
‘বড়শি’ হলো মাছ ধরার একটি সরঞ্জাম বিশেষ
‘বড়শি’ হলো মাছ ধরার একটি সরঞ্জাম বিশেষ। অনেকের কাছেই এটি ছিপ নামে পরিচিত। যা মূলত মাছ বা মাছ জাতীয় প্রাণী ধরার ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে মানুষ মাছ ধরার জন্য এই সরঞ্জাম ব্যবহার করে আসছে। ২০০৫ সালে ফোবস মাছ ধরার ২০টি সরঞ্জামের মধ্যে বড়শিকে প্রধান সরঞ্জাম হিসেবে নির্বাচিত করে। বড়শি সাধারণ চিকন ও লম্বা বাঁশ কিংবা লৌহ দ- যার অগ্রভাগে প্রয়োজনমতো সুতা বাধা থাকে।
আর সুতার অপর প্রান্তে লোহা বা ধাতব জাতীয় ক্ষুদ্র পদার্থ দ্বারা তৈরি বাঁকানো যন্ত্র। মাছ ধরার জন্য যা সাধারণত পানির নিচে থাকে। মাছকে আকৃষ্ট করতে এই ক্ষুদ্র যন্ত্রটির সঙ্গে বিশেষ টোপ লাগিয়ে দেওয়া হয়। আর মাছ সেই টোপ গিলে ফেলে বা গিলে ফেলার চেষ্টা করে। মাছকে এই ফাঁদে ফেলেই মূলত মাছ শিকার করা হয়। প্রাচীনকাল থেকেই সারাবিশ্বেই মাছ ধরার অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে বড়শি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
তবে বাংলাদেশে মাছ ধরতে বড়শির অভাবনীয় ব্যবহারের তুলনা নেই। বাংলাদেশে সাধারণত বাঁশের নল দিয়ে তৈরি বড়শি বেশি ব্যবহৃত হয়। প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বড়শি’র আকার, আয়তনে ও শৈলীতে এসেছে নানা পরিবর্তন।
গ্রামীণ জীবনে শৈশবে দুরন্তপনার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ বড়শি হাতে নিয়ে মাছ ধরা। শৈশবে বড়শি দিয়ে পুকুরে, খালে বিলে, নদীতে মাছ ধরেননি শৈশবের এইরকম স্মৃতি জীবনের সঙ্গে মিশে নেই এমন মানুষ খোঁজ মেলা ভার। গ্রামীণ জীবনে শৈশবকালে স্কুল বন্ধ হলে কিংবা স্কুল ফাঁকি দিয়ে অনেকেই বড়শি হাতে ছুটে গেছেন খালে, বিলে, নদীতে।
মাছ ধরার দারুণ নেশায় সারাদিন খেয়ে না খেয়ে বড়শি হাতে কাটিয়ে দিয়েছেন অবলীলায়। মা-বাবার হাজার বকাঝকাকে তোয়াক্কা না করে বড়শি হাতে নিয়ে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থেকেছেন বড়শির ফাতির (মাছ ঠোকর দিল কি না তা চিহ্নিত করার ছোট উপকরণ যা বড়শির সুতার সঙ্গে আটকানো থাকে) দিকে চেয়ে চেয়ে। কখন না জানি মাছ বড়শিতে ঠোকর মারল!
