ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

রাধারমণ উৎসবমুখর বাংলা একাডেমি

ভাটিবাংলার সাধক শিল্পীদের অকৃত্রিম কণ্ঠ

জনকণ্ঠ ফিচার

প্রকাশিত: ২৩:৪২, ২৬ নভেম্বর ২০২২

ভাটিবাংলার সাধক শিল্পীদের অকৃত্রিম কণ্ঠ

বাংলা একাডেমিতে রাধারমণ লোকসংগীত উৎসবে নৃত্য পরিবেশনা

একেবারে তৃণমূল থেকে লোককবিরা এসেছেন। সাধক শিল্পীরা এসেছেন। একেকদিন একেকজন গান করছেন। তাদের নিজস্ব গায়কী অকৃত্রিম কণ্ঠ শোনার দারুণ সুযোগ করে দিয়েছে রাধারমণ লোকসংগীত উৎসব। তিনদিনব্যাপী আয়োজনে মুখর বাংলা একাডেমি চত্বর। শুক্রবার এখানে উৎসবের সূচনা করা হয়। এরপর থেকেই জমজমাট। উৎসবের গান ও নৃত্যায়োজন নাগরিক শ্রোতাদের শুধু মুগ্ধ করছে, এমন নয়। চৈতন্যে অদ্ভুত এক দোলা দিয়ে যাচ্ছে।
কয়েক বছর ধরে নিয়মিতভাবে এ উৎসবের আয়োজন করে আসছে রাধারমণ সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র। এ বছর আয়োজনের ১২ বছর পূর্তি হলো। ফলে আয়োজনটিকে আরও বৈচিত্র্যপূর্ণ করে তোলার চেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
বাংলার সুফি, বৈষ্ণব, বৌদ্ধ সহজিয়া ও বাউলদের উদার মানবতাবাদ, পরমতসহিষ্ণুতা সমন্বয়বাদী মতবাদের কথা সর্বজন বিদিত। অসংখ্য লোককবি ও লোকমহাজন মানবপ্রেম ও ভগবতপ্রেমের কথা গানে গানে উচ্চারণ করেছেন। তাদের সৃষ্টি সাধনা বাঙালির উদার ও অসাম্প্রদায়িক মানসভূমি রচনায় বড় ভূমিকা রেখেছে।

উদাহরণ হিসেবে লালন সাঁই (১৭৭৪), শীতলাং শাহ (১৮০০), পাগলা কানাই (১৮০৯) এবং কাঙাল হরিনাথের (১৮৩৩) কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। কাছাকাছি সময়ে  ১৮৩৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন রাধারমণ। ভাটিবাংলা সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার কেশবপুর গ্রামে ২৫ মে জন্ম জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার গানের সংখ্যা দুইশ’র অধিক।
উৎসবের প্রথম দিন বিপুল এ ভাণ্ডার থেকে গান করেন শিল্পীরা। ছিল একক ও দলীয় পরিবেশনা। একক গান করেন ২২ জন শিল্পী। তবে বড় আকর্ষণ হিসেবে মঞ্চে ছিলেন প্রবীণ কীর্তনীয়া যশোদা রানী সূত্রধর। ৭৫ বছর বয়সী শিল্পীর কণ্ঠে রাধারমণের গান ভিন্ন মাত্রা এনে দেয় উৎসবে।

শহুরে নবীন শিল্পীরাও লোকজ সুর ও সাধনার প্রতি নিজেদের ভালোবাসা প্রকাশ করেন। চমৎকার গান করেন তারাও। রাধারমণের জনপ্রিয় অনেক গান এদিন গাওয়া হয়। সেই সঙ্গে ছিল অপ্রচলিত বা নতুন খুঁজে পাওয়া গানের পরিবেশনা।
দ্বিতীয় দিনে উৎসবে গাওয়া হয় হাসন রাজা, শাহ আবদুল করিম, দূরবীন শাহ, আরকুম শাহ ও মন মোহন দত্তের গান। প্রায় অর্ধশত শিল্পী কিংবদন্তি সাধকদের গান নিয়ে মঞ্চে ছিলেন। গায়কদের মধ্যে ছিলেন দিরাইয়ের বাউল রণেশ ঠাকুরও। এই বাউলের বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল উগ্র মৌলবাদীরা। কষ্টে কাতর শিল্পী তবুও হার মানেননি। থেমে যাননি।

বরং রাজধানীর মঞ্চে গেয়ে নিজের জাত চিনিয়েছেন। তৃতীয় দিনে আজ রবিবার উৎসবে উকিল মুন্সি সৈয়দ শাহনূরসহ কয়েকজন লোককবির গান করা হবে। তাদের গান করবেন নেত্রকোনা ও কেন্দুয়া থেকে আগত বাউলরা। এভাবে তিন দিনের আয়োজনে সব মিলিয়ে প্রায় একশ’ শিল্পী সংগীত পরিবেশন করবেন।
আয়োজকদের পক্ষে বিশ্বজিৎ রায় বলছেন, রাধারমণের গানের রত্নাভাণ্ডার সংগ্রহ, পুনরুদ্ধার, সংরক্ষণ, স্বরলিপিকরণ, প্রশিক্ষণ ও ব্যাপক প্রচার-প্রসারের উদ্দেশ্যে এ উৎসব আয়োজন করা হচ্ছে। রাধারমণ লোকসংগীত উৎসব শুরু হওয়ার পর থেকে দেশে রাধারমণের গানের চর্চা অনেক বেড়েছে। ভবিষ্যতে উৎসব নিয়ে আরও বহু দূর যেতে চান বলে জানান তিনি।  
এদিকে উৎসব থেকে এবারো রাধারমণের জন্মভিটা সংরক্ষণ ও সেখানে একটি কমপ্লেক্স নির্মাণের জোর দাবি জানানো হচ্ছে। আয়োজকরা বলছেন, যে কোনো বাউল বা সাধকের সাধনা বাঁচিয়ে রাখতে প্রধান ভূমিকা রাখে তার নিজস্ব কমিউনিটি। কমিউনিটি ছাড়া চর্চা বা সৃষ্টি টিকে থাকা কঠিন হয়ে যায়। এ কারণেই সাধকগোষ্ঠীর প্রয়োজন হয়। তারাই অন্তত কাল ধরে কাজ করে যান। লালনের আঁখড়ার উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, একই ধরনের চর্চা হতে পারে রাধারমণ কমপ্লেক্স হলে।

×