ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

যশোরে চলছে মধুমেলা

সাহিত্যের আকাশে তিনি ধূমকেতুর মতো দেখা দিয়েছিলেন...

সাজেদ রহমান

প্রকাশিত: ২৩:১৬, ২৭ জানুয়ারি ২০২৩

সাহিত্যের আকাশে তিনি ধূমকেতুর মতো দেখা দিয়েছিলেন...

যশোরে মধুমেলায় বিক্রি হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী বালিশ মিষ্টি

‘বন্ধু রাজ, তোমাকে আমি হলফ করে বলতে পারি, আমি দেখা দেব একটা বিশাল ধূমকেতুর মতো-এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।’ নিজের সম্পর্কে রাজনারায়ণ বসুকে মাইকেল যা লিখেছিলেন, তার মধ্যে সন্দেহের সত্যি কোনো কারণ ছিল না। তবে তিনি যখন (১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে) এ কথা বলেছেন, তখন তিনি আসলে তুঙ্গে পৌঁছে গেছেন। তত দিনে মেঘনাদবধ কাব্যের দ্বিতীয় খন্ড এবং বীরাঙ্গনা ছাড়া তার সবগুলো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়ে গেছে। তত দিনে তিনি বাংলা সাহিত্যের বিতর্কাতীত অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি এবং নাট্যকার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। এ প্রতিষ্ঠা সত্ত্বেও তিনি অবশ্য নিজেকে নিয়ে পুরোপুরি তৃপ্ত ছিলেন না। তখনো ভাবছেন, কাব্যকলা তার ঠিক আয়ত্তে আসেনি। সেজন্য বলেছেন, ‘দেখা দেবো’। গত পৌনে দুইশ’ বছরের বাংলা সাহিত্যের আকাশে ছোট-বড় অনেক তারকা দেখা দিয়েছেন। নিজের বৈশিষ্ট্যে তারা সমুজ্জ্বল। কিন্তু ধূমকেতু দেখা দিয়েছেন একটি মাত্র-মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তিনি যে কেবল ধূমকেতুর মতো অল্প সময়ের জন্যে দেখা দিয়েছিলেন, তাই নয়, তার গতি-প্রকৃতি অন্যদের থেকে আলাদা, কক্ষপথও আলাদা।

যতক্ষণ ছিলেন, ততক্ষণ তিনি অসাধারণ দীপ্তিতে ভাস্বর ছিলেন। চোখ ধাঁধানো জ্যোতি দিয়ে সবাইকে চমক লাগিয়ে অচিরেই তিনি হারিয়ে গিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তার বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব অথবা তার বিস্ময়কর আবির্ভাবের কথা এতকাল পরেও বাংলা সাহিত্যের পাঠকরা ভুলতে পারেননি।
গত ২৫ জানুয়ারি ছিল মাইকেল মধুসূদন দত্তের ১৯৯ তম জন্মবার্ষিকী। এ উপলক্ষে যশোরের কেশবপুরের সাগরদাঁড়িতে শুরু হয়েছে সপ্তাহব্যাপী মধুমেলা। সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ মেলার উদ্বোধন করেন। মেলা চলবে আগামী ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত। মেলায় প্রতিদিন থাকছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভা। বিষয়ভিত্তিক এই আলোচনা সভায় আলোচক হিসাবে থাকছেন দেশের নানা প্রান্তের বিদগ্ধজনরা।
আসলে মধু কবি যখন পড়াশোনা করেছেন, সে কালে ডেপুটি হওয়া ছিল জীবনের চরম লক্ষ্য, সেকালে তার ধ্রুব লক্ষ্য ছিল কবি হওয়া। যে কালে বাঙালিরা অহংকারে ফেটে পড়তেন সদর দেওয়ানি আদালতের উকিল হয়ে, সেই কালে কেবল ব্যারিস্টার হওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে বাঙালিদের মধ্যে বিলেত গেছেন তিনি। প্রথম বাঙালি জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য বিদেশ যান-তার দুদিন পর মাইকেল যান বিলেত এবং সে সময়ের তুলনায় বিত্তও উপার্জন করেছেন যথেষ্ট। কিন্তু তা দিয়ে আর পাঁচজনের মতো জমি কেনেননি। দু’হাতে উড়িয়ে দেয়ার অদ্ভুদ নজির রেখে গেছেন। তিনি এমন অসাধারণ ছিলেন যে, সে সময়ের লোকেরা কেউ তাকে ঘৃণা করেছেন, কেউ ভালোবেসেছেন কেউ বা করুণা করেছেন, কিন্তু কেউ তাকে অস্বীকার করতে পারেনি।
১৮৬৭তে ব্যারিস্টারি পাস করে কলকাতায় ফিরে এলেন ও কলকাতা হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করার অনুমতি পেলেন। কিন্তু সফল হলেন না ওকালতি ব্যবসায়ে। ‘মেঘনাদ বধ’ মহাকাব্যের ¯্রষ্টা ওকালতির কূটকৌশলে পারদর্শী হবেন কি করে? ব্যারিস্টারি করে অর্থ রোজগারের রাস্তা খুলল না। ১৮৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে মধুসূদন গুরুতর অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। মধুসূদন তখন হিন্দু সমাজে পরিত্যক্ত, খ্রীস্টানরাও আপনজন মনে করতেন না তাকে। কারণ তিনি কোনো গীর্জায় যেতেন না। ‘মেঘনাদ বধ’ মহাকাব্য প্রণেতা তখন কলকাতার বেনে পুকুরে এক অপরিসর গৃহকোণে মলিন শয্যায় চিকিৎসা, পথ্যহীন শায়িত।

