ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৮ ভাদ্র ১৪৩১

মৃত্যুতেও অমলিন প্যাটেল

স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের হয়ে অনন্য কীর্তি

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ০০:১১, ১১ আগস্ট ২০২৪

স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের হয়ে অনন্য কীর্তি

স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের (ইনসেটে) প্রধানতম সংগঠক সাইদুর রহমান প্যাটেল। জীবনের শেষ দিকে তোলা ছবি

বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস কতভাবে যে লেখা হয়েছিল! যে যার জায়গা থেকে দেশের জন্য অবদান রাখার চেষ্টা করেছেন। একই সময় প্যাটেল, মানে, সাইদুর রহমান প্যাটেল ছিলেন ঢাকার নামকরা ফুটবলার। অগত্যা ফুটবলকেই আশ্রয় করেন তিনি। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গঠনের মূল কাজটি যারা করেছিলেন, প্যাটেল ছিলেন তাদের অন্যতম।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের বিভিন্ন জায়গায় প্রীতি ম্যাচে অংশ নেয় এই দল। খেলার মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত সৃষ্টি করেন ফুটবলাররা। সেই সঙ্গে প্রবাসী সরকারের জন্য তহবিল গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। 
তবে উজ্জ্বল ইতিহাসের অন্যতম নায়ক প্যাটেল নীরবে জীবনযাপন করেছেন। ন¤্র স্বভাব ছিল। কথা বলতেন কম। মৃত্যুও খুব নীরবে হলো তাঁর। গত ৮ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যু বরণ করেন। তবে মৃত্যুতেও অমলিন প্যাটেল। 
সাইদুর রহমান প্যাটেলের আদি বাড়ি ছিল ঢাকার গেন্ডারিয়ায়। তার সঙ্গে এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্যাটেল নামে সবাই এখনো তাকে চেনেন। এই পরিচিতি এনে দিয়েছিল ফুটবল। ষাটের দশকের মধ্যভাগে আলোচিত ইস্টএন্ড ক্লাবের হয়ে খেলতেন তিনি। ১৯৬৮ সালে দ্বিতীয় বিভাগে খেলেন ফরাশগঞ্জের হয়ে। ’৭০ সালে প্রথম বিভাগে খেলেন পিডব্লিউডির হয়ে। এরই ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গঠনের সঙ্গে যুক্ত হন। খেলা শুরু করেন।   
মৃত্যুর কয়েক বছর আগে বীর এই মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে দীর্ঘ সময় আলাপের সুযোগ হয়েছিল। ঢাকার বাসায় বসে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গঠনের ইতিহাস এবং অর্জনের কথা তুলে ধরেছিলেন তিনি। গুলশানের বাসাজুড়েই ছিল একাত্তরের আলোকচিত্র। সাদা-কালো ছবিতে অবিস্মরণীয় সব মুহূর্ত। তিনি সেগুলো দেখিয়ে সময়টা ব্যাখ্যা করছিলেন। 
সাইদুর রহমান প্যাটেলের স্মৃতি ছিল প্রখর। যুদ্ধ দিনের স্মৃতি হাতড়ে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গঠনের আগা গোড়া বর্ণনা করেন তিনি। খুঁটিনাটি তথ্য তুলে ধরে বলেন, আমি আসলে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। এ জন্যই সীমান্ত পাড়ি দিয়েছিলাম প্রথমে। সঙ্গে ছিলেন মহসিন সাহেব, লুৎফর রহমান ও মুজিবর রহমান ভুঁইয়া। একসঙ্গে কলকাতায় ঢুকেছিলাম আমরা।

কিন্তু গল্পে আলাপে হঠাৎ করেই ফুটবল টিম গঠনের চিন্তা চলে আসে মাথায়। সঙ্গে থাকা তিনজনই ছিলেন রাজনীতির মানুষ। তারাও যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এ অবস্থায় আমি ফুটবল দল গঠনের প্রস্তাব দিলে তাঁরা প্রথমে ভীষণ অবাক হয়ে যান। যুদ্ধের মধ্যে খেলাধুলা, এটা তাদের কাছেও প্রথমে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল। পরে সবাই দল গঠনের পক্ষে মত দিলে কাজ শুরু হয়।        
প্যাটেল জানান, মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী এএইচএম কামারুজ্জামানের সঙ্গে তারা দেখা করেন। একটি দরখাস্ত রাখেন তার টেবিলে। সব শুনে তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে যান কামারুজ্জামান। শুধু কি তাই? প্যাটেল বলেন, স্বাধীন বাংলা সরকারের পক্ষ থেকে তিনি নিজস্ব ক্ষমতাবলে আমাদের চারজনকে ৮০০ টাকাও প্রদান করেন।

