ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

গ্রামীণ সৌরভের সাতকাহন

জাভেদ ইকবাল

প্রকাশিত: ০২:১৯, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২

গ্রামীণ সৌরভের সাতকাহন

.

বাংলাদেশে সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা, রাত কিংবা ভোরের নিজস্ব গন্ধ আছে। সবচেয়ে প্রখর ভোরের সুবাস। মৃদু ঠা-া বাতাস, কুয়াশা-শিশির মাখানো গন্ধ! সঙ্গে মিশে থাকে বুনো লতানো গাছের মিষ্টি ফুল আর ভেজা ঘাসে সিক্ত মাটির সুবাস। একজন মানুষকে হঠাৎ এ রকম আবহাওয়ায় দাঁড় করিয়ে দিলে সে চোখ বুজে বলে বসবে এটা ভোরবেলা। তারপর মিশতে থাকবে রোদের গন্ধ, মাটির চুলোয় পাটখড়ি, গোবর, শুকনো পাতা পোড়ানোর গন্ধ। মাটির হাঁড়ি থেকে ছুটবে মোটা চালের সিদ্ধ ভাতের ক্ষুধা সৃষ্টি করা গন্ধ। যেন কাউকে ডেকে বলছে, এবার বাছা মাড়টুকু ঢালতে পার?
বাংলার সৌরভ নিতে হলে আপনাকে যেতে হবে ধান-চালের আড়ৎ বা রাইসমিল এলাকায়। নিরানব্বই ভাগ রাইসমিলে বানান থাকবে ভুল। রাইসের ‘স’ এর বদলে থাকবে ‘ছ’ কিংবা ‘চ’। বিরাট ড্রামের মধ্যে চলবে ধান সিদ্ধ। সেই সুবাস কয়েক বর্গ কিলোমিটারজুড়ে চালাবে মহাতা-ব। দশ/পনেরোজন মা-ঝি হাত ধরাধরি করে পা দিয়ে উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে ধান শুকাবে। সদ্য সিদ্ধ মোটা ধান হাতের তালুতে নিয়ে নখ দিয়ে ছিলে ভেতর থেকে মিষ্টি শাঁস বের করে চিবালে পাবেন সেই এক অনুভূতি! স্বর্গীয় সুবাস আপনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলবে। যারা এখনও এ গন্ধ পাননি, তাদের বলব কোন রাইসমিলে অপেক্ষা করবেন, যখন ড্রাম বা হাঁড়ি থেকে সিদ্ধ চাল উঠোনে ঢালা হবে, বাষ্পীয় ইঞ্জিনের সাদা ধোঁয়া প্রাণ ভরে ফুসফুসে নিতে হবে বারবার! সকাল ৮টার দিকে খিদেটা একটু জেঁকে বসলে কোন এক ছাপড়া দোকানে চলে যাবেন। যেখানে মাত্র কয়েকজন কাস্টমার থাকবে। থাকবে না কোন মুরগির লটপটি, খাসির স্যুপ, পায়া। থাকবে শুধু পরোটা, ছোলার ডাল আর ডিমভাজা। তাই অনেক যতœ করে মমতা নিয়ে আপনাকে খাওয়াবে। ডিমগুলো যথেষ্ট পিঁয়াজ-কাঁচামরিচ দিয়ে ভাল করে ডলে নিয়ে গোলাবে। টিপকল থেকে পানি ভরে জগটা আপনার সামনে আস্তে করে রেখে যাবে। পানিতে আয়রনের গন্ধ, ঠা-া পানির ফ্লেভার আপনাকে চাঙ্গা করার জন্য যথেষ্ট। এসব হোটেলে সাধারণত চা থাকে না, আপনাকে পাশের দোকান থেকে এনে খাওয়াবে। আতিথেয়তার কোন কমতি পাবেন না। আর যা বিল আসবে, সেটা দেখে আপনার মন কিছুটা খারাপই হবে, সামান্য ক’টাকা লাভ করল দেখে। এখানে দুপুরবেলার খাওয়াটা আরও মজার। চালকুমড়া বা কাঁকরোল দিয়ে হাঁসের ডিমের ঝোল, সঙ্গে ডাঁটা বা লাল শাক ভাজা আর পানির মতো টলটলে পাতলা ডাল। বেশিরভাগ কাস্টমার সাইকেল মেকানিক আর রিক্সা/ভ্যানওয়ালা। এদের খাওয়া দেখতে খুব ভাললাগে।
তারপর বাসায় ঢুকে দৈনিক খবরের কাগজের হেডলাইনগুলোয় চোখ বুলিয়ে বাজারে গিয়ে কিনে আনবেন দুই আঁটি লাল শাক, একটা মাঝারি সাইজের জ্যান্ত কাতল মাছ, কিছু ফ্রেশ আলু, লেবু আর পটোল। মাছটা ভেজে নিয়ে আলু পটোলের ঝোল করা হবে, সঙ্গে লাল শাক আর মসুরের ডাল। দুপুরবেলায় গরমে ঘেমে লেবু চিপে টিউবওয়েলের ঠা-া পানি খেতে খেতে ভাত শেষ করবেন। মাছের মাথাটা ভেঙে মগজটুকু চুষণ দিয়ে শাক মিশ্রিত লালচে ডালের স্যুপ সশব্দে ফিনিশ করে বলবেন- আলহামদুলিল্লাহ!
সিমেন্টে লাল রেড অক্সাইড মেশানো ঘরের মেঝে প্রতিদিন দুইবার করে ডলে মুছতে মুছতে এমন চকচকে হয়ে যাবে, ত্যালতেলে অবস্থা। সিলিংফ্যান চালিয়ে ঠান্ডা শানের উপর শিমুল তুলার বালিশে মাথা রেখে দেবেন একটা শান্তির ঘুম। পিঠের নিচে ঠান্ডা পরিষ্কার মেঝের মতো আরামের বিছানা এ জগতে পাবেন না। তারপর ঘুম ভাঙলেই পাবেন বিকেলবেলার গন্ধ। হয়তো দূর থেকে ভেসে আসবে কদম ফুলের সুবাস, কিংবা ধুলো মিশ্রিত বাতাস। বাড়ির পাশে নিমগাছ তলায় কবরটার বাঁশের বেড়া থেকেও ছুটবে গন্ধ। সঙ্গে শিউলি গাছটার খসখসে পাতা, মাটিতে পড়ে থাকা গলিত নিমফল, স্যাঁতসেঁতে মাটি, সুপারী ফলের সুবাস। কবরস্থানেও আছে সুশীতল, ছায়াময়, শান্তির একটা ঠান্ডা ঠান্ডা গন্ধ! মনটাকে করে ফেলবে পবিত্র, শান্ত, বিনয়ী। যেখানে যেতে হবে আমাদের সবাইকে...

 

×