ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

শামীম সিকদারের ভাস্কর্য

মুক্তিযুদ্ধের শক্তি আপোসহীন শিল্পচৈতন্য

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ২৩:৪০, ২২ মার্চ ২০২৩; আপডেট: ০১:৫১, ২৩ মার্চ ২০২৩

মুক্তিযুদ্ধের শক্তি আপোসহীন শিল্পচৈতন্য

ঢাবির ফুলার রোডে শামীম সিকদারের একক প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠা অপরূপ ভাস্কর্য পার্ক

কোনো সংঘ সমিতিতে শামীম সিকদার নাম লেখাননি কোনোদিন। বড় দল বা প্রভাবশালী গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেননি। বরং একলা থাকার সচেতন প্রয়াস গ্রহণ করেছিলেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, শিল্প চর্চার প্রয়োজনেই এমন একলা জীবন বেছে নেয়া। এবং আজ যখন মানুষটি বেঁচে নেই, জীবন যখন সাঙ্গ হয়েছে তখন তার হয়ে কথা বলছে তারই গড়া শিল্পকর্ম। প্রখ্যাত এই ভাস্কর্য শিল্পী বিপুল ভাস্কর্য নির্মাণ করে গেছেন। তার কাজে সমৃদ্ধ হয়েছে দেশের ভাস্কর্য শিল্প।

তবে যখন বেঁচে ছিলেন তখন তো বটেই, মৃত্যুর পর এখনো অনেকে শামীম সিকদারকে তেমন কৃতিত্ব দিতে রাজি নন। কার্পণ্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাতে কী? শামীম সিকদারের অবদানের কথা, সংগ্রামের কথা তুলে ধরার জন্য রাজধানী শহরেই আছে বেশ কিছু ভাস্কর্য। 
প্রথমেই যে কারও চোখে ভেসে উঠবে ‘স্বোপার্জিত স্বাধীনতা।’ ১৯৮৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সড়কদ্বীপে  তিনি নির্মাণ করেন বিখ্যাত এই ভাস্কর্য। আইকনিক ভাস্কর্য দিয়ে এখনো এই এলাকটিকে চিহ্নিত করা হয়। সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিল্পবোদ্ধা, এমনকি পথচারীরাও ভাস্কর্যটির সঙ্গে পরিচিত। 
পরবর্তী সময়ে ২০০০ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডে ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ নামে বিশালকার পাবলিক মন্যুমেন্ট গড়েন তিনি। এর চারপাশে গড়ে তুলেন অনন্য সাধারণ এক ভাস্কর্য পার্ক। দেশ বিদেশের বিভিন্ন অঙ্গনের আলোকিত ব্যক্তিত্বদের ভাস্কর্য গড়ে এখানে স্থাপন করেন তিনি। তারও আগে স্বাধীনতা উত্তর সময়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জগন্নাথ হলে আছে তার গড়া স্বামী বিবেকানন্দের ভাস্কর্য। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে আছে তার একটি বিমূর্ত ভাস্কর্য।

নিজে যেখানে পড়িয়েছেন সেই চারুকলায় আছে তার গড়া জয়নুলের একটি ভাস্কর্য, যদিও এটি বর্তমানে কাগজ দিয়ে ঢেকে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। আরও বিভিন্ন স্থানে কাজ করেছেন। শিল্পীর ইস্কাটন গার্ডেনের বাসাটিও বিপুলভাবে সমৃদ্ধ। এখানে ভাস্কর্য গ্যালারি প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। সবই ছিল তার একক চেষ্টা। একক সংগ্রাম। 
এতসব কাজের মধ্য দিয়ে কী আসলে বলতে চেয়েছেন ভাস্কর? শিল্পকর্মগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে একটু গভীর দৃষ্টিতে দেখলে উত্তরটি পরিষ্কার হয়ে যায়। বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম, একাত্তরের চেতনা, প্রগতিবাদী আদর্শকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করেছেন শিল্পী। এই নারী শিল্পীর ভেতরে ছিল সৃজনশীল সংগ্রামী চেতনা। স্বাধিকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বোধ তার শিল্পী সত্তাকে গড়ে দিয়েছিল। এ কারণেই আমরা দেখি ১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ অন্য চারুশিল্পীদের সঙ্গে রাজপথে নেমে এসেছেন তিনি। ওই দিন ঢাকার চারুশিল্পী সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে মিছিলে অংশ নিচ্ছেন।