অন্য দিকে যাই ঘটে যাক না কেন সেদিকে ভ্রƒক্ষেপ নেই যেন। দিন শেষে খোল ভরা মাছ নিয়ে বাড়ি ফেরা। সে কি আনন্দ! শুধু শৈশব নয়, শৈশবের এই নেশা অনেকেই ধরে রেখেছেন যুবা কিংবা বৃদ্ধকালেও। তাদের কাছে বড়শি দিয়ে মাছ ধরার নেশা মহামারী রকমের। তবে গ্রামীণ জীবনে অনেকে বড়শি দিয়ে মাছ ধরেন অনেকটা শখ আর নেশার ঝোঁকেই।
তাতে মাছ বড়শিতে ধরুক আর না ধরুক সেটা কোন ব্যাপার নয়। তবে অনেকেই বড়শিকে ব্যবহার করেন জীবন ধারণের অন্যতম উপকরণ হিসেবে। বড়শি ব্যবহার করেই অনেকে মাছ শিকার করে তা বিক্রি করে পরিবারের মুখে আহারের জোগান দেয়। বড়শি দিয়ে মাছ ধরার এমনই চিত্র চোখে পড়ে নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলার মিনি কক্সবাজারখ্যাত হালতি বিলে।
কয়েকটি গ্রামজুড়ে বিস্তৃত এই বিল। বর্ষাকালে কিংবা তারপরে আরও দু’তিন মাস বিলে যখন পানি থাকে, সে সময় হালতি বিলজুড়ে বড়শি দিয়ে মাছ ধরার দৃশ্য চোখে পড়ার মতো। মাছ ধরার অনেক সরঞ্জাম থাকা সত্ত্বেও অনেকেই এই বড়শি দিয়ে সারাদিন মাছ ধরতে ছুটে আসেন আশপাশের অনেকেই। কখনও কখনও দূর-দূরান্ত থেকেই মাছ শিকারী আসেন এখানে বড়শি হাতে নিয়ে। বুধবার সরেজমিন হালতি বিলে বড়শি দিয়ে মাছ ধরার এমন চিত্র দেখা যায়।
হালতি বিলে সাধারণত বর্ষাকালে পানিতে থইথই করে। চারদিকে শুধু পানি আর পানি। তবে পানি কমলে চোখে পড়ে বড়শি দিয়ে মাছ ধরার অসাধারণ চিত্র। নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলার পাটুল ঘাট থেকে খাজুরা পর্যন্ত বিলের মধ্যে দিয়ে একটি রাস্তা রয়েছে। বিলে পানি বাড়লে এই রাস্তা পানির নিচে তলিয়ে যায়। পানি কমলে এই রাস্তায় হাঁটু কিংবা কোমর পানিতে নেমে বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে দেখা যায় কিশোর যুবা এমনকি বৃদ্ধ বয়সী শতাধিক মাছ শিকারীর।
বড়শি দিয়ে তারা দেশী প্রজাতির পুঁটি, খেরল পুঁটি, টেংরা, বাইন, শৈল মাছ শিকার করেন। কথা হয় তাদের সঙ্গে। আলাপ থেকে জানা যায়, তারা বেশির ভাগ আসলে শখের বশে বড়শি দিয়ে মাছ ধরে থাকেন। তবে খুব লোকই আছেন যারা শিকার মাছ বিক্রি করে সংসার নির্বাহ করে থাকেন। এই চিত্র শুধু হালতি বিল বা তার আশপাশেই নয়, বরং পুরো জেলাতেই চোখে পড়ে এমন চিত্র।
তবে জেলার গুরুদাসপুর ও সিংড়া উপজেলার চলনবিল অংশে এমন চিত্র হরহামেশা দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়া জেলার বিভিন্ন উপজেলার ছোট বড় বিল ঝিলে বড়শি হাতে দেখা যায় শিকারীদের। বাঁধের ধারে, ব্রিজে, জমির আইলেও বসে কিংবা দাঁড়িয়ে দেখা যায় তাদের। দেশীয় নানা প্রজাতির মাছ ধরা পড়ে বড়শিতে।
তবে বাংলাদেশে অঞ্চলভেদে বড়শি জীবিকা অর্জনের একটি অন্যতম উপকরণ হিসেবে পরিগণিত হয়। বহুদিন ধরেই এদেশে স্বল্প পরিমাণে মাছ শিকারে বড়শি অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। এই বড়শি দেশের গ্রামীণ জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর ব্যবহার কোনদিনই হারিয়ে যাওয়ার নয়। যতদিন বাংলার খালে বিলে মাছ আছে ততদিন বড়শির ব্যবহার হবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এমনি করে গ্রামীন জীবনে হাজার বছর টিকে থাকুক বড়শির ব্যবহার।
কালিদাস রায়, নাটোর