.
বর্ষা যদি ঋতুর রাণী, তবে ইলিশ নিশ্চিত জলের শস্য। ইলিশের সঙ্গে বর্ষার রসায়ন অত্যন্ত গাঢ়। একে অপরের ঘনিষ্ঠতা যথেষ্ট নিবিড়। পূর্ব কিংবা দখিনা হাওয়ায় ভর করে আকাশ থেকে যখন নামে ঝুম বৃষ্টি তখনই সে বর্ষার জল পিঠে বয়ে গভীর সমুদ্র থেকে ঝাঁকেঝাঁকে উঠে আসে ইলিশ। সমুদ্রের নোনাজলে ডুব সাঁতারে মনের আনন্দে চলে ইলিশের নাচানাচি। ইলিশ যত এগোয়, ততই তার শরীর থেকে ঝরে লবণ আর আয়োডিন। শত মাইল জলের পথ পাড়ি দিয়ে ইলিশ যখন মোহনা কিংবা গাঙে পৌঁছায়, তখন তার মেদ ঝরে নধরকান্তি দেহে অপূর্ব দ্যুতি ছড়ায়। জেলের জালের ফেঁসে গেলে বাঙালির পাতে ইলিশ হয় তুলনাহীন। তাইতো ইলিশ হয় মাছের রাজা।
বাঙালির সাহিত্য-সংস্কৃতির বিশাল অংশজুড়ে আছে বর্ষার ইলিশ। দ্বাদশ শতকের বিখ্যাত প-িত জীমূতবাহন সর্বপ্রথম ইলিশ মাছের নাম উল্লেখ করেছেন। সেই সময়ের সর্বানন্দের টিকাসর্বস্ব গ্রন্থেও ‘ইল্লিষ’ শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। পঞ্চদশ শতকের কবি বিজয়গুপ্ত তার মনসামঙ্গল কাব্যের জন্য জগদ্বিবিখ্যাত হয়ে আছেন। সেই মনসামঙ্গলে বিজয়গুপ্ত লখিন্দর জন্মাবার আগে সনখার সাধ ভক্ষণে নানাবিধ পদের সঙ্গে দিয়েছেন দক্ষিণ সাগর কলা দিয়ে ইলিশের ঝোল রান্নার বর্ণনা।
তিনি লিখেছেন, ‘আনিয়া ইলিশ মতস্য/ করিল ফালাফালা/তাহা দিয়ে রাঁধে ব্যঞ্জন/ দক্ষিণসাগর কলা।’
ব্রিটিশ গবেষক হ্যামিল্টন বুকানন ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গোপসাগরের মাছ নিয়ে গবেষণার সময়ে ‘হিলসা’ মাছের নাম উল্লেখ করেন। যা পরবর্তীতে হিলসা, ইল্লিশ ও ইলীষা একাকার হয়ে ইলিশে রূপ নেয়। ইলিশ হয় জলের অধিপতি বা ঈশ্বর। সন্ধিবিচ্ছেদেও তাই। অর্থাৎ জলের অধিপতি বা ঈশ্বর। সাহিত্য সংস্কৃতির পাশাপাশি আর এখনতো ইলিশ আমাদের ভৌগোলিক পণ্যের গৌরবের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনে দিয়েছে।
ইলিশের আনাগোনা বছরজুড়ে হলেও মূলত রূপরস বর্ণগন্ধ ও স্বাদে বর্ষার ইলিশ অনন্য। বর্ষার ইলিশের জন্যই বাঙালির যত হাপিত্যেশ। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের মধ্যে যুবতী ইলিশের পেটে ডিম আসতে শুরু করে। পেট ভরা সে ডিম নিয়ে যুবতী ইলিশ পাড়ি দেয় সাগর। মিষ্টি জলে ডিম দেওয়া ইলিশের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সে হিসেবে ইলিশ পরিযায়ী মাছ। ডিম দেওয়ার সময় ছাড়া ইলিশ আদৌ উপকূলে আসতে চায় না। সাগরের গভীরে বিচরণে তার আনন্দ। সে হিসেবে আবার মৌসুমি শস্যও বটে। সাগরের গভীর জলে ইলিশের প্রধান খাদ্য জলজ শ্যাওলা। এতেই সে পুষ্ট হয়। দেহ ভারি হয়। রূপ লাবণ্যে অপরূপ হয়।
