
বগুড়া উডবার্ন সরকারি গণগ্রন্থাগারে পাঠক। হাতে লেখা প্রাচীন পুঁথি, উপাখ্যান (ইনসেটে)।
সাদা কাগজ লালচে হয়েছে। চার ধারে একটু করে ক্ষয়েও গিয়েছে। খুব যতেœ ধরতে হয়। সাবধানে না ধরলে ছিঁড়ে যায়। লম্বা সাইজের এই কাগজে দোয়াত-কালির কলমে হাতে লেখা আছে অতীতের পুঁথি, প্রাচীন উপাখ্যান ও সাহিত্যকর্ম। কালের সাক্ষী হাতে লেখা তিন হাজারেরও বেশি পাতার এমন দুর্লভ মূল্যবান সম্পদ কাচেঘেরা বাক্সে কোনো রকমে টিকিয়ে রাখা হয়েছে বগুড়ার প্রাচীন উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরিতে। যেখানে বাংলা, ইংরেজি সাহিত্যের অনেক প্রাচীন বই ঠাঁই পেয়েছে। বিরল এই সম্পদ রক্ষায় সুষ্ঠু সংরক্ষণের অভাব। সিনিয়র লাইব্রেরিয়ানের পদে দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী লাইব্রেরিয়ান মো. আমির হোসেন উদ্যোগী হয়ে সংরক্ষণ করার চেষ্টা করছেন। জানালেন, লাইব্রেরিতে ৯টি শূন্য পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন তিনজন। তার মধ্যে একজন সংযুক্তির স্টাফ। প্রাচীন এই মূল্যবান সম্পদ রক্ষায় সরকারিভাবে সহযোগিতা অপ্রতুল।
ব্রিটিশ শাসনামলে অবিভক্ত ভারতের পূর্ব বাংলার বগুড়া, রংপুর, যশোর ও বরিশালে লাইব্রেরি স্থাপিত হয় প্রায় পৌনে দুশ’ বছর আগে। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে বগুড়ার সাহিত্যপ্রেমী সুধীজনের চেষ্টায় করতোয়া নদীর তীরে স্থাপিত হয় একটি পাবলিক লাইব্রেরি। এর ৫৪ বছর পর ১৯০৮ সালে তৎকালীন জেলা কালেক্টরেট জে এন গুপ্ত তদানীন্তন বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার জন উডবার্নের নামে লাইব্রেরির নামকরণ করেন। সেই থেকে পরিচিত উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরি। ১৯৩০ সালে এক অগ্নিকা-ে লাইব্রেরিটি আগুনে পুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারপর বগুড়ার নবাব পরিবারের সহযোগিতায় লাইব্রেরিটি স্থানান্তরিত হয় অ্যাডওয়ার্ড পার্কের ভেতরে উত্তর দিকে। ১৯৮৪ সালে লাইব্রেরি সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের আওতায় চলে যায়। নামকরণ হয় উডবার্ন সরকারি গণগ্রন্থাগার। ২০১৩ সালের ২১ ডিসেম্বর অ্যাডওয়ার্ড পার্কে অবস্থিত লাইব্রেরিটি অল্প দূরে পার্কের বাইরে সেউজগাড়ি সড়কের ধারে বহুতল ভবনে স্থানান্তরিত হয়।
২০১২ সালে বগুড়াসহ পুরনো ১৯ জেলার সরকারি গ্রন্থাগারে লাইব্রেরিয়ান পদকে বিলুপ্ত করে সিনিয়র লাইব্রেরিয়ান পদ করা হয়েছে। এ ছাড়াও দেশের ৭১টি সরকারি গণগ্রন্থাগারকে প্রযুক্তিতে রূপান্তরের কাজ শুরু হয়েছে। বগুড়া উডবার্ন সরকারি গণগ্রন্থাগারকে ডিজিটাল ফর্মে নেওয়ার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। লোকবল পূরণ না হলে উন্নীতকরণ করার পরও সেবার মান কতটা উন্নত হবেÑ এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন পাঠক ও সুধীজন।
