ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৫ মে ২০২৫, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

উত্তরাঞ্চলের চিনি মসজিদ

মর্মর পাথর, চীনা মাটি ও ইট-সুরকির তৈরি, অপরূপ নির্মাণশৈলী

তাহমিন হক ববী

প্রকাশিত: ২২:০৪, ২৩ আগস্ট ২০২৪

মর্মর পাথর, চীনা মাটি ও  ইট-সুরকির তৈরি,  অপরূপ নির্মাণশৈলী

নীলফামারীর সৈয়দপুরের ইসলামবাগে চিনি মসজিদের সৌন্দর্য দর্শনে ছুটে আসেন দেশ-বিদেশের পর্যটক

চিনি মসজিদের রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। মসজিদটি ইট সুরকি দিয়ে নির্মিত। মসজিদে লাগানো আছে ২৪৩টি শংকর মর্মর পাথর, পাথরের সঙ্গে মসজিদের গায়ে লাগিয়ে দেওয়া হয় ২৫ টনের মতো চীনা মাটির টুকরা। বলা হয় দেওয়ালের ওপর চীনা মাটির থালার কাচের ভগ্নাংশ বসিয়ে কারুকাজ করা হয়েছে। পদ্ধতিটি চিনি করা বা চিনি দানার কাজ করা বলে পরিচিত। সেই থেকেই মসজিদটির নাম হয়েছে চিনি মসজিদ। ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদটি অঞ্চলের অন্যতম প্রাচীন মসজিদ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে। চিনি মসজিদ শুধু উপাসনালয় নয়, এই মসজিদ অতীত ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতীকও বটে।

উত্তরাঞ্চলের রংপুর বিভাগের জেলা নীলফামারী। জেলার উপজেলা সৈয়দপুর। বাংলাদেশের প্রাচীন শহরগুলোর মধ্যে এই শহরটি ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য অনেক আগে থেকেই প্রসিদ্ধ। এখানে রয়েছে অসম বেঙ্গল রেলওয়ের গড়ে তোলা সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা। এই শহরের প্রাচীন সৌন্দর্যের স্থাপত্য নিদর্শন রয়েছে অনেক। তার মধ্যে  চিনি মসজিদ অন্যতম, যা অনেকের কাছে চীনা মসজিদ নামে বেশি পরিচিত। সৈয়দপুর রেলস্টেশনের পূর্ব দিকে রেললাইনের সমান্তরালে যে রাস্তা সোজা ওয়াপদা এলাকায় হাইওয়ের সঙ্গে মিশেছে, সেই রাস্তা ধরে কিছুটা এগোলে পড়বে খ্রিস্টানদের কবরস্থান। জায়গাটির নাম ইসলামবাগ। এখানে কবরস্থানটির ঠিক পাশে ইতিহাসের গল্পের মতো দাঁড়িয়ে আছে চিনি মসজিদ। চিনি মসজিদটির ইমাম খতিব মাওলানা সাঈদ রেজা   মসজিদ পরিচালনা কমিটির বর্তমান সভাপতি সৈয়দপুর পৌরসভার সাবেক প্যানেল মেয়র হিটলার চৌধুরী।

বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে মুঘল শাসক অন্যান্য মুসলিম নবাবদের হাতে নির্মিত অনেক মসজিদ কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এটিই একমাত্র মসজিদ যা এলাকাবাসী সর্বসাধারণের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় নির্মিত হয়ে ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। মসজিদের নিজস্ব সম্পত্তি বলতে আছে ১২টি দোকান। এসব দোকানের ভাড়া মুসল্লিদের অর্থ সহায়তায় দিয়ে মসজিদের সব ব্যয় উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড পরিচালনা করা হয়।

মসজিদ সুদীর্ঘ ইতিহাস বলছে ১৮৬৩ সালে হাজী বাকের আলী হাজী মুকু নামের দুজন ধর্মপ্রাণ বাসিন্দা সৈয়দপুর শহরের ইসবাগ এলাকায় ছন বাঁশ দিয়ে প্রথমে মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। পরবর্তীতে এলাকাবাসীর সহায়তায় তা টিনের ঘরে রূপান্তরিত হয়।১৯২০ সালে হাজি হাফিজ আবদুল করিমের উদ্যোগে মসজিদটির প্রথম অংশ পাকা করা হয়। পরে এলাকার লোকেরা মসজিদটি নির্মাণের লক্ষ্যে একটি তহবিল গঠনে উদ্যোগী হয়। এরই প্রেক্ষিতে স্থানীয়রা তাদের মাসিক আয়ের একটি অংশ দান করে মসজিদ নির্মাণের জন্য একটি তহবিল গঠন করেন। এরপর শুরু হয় মসজিদের নির্মাণ কাজ।

লোকমুখে শোনা যায়, শঙ্কু নামের জনৈক হিন্দু রাজমিস্ত্রি দৈনিক ১০ আনা মজুরিতে মসজিদের নির্মাণ কাজ নতুনভাবে শুরু করেন। স্থানীয় এলাকাবাসী স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে তাকে সাহায্য করতে থাকে। মসজিদের সৌন্দর্য বাড়াতে মসজিদের দেওয়ালে চীনা মাটির থালার ভগ্নাংশ কাচের ভগ্নাংশ বসানো হয়। এই পদ্ধতিকে বলা হয় চিনি করা বা চিনি দানার কাজ করা। এখান থেকেই মসজিদের নাম হয়- চিনি মসজিদ বা চীনা মসজিদ। ১৯৬৫ সালে বগুড়ার একটি গ্লাস ফ্যাক্টরি চিনি মসজিদের জন্য প্রায় ২৫ টনের মতো চীনা মাটির পাথর দান করেছিল। ছাড়া সে সময় কলকাতা থেকেও ২৪৩ খানা শংকর মর্মর পাথর এনে লাগানো হয় এই মসজিদে।ঐতিহাসিক এই মসজিদের নকশা করেন মো. মোখতুল নবী বক্স। মসজিদের অনন্য কারুকার্যে সত্যিই মুগ্ধ হতে হয়। মসজিদের দেওয়ালে অঙ্কিত ফুলদানি, ফুলের ঝাড়, গোলাপ ফুল, একটি বৃত্তে একটি ফুল, চাঁদতারাসহ নানা চিত্র রয়েছে। মসজিদ তৈরিতে প্রচুর মার্বেল পাথর ব্যবহার করা হয়েছে। চিনি মসজিদের সৌন্দর্য দেশ-বিদেশের প্রচুর পর্যটককে আকর্ষণ করে বলেই তারা ছুটে আসেন। নিজ চোখে না দেখলে চিনি মসজিদের সৌন্দর্য উপলব্ধি করা যাবে না।

এই মসজিদের পেছনে রয়েছে খ্রিস্টানদের প্রাচীন একটি কবরস্থান।মসজিদে ২৪৩টি শংকর মর্মর পাথর রয়েছে। রয়েছে ছোট ছোট ৩২টি মিনারসহ ৩টি বড় গম্বুজ। মসজিদে একসঙ্গে প্রায় পাঁচ শতাধিক লোক নামাজ আদায় করতে পারেন।

এই মসজিদে রয়েছে উত্তর দক্ষিণে দুটি ফটক। মসজিদের গোটা অবয়ব রঙিন চকচকে পাথরে মোড়ানো। আর বারান্দা বাঁধানো সাদা মোজাইকে। মসজিদের দোতলায় একটি ভবনসহ একটি মেহমানখানা আছে। সেখানে পর্যটকদের জন্য থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও আছে।

×