পরে ৮ নম্বর থিয়েটার রোড গিয়ে সরকার প্রধান তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে কথা বলি আমরা। তিনিও পরিকল্পনার কথা জেনে উৎসাহ দেন। দল গঠনের প্রাথমিক কাজ করতে তাঁর পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয় বলে জানান প্যাটেল।  
শুরুতে নামটি অবশ্য ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’ ছিল না। ১৯৭১ সালের ১৩ জুন গঠন করা হয়েছিল ‘বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতি’। পরে এটি বাংলাদেশ জাতীয় দল হিসেবে পরিচিতি পায়। আর সর্বমহলে পরিচিতি লাভ করে ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’ নামে। স্বাধীন বাংলা সরকার, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ইত্যাদি নামের আদলে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের নামকরণ হয়েছিল।
ফুটবল দল গঠনে অনুদান দিয়েছিল ভারত সরকারও। দলের অনুশীলনের জন্য পার্ক সার্কাসের ভেতরে একটি মাঠ দেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের। প্যাটেলের ভাষ্য, তখন পশ্চিমবঙ্গের বড় ব্যবসায়ী ছিলেন আকবর আলী। তার আদি নিবাস ছিল কুমিল্লায়। বিনা ভাড়ায় থাকার জন্য একটি ফ্ল্যাট দিয়ে দিলেন তিনি। খেলোয়াড়রা সেখানে থাকতেন। 
প্যাটেল বলেন, জুনের শেষদিকে খেলোয়াড় সংগ্রহের কাজ শুরু করি আমরা। আমি, মহসিন চাচা, লুৎফর রহমান, মুজিবর রহমান আমরা চারজন চলে যাই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। সেখানে কথা হয়  খ্যাতিমান অভিনেতা হাসান ইমাম ও আলী যাকেরের সঙ্গে। তারা  খেলোয়াড় আহ্বান করে সংবাদ প্রচারে সহায়তা করেন। মঈন সিনহা নামে আমার আরেক বন্ধু আসে কলকাতায়। তাকে আবার বাংলাদেশে পাঠাই খেলোয়াড় সংগ্রহের জন্য। ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশে ঢুকে। তিন ফুটবলার শাহজাহান ভাই, লালু ভাই ও সাঈদকে নিয়ে ফিরে আসে অচিরেই।
এরই মাঝে রাস্তায় হঠাৎ ফুটবলার আশরাফের সঙ্গে দেখা হয় প্যাটেলের। তাকে পরিকল্পনার কথা বলতেই খেলার জন্য রাজি হয়ে যান। তার মাধ্যমে যোগাযোগ হয় আলোচিত ফুটবলার প্রতাপ শঙ্কর হাজরা ও আলী ইমামের সঙ্গে। প্যাটেল বলেন, আমরা দুজন প্রতাপ দার কাছে যাই। বলি, খেলোয়াড়দের মেন্যুতে মাছ-মাংস থাকবে। ঘুমানোর জন্য লেপ-তোশক কেনা হয়েছে। আসুন খেলবেন। 
কথা শুনে প্রতাপ দা বলেন, রাখো তোমার মাছ-মাংস। আমরা ডাল-ভাজি খেয়ে খেলব। রাখো তোমার লাইট-ফ্যান, লেপ-তোশক, আমরা ফ্লোরিং করব। সাইদুর রহমান প্যাটেল বলেন, প্রতাপ দার ওখানে দেখা নুরুন্নবী ভাইয়ের সঙ্গে। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ আর্মির প্রথম ব্যাচের ক্যাডেট। ট্রেনিংয়ে চলে যাবেন। তার আগে যোগ দিলেন  স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে। নানা প্রক্রিয়ায় আরও যুক্ত হন ওয়ারীর লুৎফর, মঈন সিনহা, হাকিম ভাইয়ের মতো ফুটবলাররা।
এদিকে, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের আহ্বান শুনে অনেক ফুটবলার আগরতলা এসেছিলেন। কিন্তু কলকাতা থেকে আগরতলা অনেক দূর।  যেতে-আসতে এক সপ্তার বেশি সময় লাগে। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন বলে জানান প্যাটেল।

বলেন, বিএসএফের বিমানে করে ফুটবলারদের কলকাতায় আনার ব্যবস্থা করেন তিনি। প্রতাপ, লুৎফর রহমানসহ কয়েকজন যান আগরতলায়। সঙ্গে করে নিয়ে আসেন নওশের, সালাউদ্দিন, এনায়েত, আইনুল, তসলিম, কায়কোবাদসহ তারকা ফুটবলারদের। সবাইকে নিয়ে পার্ক সার্কাস মাঠে শুরু হয় অনুশীলন। 
দলের অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু আরও পরে দলে যোগ দিয়েছিলেন বলে জানান প্যাটেল। তাঁর তথ্য অনুযায়ী, ক্যাম্প শুরুর ২৬ কি ২৭ দিন পর তিনি  যোগ দেন। তার সঙ্গে যোগ দেন তানভীর মাজহার তান্না। প্রস্তুতি পর্ব শেষে খেলা শুরু হয়। 
জানা যায়, ২৫ জুলাই নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর স্টেডিয়ামে প্রথম খেলতে নামে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। প্রতিপক্ষ ছিল নদীয়া জেলা একাদশের। সাইদুর রহমান প্যাটেল বলেন, মাঠের চারপাশে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। এ অবস্থায় আমরা জাতীয়সংগীত গাই। বিরাট পতাকা নিয়ে মাঠ প্রদক্ষিণ করি। দর্শকরাও উৎসাহ দিয়ে যান। ম্যাচে শাহজাহান ভাই ও এনায়েত গোল করে। ম্যাচটি ২-২ গোলে ড্র হয়।

দ্বিতীয় ম্যাচ ছিল গোষ্ঠপাল একাদশের বিপক্ষে। ওই ম্যাচে ২-৪ গোলে  হেরে যাই আমরা। এভাবে চলতে থাকে খেলা। প্যাটেল জানান, খেলা  দেখতে আসা দর্শক আমাদের বিপুল সমর্থন জানাতেন। খেলা থেকে সরকারকে আনুমানিক ১৬ লাখ রুপি দেওয়া হয়েছিল বলে জানান প্যাটেল।
সব মিলিয়ে অনন্য এক ইতিহাস। এই ইতিহাস নিশ্চয়ই বাঁচিয়ে রাখবে ফুটবল পায়ে লড়াই করা দলের সকল খেলোয়াড়কে। আর সাইদুর রহমান প্যাটেলকে তো বটেই।

×