
ময়মনসিংহ নগরীর মাকড়জানি খাল ঘেঁষে নির্মাণ করা হচ্ছে বহুতল ভবন
ময়মনসিংহ নগরীতে বিল্ডিং কোডের তোয়াক্কা না করে বহুতল ভবন নির্মাণের প্রতিযোগিতা চলছে। এক শ্রেণির ডেভেলপ ব্যবসায়ী ও ভবন মালিকদের আকাশছোঁয়ার এই প্রতিযোগিতা ঝুঁকি বাড়াচ্ছে নগরবাসীর। অথচ স্থানীয় সিটি কর্তৃপক্ষ প্রভাবশালী ভবন মালিকদের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো ব্যবস্থাই নিতে পারছে না। সচেতন নগরবাসীদের কেউ কেউ প্রতিবাদ করে মিথ্যা মামলায় হয়রানিসহ জীবননাশের হুমকির শিকার হয়েছেন। এ রকম অবস্থায় যে যেভাবে পারছেন সেভাবেই নির্মাণ করছেন বহুতল ভবন। ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের এক শ্রেণির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও রয়েছে এমন অভিযোগ। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা ভূমিকম্পপ্রবণ ময়মনসিংহ নগরীতে এভাবে বহুতল ভবন নির্মাণ আগামীতে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে। ময়মনসিংহ সিটি মেয়র ইকরামুল হক টিটু বিল্ডিং কোড না মেনে বহুতল ভবন নির্মাণের কথা স্বীকার করে জানান, সাবেক পৌরসভার জনবল দিয়েই চলছে সিটি করপোরেশন। তার পরও যখনই কোনো অভিযোগ কিংবা নিয়ম ভেঙে ভবন নির্মাণের খবর আসছে তখনই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে এই ক্ষেত্রে ভবন মালিক ও ডেভেলপারদের সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। আইন প্রয়োগ করে এই সমস্যার সমাধানের অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। নানামুখী উদ্যোগের কথা উল্লেখ করে সিটি মেয়র ইকরামুল হক টিটু আরও জানান, অভিযোগ পাওয়া বেশকিছু ভবন মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাসহ ভবনের অননুমোদিত অংশ ভাঙা হয়েছে। সিটি করপোরেশনের জনবল বাড়লে এ নিয়ে আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ সহজ হবে বলে জানান তিনি।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ময়মনসিংহ নগরীর কাচিঝুলি ১৬ নম্বর ইটাখলা আবাসিক এলাকায় প্রভাবশালী খালিদ হাসান আকন্দ অ্যাডভোকেট বিল্ডিং কোডের তোয়াক্কা না করেই নির্মাণ করেছেন বহুতল ভবন। অভিযোগ সিটি করপোরেশন থেকে ১২৭২ বর্গফুট জায়গায় বহুতল ভবন নির্মাণের অনুমোদন নিলেও দুই হাজারের বেশি বর্গফুট জায়গাজুড়ে বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন তিনি। ভবন নির্মাণের সময় পেছনে থাকা পরিবারের বাসা থেকে বের হওয়ার রাস্তাও বন্ধ করে দেন তিনি। এ নিয়ে প্রতিবাদ করায় দ্রুত বিচার আইনের ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলায় হয়রানিসহ জীবননাশের হুমকিতে পড়েছেন উদ্যোক্তা ‘আড়ং ঢং’ এর মালিক সাবিহা জাহিদ। সাবিহা জাহিদ জনকণ্ঠকে জানান, বিল্ডিং কোড না মেনে খালিদ হাসান আকন্দ ভবন নির্মাণ করায় তিনি ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের কাছে নালিশ করেছিলেন। এর জের ধরে খালিদ হাসান আকন্দ দ্রুতবিচার আইনে ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দিয়ে হয়রানি করেছেন সাবিহা জাহিদকে। এখনো জীবননাশের হুমকি ছাড়াও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নানাভাবে ক্ষতি করার পাঁয়তারা চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন উদ্যোক্তা সাবিহা। এ নিয়ে তিনি থানায় সাধারণ ডায়েরিও করেছেন। আইন পেশার একজন ভবন মালিকের এমন বেআইনি কারবারে হতবাক এলাকাবাসীও।
এ নিয়ে ইটাখলার বাসায় কথা বলতে গেলে তেড়ে আসেন খালিদ হাসান আকন্দ অ্যাডভোকেটের স্ত্রী। পুলিশের কাছে নালিশের হুমকিও দেন তিনি। খালিদের মিসেস পরিচয়ে বাসার ভেতর থেকে জানান, নিয়ম মেনেই ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। তার পরও সাংবাদিকরা আসছে কেন? জানতে চান তিনি। নগরীর ১৩০/১ নম্বর জেল রোডে জ্বালানি তেলের পাম্প ঘেঁষে নির্মাণ করা হচ্ছে বহুতল ভবন। এ নিয়ে ঝুঁকিতে থাকা পাম্প মালিক সাইফুল আলম সিটি কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ করেও কোনো প্রতিকার পাননি বলে জানান। তিনি আরও জানান, নির্মাণাধীন বহুতল ভবনের ওপরের অংশ অনুমোদিত প্ল্যানের বাইরে বর্ধিত করে নির্মাণ করা হচ্ছে। প্ল্যানে ভবনের বর্ধিত অংশেই রয়েছে রান্নাঘর। পেট্রল পাম্প ঘেঁষে এভাবে বহুতল ভবন নির্মাণের কারনে যে কোনো সময় ভয়াবহ দুর্ঘটনার আশঙ্কা এলাকাবাসীরও। এ ব্যাপারে সিটি কর্তৃপক্ষ একাধিকবার ভবন মালিককে সতর্ক করার পরও থামেনি নির্মাণকাজ।