হেনরিয়েটাও অসুখে চিকিৎসাহীন শয্যাশায়ী। চিকিৎসা দূরের কথা, দুবেলা অন্নের জোগাড়ও অনিশ্চিত। কোনো সঞ্চয় নেই, কোনো রোজগার নেই। শুভানুধ্যায়ী দু’একজনের সামান্য অর্থ সাহায্যে কতটুকু জীবনযুদ্ধ করা যায়! এইসময় কলকাতার উত্তরপাড়ার জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় দয়াপরবশ হয়ে মধুসূদনকে স্ত্রী, দুই সন্তানসহ উত্তরপাড়া লাইব্রেরিতে নিয়ে আসেন। গঙ্গাতীরে লাইব্রেরি গৃহে নির্বান্ধব মধুসূদন গুরুতর ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে শায়িত। হেনরিয়েটাও গুরুতর পীড়ায় আক্রান্ত, শয্যাশায়িনী। মধু কবির বাল্যবন্ধু গৌরদাস বসাক একদিন উত্তর পাড়ায় মধুসূদনকে দেখতে গিয়েছিলেন। গৌরদাস তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন ‘আমি সেই হৃদয় বিদারক দৃশ্যের কথা কোনোদিন ভুলব না। দেখলাম, বিছানায় শায়িত মধু রক্তবমি করছেন আর মেঝেতে শুয়ে হেনরিয়েটা রোগ যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। তার সন্তান দু’টি ক্ষুধার জ্বালায় পচা পান্তাভাত খেয়ে ঘরের এক কোণে শুয়ে আছে। আর তাদের ভুক্তাবশেষ সেই পান্তা ভাতের ওপরে শতশত মাছি পড়েছে। আমি হেনরিয়েটার কাছে গেলাম, তিনি তার স্বামীর দিকে আঙুলি নির্দেশ করে অস্ফুট শব্দে বললেন, আমাকে নয় ওকে দেখুন’। গৌরদাসকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন মধুসূদন।

গৌর দাস বাবুরা মধুসূদনকে আলিপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করে দিলেন। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জুন সেখানে কপর্দকহীন (অর্থাভাবে) অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার শয্যাপার্শ্বে হাসপাতালের নার্স এবং দু’একজন ওয়ার্ডবয় ছাড়া আর কেউ উপস্থিত ছিলেন না। এর পরের ঘটনা আরও মর্মবিদারি। মধুসূদনের মরদেহকে কপর্দকহীন খ্রিস্টানের মৃতদেহের মত লোয়ার সার্কুলার রোডের কবরখানায় সমাধিস্থ করা হয় ২৪ ঘণ্টা মৃতদেহ ফেলে রাখার পর।
মধু কবির মৃত্যুর পর চাচাত ভাইয়ের মেয়ে কবি মানকুমারী বসু ১৮৯০ সালের ২৫ জানুয়ারি সাগরদাঁড়িতে প্রথম তার জন্মদিনে অনুষ্ঠান করেন। আর ১৯৩৭ সালে যশোর সাহিত্য সংঘ প্রতিষ্ঠা হলে এর সভাপতি অবলাকান্ত মজুমদার ২৯ জুন তার মৃত্যুবার্ষিকীতে অনুষ্ঠান করতেন যশোর শহরে। সেই সব অনুষ্ঠানে এসেছিলেন সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়সহ বিশিষ্ট কবি সাহিত্যিকরা। এরপর ১৯৯৪ সাল থেকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে কবির জন্মস্থান সাগরদাঁড়িতে জন্মবার্ষিকী ২৫ জানুয়ারি থেকে সপ্তাহব্যাপী এই মধুমেলার উৎসব উদযাপিত হয়ে আসছে। জেলা প্রশাসককে সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে সদস্য সচিব করে মধুমেলা উদযাপন কমিটি গঠন করা হয়েছে।

মধুমেলা উদযাপন কমিটির উপজেলা নির্বাহী অফিসার এমএম আরাফাত হোসেন জানান, মেলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সাগরদাঁড়িতে অস্থায়ী একটি পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। সিসি ক্যামেরার নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি বাংলা প্রেসিডেন্সির যশোর জেলার কেশবপুরের সাগরদাঁড়ি গ্রামে মধুসূদন দত্তের জন্ম হয়। তিনি ছিলেন রাজনারায়ণ দত্ত ও তার প্রথমা পতœী জাহ্নবী দেবীর প্রথম সন্তান।

 

×