অসহযোগ আন্দোলনের অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ থেকে বের করা হয়েছিল মিছিলটি। পোস্টার, ব্যানার ও চিত্রকর্ম সংবলিত মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন শামীম সিকদার। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও নানাভাবে দেশের জন্য কাজ করেছেন তিনি। সঙ্গত কারণে স্বাধীন দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে এগিয়ে নেয়ার  লক্ষ্যেই ভাস্কর্য নির্মাণ শুরু করেন তিনি। 
শামীম সিকদারের অধিকাংশ ভাস্কর্য মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকেই ধারণ করে আছে। বাঙালির আত্মত্যাগ ও বীরগাঁথাকে কংক্রিটের শক্ত পলেস্তরায় চমৎকার তুলে ধরেছেন তিনি। তার ‘স্বোপার্জিত স্বাধীনতা’ ভাস্কর্যে আমরা দেখতে পাই একাত্তরের গণহত্যা, বাঙালির সশস্ত্র সংগ্রাম ও যুদ্ধ জয়ের গৌরব। কংক্রিটের ভাস্কর্যে এমন ডিটেইল কমই চোখে পড়ে। ফ্রি স্ট্যান্ডিং ভাস্কর্য ও হাই রিলিফ ওয়ার্কের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে যেন পুনরায় প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।  কারণ ততদিনে দেশ উল্টো পথে। ইতিহাস বদলে ফেলা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। 
‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’ শিরোনামে গড়া পাবলিক মন্যুমেন্টটিতেও আমরা বড় পরিসরে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধকে দেখতে পাই। এখানে একটি গোলাকার ফোয়ারার কেন্দ্রে শ্বেতবর্ণের মন্যুমেন্ট নির্মাণ করেন তিনি। এর উচ্চতা লক্ষ্য করার মতো, ৬০ ফুট। পরিসীমা ৮৫.৭৫ ফুট। মন্যুমেন্টে ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায় উপস্থাপন করা হয়।  আর সবার ওপরে দৃশ্যমান হন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে। মহান নেতার ৭ মার্চের তর্জনি অন্য অনেকের আগে শামীম সিকদার ব্যবহার করেছিলেন রূপক হিসেবে। এখনো তর্জনির দিকে তাকালে মনে হয় আগামীর দিক নির্দেশনা দিয়ে চলেছেন বঙ্গবন্ধু। 
এই মন্যুমেন্ট ঘিরেই নয়নাভিরাম ভাস্কর্য পার্ক। এখানে মোট ১১৬টি ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। শিল্পীর খুঁজে নেয়া মুখগুলোর মধ্যে গুরুত্ব পেয়েছে বাঙালিত্বের সাধনা, মুক্তিযুদ্ধ ও মানবতাবাদী আদর্শের উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বরা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, বঙ্কিমচন্দ্র, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, জগদীশ চন্দ্র বসু, মাইকেল মধুসূূদন দত্ত, কবি সুকান্ত, ড. মো. শহীদুল্লাহসহ অনেক সাহিত্যিকের ভাস্কর্য এখানে গড়েছেন তিনি। আছে শিল্পী সুলতানের ভাস্কর্য।

রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের মধ্যে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করা প্রধানমন্ত্রী ক্ষণজন্মা তাজউদ্দীন আহমদ, প্রধান সেনাপতি আতাওল গনী ওসমানী, সিরাজ সিকদার ও সাত বীরশ্রেষ্ঠ’র ভাস্কর্য। নব্বইয়ের শহীদ নূর হোসেন দাঁড়িয়ে আছেন গণতন্ত্রের প্রতীক হয়ে। আন্তর্জাতিকতার জায়গা থেকে শিল্পী গড়েছেন মহাত্মা গান্ধী, সুভাস চন্দ্র বসু, কামাল আতাতুর্ক, মাও সে তুং, ইয়াসির আরাফাতের মতো ব্যক্তিত্বদের ভাস্কর্য। বাংলার অমূল্য রতন বাউল সাধক মানবতাবাদী লালনের ভাস্কর্য গড়েছেন। বাদ যাননি  বিস্মৃতপ্রায় সমাজ সংস্কারক রাজা রামমোহন রায়ও। এক জায়গায় এত কীর্তিমানের মুখ দেখে গর্বে বুক ভরে ওঠে।  
ভাস্কর্য চর্চার মধ্য দিয়ে ধর্মীয় মৌলবাদীদেরও জবাব দিয়েছেন শামীম সিকদার। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর বদলে যাওয়া সময়ে স্বাধীনতা বিরোধী মৌলবাদী গোষ্ঠীর দ্রুত উত্থান ঘটেছিল। ভাস্কর্যের বিরোধিতায়   নেমেছিল তারা। উগ্রবাদীরা শামীম সিকদারকে প্রাণনাশের হুমকি পর্যন্ত দিয়েছে। তবুও তার ছিল আপোসহীন শিল্পচৈতন্য। বিরুদ্ধ সময়ে সাহসের সঙ্গেই কাজ করে গেছেন।

প্রগতিশীলদেরও সবার সুনজরে তিনি ছিলেন না। তার বিরোধিতা করেছেন এমনকি শিল্পীদের একাংশ। কিন্তু তার সৃষ্টির পথ রুদ্ধ করা যায়নি। হ্যাঁ, সব কাজ সমান মানের হয়নি। কিন্তু চর্চা এগিয়ে নিতে তার ছিল অপরিসীম অবদান। আর যে তথ্যটি না দিলেই নয় সেটি হচ্ছে, নিজের গড়া প্রতিটি ভাস্কর্য শামীম সিকদার নিজেই রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছিলেন। এ জন্য প্রচুর অর্থ খরচ করতেন তিনি। শিল্পের প্রতি এর চেয়ে বড় নিবেদন আর কী হতে পারে? বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্যান্য কর্তৃপক্ষ তার ভাস্কর্যের জন্য প্রশংসিত হলেও, এগুলোর কোনো দায়িত্ব নেয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। উল্টো দেখিয়েছে অবহেলা। এ নিয়ে শিল্পীর মনে দুঃখ ছিল। হতাশা ছিল। 
এবারও নিজের গড়া ভাস্কর্যগুলোর সংস্কার কাজ করতে লন্ডন থেকে ঢাকায় এসেছিলেন শিল্পী। আরও অনেক পরিকল্পনা ছিল!। সব ফেলে রেখে তিনি চলে গেছেন। কিন্তু ভাস্করের মৃত্যুর পর কি হবে ভাস্কর্যগুলোর? জরুরি প্রশ্ন। শামীম সিকদারকে অস্বীকার করা যায়। কিন্তু তার ভাস্কর্যকে কি অস্বীকার করা যাবে? অস্বীকার করলে অবহেলায় নষ্ট হলে কার হবে ক্ষতি? আজ নিশ্চয়ই ভাবার সময় হয়েছে। হয়েছে কি?

×