনযাত্রা, ঐতিহ্য এবং সংগ্রামের ইতিহাস, বর্তমান ভবিষ্যতের পথরেখায়।

 

তুফান বললেন, “এই প্রদর্শনীর মূল সুর একটি হারাতে বসা সংস্কৃতির মৃদু অথচ গভীর আর্তি।পাহাড়ে ঘুম পাড়ানির গানএই নামের ভেতরে লুকিয়ে আছে আমাদের জনজাতির মা-মাটির সম্পর্ক, ঘুমপাড়ানি গান যা বিলুপ্তপ্রায় অস্তিত্বের সুরে কথা বলে। পাহাড় এখানে কেবল প্রাকৃতিক দৃশ্য নয়, বরং একটি জীবন্ত সত্তা, যে নিজেই গাইছে তার যন্ত্রণার সুরধ্বংস, লোভ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। বিভিন্নভাবে অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে পাহাড়ের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা, সেসব কথাই প্রদর্শনী বলবে।

মোট দুই পর্বে হবে প্রদর্শনী। প্রথম পর্বে ২৬ মে থেকে জুন পর্যন্ত প্যারিসের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং আইফেল টাওয়ারে প্রদর্শিত হবে তুফানের চিত্রকর্মগুলো। পরের পর্বে ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ ফ্রান্সের কমিউন মোরেট-লোইং-এট-অরভান (Moret-Loing-et-Orvanne)-এর সাল্লে রোলান্ড ড্যাগনাউড হলে প্রদর্শিত হবে তুফানের ছবি। মধ্যযুগীয় স্থাপত্য বিখ্যাত ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পী আলফ্রেড সিসলির চিত্রকর্মের জন্য প্রসিদ্ধ এই শহরটি লোয়িং নদীর তীরে অবস্থিত।

প্যারিসে সন্তানের প্রদর্শনীর খবর শুনে দারুণ খুশি মা শোভা রানী চাকমা। ভাঙা ভাঙা বাংলায় বললেন, ‘তুফানের কাছে শুনেছি, অনেকে তাঁর আঁকা ছবি দেখবে। বিদেশেও সবাই ওকে উৎসাহ দিচ্ছে, ভালবাসা দিচ্ছে। এটা ভালো লাগছে।

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি: তুফানের অর্জনের ঝুলি ভারি হয়েছে আঁকাআঁকির বদৌলতে। ২০২৩ সালে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পায় তাঁর ছবি। পাহাড়িদের জীবনাচরণ তুলে ধরে আঁকা ছবির জন্য সেবার জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় আয়োজিতইন্টারন্যাশনাল আর্ট কনটেস্ট ফর মাইনরিটি আর্টিস্ট ২০২৩ পুরস্কার পেয়েছেন। তুফানের শিল্পী জীবনের এই গৌরবময় অর্জন নিয়ে সে বছরের।

একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে পরের বছর তিনি পেলেন নেদারল্যান্ডসের প্রিন্স ক্লজসিড অ্যাওয়ার্ড ২০২৪ বিরূপ পরিস্থিতিতেও সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে নিজেদের সামাজিক রাজনৈতিক সমস্যাগুলো তুলে ধরেনএমন তরুণদের পুরস্কারটি দিয়ে থাকে নেদারল্যান্ডস-ভিত্তিক প্রিন্স ক্লজ ফান্ড। এই পুরস্কার সংস্কৃতি, শিল্পকলার চর্চা মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয়, বিশেষ করে যেখানে ধরনের চর্চা অবহেলিত বা একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে রয়েছে।

মানুষের কথা বলতে চান: শিল্পকর্মের মাধ্যমে নিপীড়িত মানুষের কথা বলতে চান তুফান। তাঁর কথা, ‘আমাদের অধিকার নিয়ে নতুন প্রজন্ম তথা বৃহত্তর জাতিগোষ্ঠীকে অবগত করতে চাই, যেগুলো অনেকে বলতে বা দেখাতে চায় না। এমন কিছু করতে চাই, যা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।

মুমু

×