
ছবি: জনকন্ঠ
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকালটা অন্যরকম। যেন কোনো কবি প্রতিদিন নতুন করে আঁকেন এই প্রাঙ্গণের ছবি। ভোরের শান্ত আভা, পাখিরা ডেকে ওঠে গাছের ডালে, আর শিক্ষার্থীদের চোখে জেগে ওঠে নতুন আশার আলো। সেই সকালের দৃশ্যপটে দাঁড়িয়ে থাকে এক ছোট্ট চায়ের দোকান। দৃষ্টিতে পড়ে না সহজে, নেই কোনো উঁচু ছাদ কিংবা ঝকঝকে সাইনবোর্ড, তবুও এই দোকানের নাম মুখে মুখে ফেরে- তপনদার চায়ের দোকান।
তপন কুমার পাল। পঞ্চাশ পেরোনো বয়স হলেও তপনদার মুখে থাকে এক প্রশান্ত দীপ্তি, চোখে থাকে স্মৃতির উজ্জ্বল ঝিলিক, আর কণ্ঠে ঝরে পড়ে মায়ার আবরণ। যিনি জানেন এক কাপ চা কেবল একটি পানীয় নয়, এটি এক নিরব ভাষা, যেখানে অনুযোগ নেই, কিন্তু অনুভব আছে।
১৯৯১ সালের নরম আলোয় মোড়ানো এক সকালের কথা। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখনো পাকা দালান ওঠেনি। নির্মাণাধীন ভবনের পাশে, ধুলোমলিন এক প্রান্তে, একটা টিনের চালা, একটা কাঠের বেঞ্চ আর একটা পুরোনো কেটলি নিয়ে যাত্রা শুরু তপনদার। সেই শুরু এক পরম নিবেদন, এক নিঃশব্দ প্রেম যা ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ে শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে।
তিনি ব্যবসায়ী নন, তিনি বরং শিক্ষার্থীদের চোখে একজন নির্ভরতার প্রতীক। কোট-টাই নয়, পরনে সাদা লুঙ্গি ও শার্ট , পায়ে স্যান্ডেল, আর হাতে কেটলি এই তার পরিচয়। এই সাধারণ পোশাকের আড়ালেই লুকিয়ে আছে এক অসাধারণ মানুষ। তিনি বলেন, “ শিক্ষার্থীরা আমার কাছে শুধু চায়ের ক্রেতা নয়, ওরা আমার আপনজন। আমি চা বানাই ঠিকই, কিন্তু তার চেয়েও বেশি বানাই ভালোবাসা। কার চোখে ক্লান্তির ছায়া, কার মুখে স্বপ্নের আলো সবই বলে দেয় এক কাপ চা।”
অর্থনীতি ডিসিপ্লিনের শিক্ষার্থী সঞ্জীব দাস বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার বাইরে, জীবনের অমূল্য পাঠ পেয়েছি তপনদার দোকানে বসে। তার কাছে চা নয়, শিখেছি সহানুভূতি, মানুষের মন বোঝার শিল্প এবং জীবনকে নতুন দৃষ্টিতে দেখার কৌশল।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রজন্ম বদলায়, আসে নতুন মুখ, চলে যায় পুরোনো নাম। কিন্তু তপনদা থেকে যান। একই হাসি, একই স্বর, একই চায়ের স্বাদ। যেন কোনো অলিখিত বন্ধন, কোনো অতুলনীয় বিশ্বাস,যা সময়ের সাথে আরো দৃঢ় হয়। এই দোকান যেন এক জীবন্ত পাঠশালা, যেখানে পাঠ্যসূচি নেই, তবুও চলে পাঠ। যেখানে বই নেই, তবুও শেখা হয় জীবনের গভীরতম দর্শন।
সমাজবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের শিক্ষার্থী মিনারুল হাসান জানান, তপনদার হাসি আমার মনকে সবসময় উজ্জীবিত করত। ক্লান্ত দিনে, তার এক কাপ চা আর মিষ্টি কথায় সব কষ্ট যেন উধাও হয়ে যেত।
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আসল সৌন্দর্য তার দালান-কোঠাতে সীমাবদ্ধ নয়,বরং তার মানুষদের মধ্যে। এই মানুষরাই গড়ে দেন শত শত শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ। তপনদা তেমনই একজন যিনি কোনো পঠন-পাঠনের দায়িত্বে নেই, কোনো সিনেট মেম্বার নন, তবুও ছাত্রজীবনের অনিবার্য অংশ হয়ে আছেন , যাকে বাদ দিলে বিশ্ববিদ্যালয়কে অসম্পূর্ণ মনে হয়।
মুমু