চারতলা ভবনের লাইব্রেরির নিচতলায় মিলনায়তন, দোতলা ও তিনতলায় পাঠ কক্ষ ও চতুর্থ তলায় মজুত পুস্তক। লাইব্রেরির ক্যাটালগ অনুযায়ী ৪শ’ থেকে ৫শ’ বছর আগের দুর্লভ বইসহ অন্যান্য বই ছিল প্রায় ২৮ হাজার। লাইব্রেরি স্থানান্তর হওয়ার পর পুরাতন অনেক বই নষ্ট হয়ে যায় ও হারিয়ে যায়। প্রাচীন বইগুলোর মধ্যে টিকে আছে ৮ হাজার ২শ’ ৫২টি। বর্তমানে মোট বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৫৬ হাজারেরও বেশি। প্রতিবছর গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর থেকে বই পাঠানো হয়।
একবিংশ শতকের প্রথম দিকে হাতের লেখা প্রাচীন পুঁথি ও উপাখ্যান সাহিত্য কর্ম উদ্ধার করা হয়। অনেকটাই বালির স্তরে ঢাকা ছিল। এ ছাড়াও অনেক প্রাচীন দুর্লভ বই, যার কিছু বই পোকায় খেয়েছে। এগুলো যত্নে সংরক্ষণ করে লাল সালু কাপড়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। হাতে লেখা পুঁথি ও উপাখ্যানের মধ্যে আছে- দুষ্প্রাপ্য হিরণ্য কাশিপুর উপাখ্যান, যা লিখেছেন শ্রী মদজ্ঞানেন্দ্র কুমার ভট্টাচার্য। গোবিন্দ কথামৃত গুণকীর্তন উপাখ্যান, হস্তলিখিত পুঁথি ও উপন্যাস পদ্মপুরাণ, এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটেনিকার সকল খ-, এইচ জি ওয়েলসের ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি, টয়েনবির হিস্ট্রি অব দ্য ওয়ার্ল্ডসহ প্রাচীন গুরুত্বপূর্ণ বই, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মনসাদেবীর উপাখ্যান ইত্যাদি। এর বাইরে উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে- ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রির বেশ কয়েকটি পুরনো গেজেট যার মধ্যে আছে অসমের প্রাচীন গেজেট। বিশ্বের বরেণ্য অনেক লেখকের বই ঠাঁই পেয়েছে এই লাইব্রেরিতে। অভিজ্ঞ রসায়নবিদকে দিয়ে প্রাচীন এই সম্পদ ভালোভাবে সংরক্ষণ করা গেলে বহু যুগ টিকে থাকবে। এমনটি জানালেন ক’জন পাঠক।
এই লাইব্রেরির স্থায়ী সদস্য সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিনশ’। প্রতিদিন গড়ে ৩শ’ পাঠক লাইব্রেরিতে বসে পাঠ করেন। যারা গবেষণা করতে চান, তাদের বসবার আলাদা জায়গা করে দিয়ে সার্বিক সহযোগিতা দেওয়া হয়। তবে ক্যাটালগ না থাকায় অনেক পাঠক সহজে রেফারেন্স বই খুঁজে পান না। কর্তৃপক্ষ জানালেন ডিজিটাল ক্যাটালগ তৈরির কাজ চলছে।
লোকবল কম ও ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা না থাকায় নজরদারি কঠিন হয়ে পড়েছে। আধুনিকায়নের পালায় লাইব্রেরিতে পাঠকের জন্য দুইটি ডেস্কটপ কম্পিউটার এবং প্রশাসনিক কাজের দুইটি কম্পিউটার সংযোজিত হয়েছে। স্ক্যানার, ওয়াইফাই সংযোগ রয়েছে। বিদ্যুতের ব্যাকআপে উন্নত সোলার প্যানেল নেই। পাঠকরা বলছেন, প্রযুক্তির অগ্রসরতায় আরও আধুনিকায়ন দরকার।