স্থানীয় সিটি কর্তৃপক্ষ জানায়, নগরীতে ১০ তলার ওপরে ভবন নির্মাণে সম্মুখভাগে ২০ ফুট থেকে ৪০ ফুট রাস্তা থাকতে হবে। ভবন মালিককে সামনের দিকে ৫ ফুট এবং খাল হলে ৬ ফুট রাস্তা ছেড়ে ভবন নির্মাণের কথা। অথচ এমন নিয়ম ভঙ্গ করেই চলছে বহুতল ভবন নির্মাণ। এ নিয়ে শঙ্কিত ও হতাশ স্থানীয় নগরবাসী। ময়মনসিংহ নাগরিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার নুরুল আমিন কালাম এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে জানান, ভূমিকম্প প্রবণ ময়মনসিংহে বিল্ডিং কোড না মেনে গায়ের জোরে এক শ্রেণির প্রভাবশালী ভবন মালিক ও ডেভেলপ ব্যবসায়ীদের বহুতল ভবন নির্মাণ আগামীতে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে। তিনি এ নিয়ে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন কর্র্তৃপক্ষের জোরালো কার্যকর ও দৃশ্যমান উদ্যোগ দেখতে চান।
বিল্ডিং কোড মেনে জায়গা ছাড়া তো পরের কথা উল্টো নগরীর নওমহল এলাকায় মাকড়জানি খালের দেওয়ালের ওপর নির্মাণ করা হয়েছে একাধিক বহুতল ভবন। এ নিয়ে স্থানীয়রা হতবাক। খালের পাশে বহুতল ভবন নির্মাণে ছয় ফুট জায়গা ছাড়ার কথা। অথচ মাকড়জানি খালের পাশে নির্মাণাধীন ভবন মালিকেরা এই নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়েছেন। খোদ নগর ভবনের পাশেই ১৯ নম্বর অমৃত বাবু রোডে ‘কাদের মান্নান টাউয়ার’ এবং নগরীর জিলা স্কুল ও বাউন্ডারি রোডের সংযোগ সড়কসহ কাচারি বাইলেনে অতুল চক্রবর্তী রোডে সর্বোচ্চ ১০ ফুট রাস্তার ওপর নির্মাণ করা হয়েছে ১০ তলার ওপরে একাধিক বহুতল ভবন। এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের গবেষক অধ্যাপক ড. এমএ ফারুক জানান, বিল্ডিং কোড না মেনে যেভাবে ময়মনসিংহ নগরীতে বহুতল ভবন নির্মাণের হিড়িক পড়েছে তাতে কখনো ছয় মাত্রার ওপরে ভূমিকম্প হলে কবরস্থান ও শ্মশান হয়ে যেতে পারে ময়মনসিংহ। ময়মনসিংহ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-পরিচালক মতিউর রহমান জানান, অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে ঝুঁকি বাড়ছে ময়মনসিংহ নগরীর। প্রয়োজনীয় রাস্তা না থাকার পরও অলিগলিতে যেসব বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে সেখানে অগ্নিকান্ডের মত কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করনীয় থাকবে না। এমন শঙ্কার কথা জানান খোদ ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের নগর পরিকল্পনাবিদ মানস বিশ্বাস। তিনি জানান, ময়মনসিংহ এমনিতেই ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। এখানকার ভবন মালিকদের আরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
নগরীর অলিগলির আবাসিক এলাকা ছাড়াও ব্যস্ততম বাণিজ্যিক এলাকা নতুন বাজার, সিকে ঘোষ রোড, দুর্গাবাড়ি রোড, রামবাবু রোড, সাহেব আলী রোড, বাউন্ডারি রোড, ব্রাহ্মপল্লী রোডসহ নগরজুড়েই চলছে এই নিয়ম ভাঙার প্রতিযোগিতা। ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর গোলাম রফিক জানান বেশিরভাগ ভবন মালিকই বিল্ডিং কোড না মেনে বহুতল ভবন নির্মাণ করায় ঝুঁকি বাড়ছে ময়মনসিংহের। বিল্ডিং কোড অমান্য হলে বিদ্যমান আইনে অনুমোদনের বাইরের অংশ ভেঙে কিংবা অপসারণ করার এখতিয়ার রয়েছে সিটি কর্তৃপক্ষের। তার পরও প্রভাবশালী অনেক ভবন মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় প্রশ্ন উঠেছে।
ময়মনসিংহের গভর্র্নমেন্ট প্লিডার-জিপি অ্যাডভোকেট ছাইফুল ইসলাম জানান, ইমারত নির্মাণ আইনে সিটি কর্পোরেশনকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সিটি করপোরেশনের নিজস্ব নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটও রয়েছেন। অনুমোদনের বাইরে কেউ ভবন নির্মাণ করলে সিটি কর্পোরেশনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তা ভেঙে দেওয়ার এখতিয়ার রাখেন। গত ২০১৮ সালে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন হওয়ার পর সাত তলার ঊর্ধ্বে ২১৮টি বহুতল ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর আগে পৌর কর্র্তৃপক্ষও অনেক বহুতল ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেয়। এসব বহুতল ভবন নির্মাণের অনুমোদন নিয়েও রয়েছে নানা বিতর্ক ও প্রশ্ন। খোদ সিটি করপোরেশন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও বিল্ডিং কোড না মেনে নিজেদের বহুতল ভবন নির্মাণের অভিযোগ রয়েছে।