বর্ষার ইলিশ ধরায় ভিন্ন ধরনের আনন্দ আছে। আবেগ আছে। বাণিজ্য আছে। তাইতো বর্ষা আসার আগেই উপকূলের জেলেদের মাঝে সাড়া পড়ে। নৌকা তৈরির ধুম পড়ে। কাঠমেস্তরীদের ব্যস্ততা বাড়ে। ঘাটে ঘাটে নৌকা তৈরির কারখানা গড়ে ওঠে। একটা সময়ে বৈঠার নৌকা তৈরি হতো। বাদাম তোলা লম্বা সে নৌকা। সুতার জাল। সময় পাল্টেছে। কাল পাল্টেছে। মাছ ধরার কৌশলে পরিবর্তন এসেছে। পুঁজির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। প্রথমে ছিল ইঞ্জিনের নৌকা। শ্যালো মেশিন বসিয়ে নৌকার গতি আনা হত। পরে এসেছে ট্রলার। আর এখন ফিশিংবোট। আকার আয়তনে বিশাল। নায়লনের জাল। বোটের তলায় গুদাম। শত শত মণ বরফের পাহাড়।
আগে উপকূলের গাঁ-গেরামের সম্পন্ন গেরস্তদের ভেতরেও সৌখিন ইলিশ শিকারি ছিল। এখন নেই। এখন সবটাই বাণিজ্য। তবে এতকিছু পাল্টে গেলেও ইলিশ ধরার মৌসুমে আসেনি পরিবর্তন। কালের ধারা বেয়ে এখনো সেই বর্ষার ইলিশ।
সাগরে যখন বর্ষা নামে। তখন চারপাশে আঁধার নামে। ঘন কুয়াশার আস্তর পড়ে। চোখ সয়ে যায়। আসে জোয়ার-ভাটার ঢেউ। উত্থালপাতাল জলের দোলা। ভরা গাঙসমুদ্রে কলার মোচার মতো দোলে ইলিশের নৌকা-ট্রলার। এরমধ্যে চলে ইলিশ ধরা। পাকা শিকারির চোখ জেলেদের। সমুদ্রের কোথায় ইলিশের ঝাঁক, তার নাড়ি নক্ষত্র জহুরির চোখে জেলেরা পরখ করে। নৌকার খোল ভরে ওঠে। রূপালি শরীরের ইলিশের ঝিলিক ওঠে। মানিক বন্দোপাধ্যায় তার ‘পদ্মা নদীর মাঝি’তে ইলিশ ধরার বর্ণনা তাই যথার্থভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘পদ্মায় ইলিশ মাছ ধরার মৌসুম চলিতেছে। নৌকার খোল ভরিয়া জমিতে থাকে মৃত সাদা ইলিশ মাছ। লণ্ঠনের আলোয় মাছের আঁশ চকচক করে। মাছের চোখগুলোকে স্বচ্ছ নীলাভ চোখের মণির মতো দেখায়।’
ষড়ঋতুর এই দেশে বর্ষার রূপের সঙ্গে সাগর-গাঙে ইলিশ ধরা মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। ইলশেগুঁড়ি হোক কিংবা ভারি বর্ষণ। বর্ষায় যেন ইলিশ টগবগিয়ে ওঠে। জেলেদের দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটে। ইলিশের স্বাদ বাড়ে। দাম যাই হোক। ইলিশের গালে আঙুল ঢুকিয়ে তা নিয়ে বাড়ি ফেরা যেন বাঙালির বর্ষার চিরকালীন অনন্য রূপ। দাম প্রসঙ্গে তাইতো ময়মনসিংহ গীতিকায় মাছের রাজা ইলিশের চিত্র ফুটে উঠেছে এভাবে, ‘সেই ইলিশের দাম হইল সোনায় একুশ ভড়ি মাছ ইলিশারে।’ আর বর্ষা নিয়ে ‘ইলশেগুঁড়ি’ কবিতায় সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন, ‘ইলশে গুঁড়ি ইলশে গুঁড়ি ইলিশ মাছের ডিম, ইলশে গুঁড়ি ইলশে গুঁড়ি দিনের বেলায় হিম।’