ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ২২ আশ্বিন ১৪৩১

অপরাজিত এক নায়কের গল্প!

প্রকাশিত: ১৭:২৪, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

অপরাজিত এক নায়কের গল্প!

ভ্যানচালক হায়দার আলী।

তখনও জানে না; বাচ্চারা কী খেয়ে রাতে ঘুমাতে যাবে? পরদিন পরীক্ষা তাই ভ্যান নিয়ে কাজে যেতে পারেনি। ছয়টা পেট অভুক্ত, ঘরে খাবার নাই। একদিন চাকা না ঘুরলে চুলায় আর ভাত উঠে না- এই হলো হায়দার আলীর অবস্থা! কথাগুলো বলছিলেন হায়দার আলীর পাশের ঘরের বাসিন্দা হাশেম মিয়া। 

পেশায় একজন ভ্যানচালক হায়দার আলী। পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার শেখ মাটিয়া ইউনিয়নের রামনগর গ্রামের মৃত কাঞ্চন খানের ছেলে। অভাব অনটন আর নিয়তির সাথে লড়াইটা সেই শৈশব থেকে। তবে পরাজিত সৈনিক নয় বরং অপরাজিত নায়কের মতো বাঁচার প্রত্যয়ে চলছে তার জিবন সংগ্রাম। 

আরও পড়ুন : রাষ্ট্রপতির বইয়ের ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশিত

কখনো ভ্যান চালানো, দিন মজুরের কাজ কিংবা মাছ ধরা এই তার জীবিকার উৎস। এভাবে এসএসসি, এইচএসসি পাশ তার। এরপর ২০১৮ তে নাজিরপুর কলেজে ডিগ্রীতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে বাউবিতে ভর্তি হন তিনি। গতকাল বাউবির বিএ/বিএসএস এর প্রকাশিত ফলাফলে ২.৮৩ (জিপিএ) পেয়ে উত্তীর্ণ হন হায়দার আলী।

জিবনে কোন কিছুই বাঁধা হতে পারেনি হায়দার আলীর শিক্ষা অর্জনের পথে। ভ্যান চালানোর পাশাপাশি লেখাপড়া শেখার অদম্য আগ্রহের কারণে রাতে পরিবারের সকলে ঘুমিয়ে পড়লে এবং দিনে ভ্যান চালানোর ফাঁকে ফাঁকে পড়ালেখা চালিয়ে যেতেন হায়দার। ইংরেজিতে তার বেজায় দখল। কথায় কথায় ইংরেজি বলার প্রাকটিস ও নতুন শব্দ শেখার আগ্রহ তাঁর শব্দ ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। রেডিওতে নিয়মিত আন্ত:জাতিক বিশ্বের সংবাদ শোনাও তার নেশা।

ব্যক্তিগত জীবনে হায়দার আলী ৪ সন্তানের জনক। হায়দার আলী ১৯৯৪ সালে প্রথম বিভাগে মাধ্যমিক পাস করেন। সংসারের অভাব অনটনের কারনে অনেকটা বাধ্য হয়ে শিক্ষা জীবনের ইতি টানতে হয় তার। দীর্ঘ শিক্ষা বিরতীর পর ২০১৩ সালে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে এইচএসসি তে ভর্তি হন। পরিবারের ঘানি, স্ত্রী-সন্তানদের ভরন পোষণ আর দায়িত্ব পালনের পরেও ৩.৮৩ পেয়ে এইচএসসিতেও এলাকায় চমক দেখান তিনি।
 
ভ্যান চালিয়ে প্রতিদিন গড়ে তিন/চারশো টাকা আয় হয় তার। পৈতৃক সম্পত্তির মধ্যে তার একটি ঝুপড়ি ঘর আর মাত্র ৩ শতাংশ জমি আছে। হায়দার আলী বলেন, এবার আমার স্বপ্ন উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন। যত বছরই লাগুক আমি এম.এ পাস করব-ই করবো। চাকরি প্রাপ্তির জন্য না, উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার বাসনা থেকে এ শিক্ষা অর্জন করছি। তারপরেও যদি একটি অন্য কাজ পেতাম; পরিবার পরিজন নিয়ে একটু ভাল থাকতে পারতাম। বয়স এখন ৪৭। যত বাড়ছে বয়স, ভ্যান টানার শক্তি ততই কমে যাচ্ছে। খুব কষ্টের কাজ চরাঞ্চলে ভ্যান টানা।

হায়দার আলীর মতো সুযোগ বঞ্চিত, অবহেলিত, বয়স্ক ও অদম্য শিক্ষার্থীর শিক্ষার সুযোগ সম্পর্কে বাউবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, হায়দার আলী একটি সাহসের নাম। সংগ্রামী, পরিশ্রমী, দৃঢ়, অপরাজিত, স্বপ্নবান একজন। শিক্ষাবঞ্চিত মানুষের আদর্শ তিনি। এই রকম মানুষের পাশে সব সময় রয়েছে বাউবি। প্রযুক্তির কল্যাণে আমাদের শিক্ষাক্রম এখন সারা দেশেই সকল বয়সের, পেশার নাগরিকের ঘরে বসে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ করে দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, জনকল্যাণের জন্য সম্প্রতি গবেষণার সুযোগকে অবারিত ও বিস্তৃত করার নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে বাউবি।

বাউবি দেশের বাইরেও স্টাডি সেন্টার খুলেছে। দক্ষিণ কোরিয়া, সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, আরব আমিরাত, ইতালিতে অবস্থানরত বাঙালি রেমিটেন্স যোদ্ধারা সেখানে বসে এখন বাউবির বিভিন্ন প্রোগামে শিক্ষা গ্রহণ করছে। পটুয়াখালির সাগড়পাড়ের জেলে হাসান পারভেজ, কিশোরগঞ্জের চা বিক্রেতা হারুন মিয়া, বগুড়ার হুইল চেয়ারের যোদ্ধা প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী নুরজাহান রিয়া কিংবা নারী সাফ ফুটবল দলের সাবেক ক্যাপ্টেন সাবিনা খাতুন, মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ফটোগ্রাফার নিজামুল বিশ্বাস- তারা সবাই বাউবির স্টুডেন্ট। 
সব মিলিয়ে, দক্ষতা, শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে ও আলোকিত মানুষ গড়তে বাউবি আজ একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠান। হায়দার আলীর উচ্চশিক্ষা গ্রহণে সার্বিক সহযোগিতার জন্য অবশ্যই তাঁর পাশে থাকবে বাউবি।

এসআর

×