ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বেড়েছে পাটকাঠির কদর

পাটের সুদিনের সঙ্গে গুরুত্ব পাচ্ছে বাইপ্রোডাক্টও

সমুদ্র হক

প্রকাশিত: ২২:৪৫, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২২

পাটের সুদিনের সঙ্গে গুরুত্ব পাচ্ছে বাইপ্রোডাক্টও

বগুড়ায় পাটের আঁশ ছাড়িয়ে পাটকাঠি সংরক্ষণ করা হচ্ছে

সোনালি আঁশ পাটের সুদিনের সঙ্গে বাড়তি সুদিন এনেছে একাধিক উপজাত (বাইপ্রোডাক্ট)। পাট (আঁশ), পাটখড়ি বা পাটকাঠি ও পাটকাঠি পোড়ানো ছাই সবই অতি মূল্যবান। বগুড়ার আঞ্চলিক কথনে পাটকাঠির পরিচিতি ‘সিনট্য’। পাট উৎপাদনের পর জলাশয়ে জাগ দিয়ে আঁশ ছাড়িয়ে নেয়ার পর উপজাত সাদা রঙের কাঠিই পাটখড়ি। আঁশ ও কাঠি শুকানো হয় রোদে। এতকাল এই কাঠি ব্যবহার হতো কুঁড়েঘরের বেড়া নির্মাণে। গ্রামীণ জীবনে আঙ্গিনায় স্থাপিত মাটির চুলায় রান্নার জ্বালানি খড়ির সঙ্গে এই কাঠিও থাকত। পাটকাঠি পোড়ানোর পর উপজাত ছাই দিয়ে থালা বাসন মাজা হয়। কখনও দাঁতের মাজনেও ব্যবহার হয়। পাটকাঠি এবং পাটকাঠির ছাই পাটের আঁশের মতোই মূল্যবান। পাট কাটার মৌসুম শেষ পর্যায়ে। কৃষক পাট পানিতে জাগ দিয়ে আঁশ ছাড়িয়ে পাটকাঠি যত্ন করে শুকিয়ে নিচ্ছে। কেউ পাটকাঠি পুড়িয়ে ছাই সংগ্রহ করে রাখছে।
এতকাল জানা ছিল না কি আছে এই ছাইয়ে। বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন পাট গাছ থেকে আঁশ ছাড়িয়ে নেয়ার আগেই এই কাঠিতে প্রকৃতি থেকে অনুজীবের মতো লেগে থাকে কার্বন। এই আঁশের অনুজীব লেগে থাকা কাঠি আগুনে পোড়ার পর ছাই থেকে রাসায়নিক উপজাত কার্বন তৈরি হয়। যা অনেকটা কয়লা খনিতে কয়লার মধ্যে লুকিয়ে থাকা হীরার মতো। অন্যদিকে এই পাটকাঠির চাহিদা রয়েছে
কাঠের বিকল্প উপাদান (পারটেক্স জাতীয়) তৈরিতে। বর্তমানে এই জাতীয় কাঠে বুক শেলফ, দরোজা ইত্যাদি তৈরি হচ্ছে। কখনও অফসেট কাগজ তৈরিতে দরকার হয়।
পাটখড়ির ছাইয়ের কদর বেড়েছে। বর্তমানে চীনসহ ইউরোপ ও আমেরিকার কয়েকটি দেশে রফতানি হচ্ছে। ছাইয়ের ভেতরের কার্বন পাউডার থেকে তৈরি হচ্ছে কার্বন পেপার, কম্পিউটারের প্রিন্টার ও ফটো কপিয়ারের কালি (টোনার), আতশবাজি, মোবাইল ফোনের ব্যাটারি ও পলিমার ব্যাটারি, ফেসওয়াশের উপকরণ, প্রসাধন সামগ্রী, মাউথ ওয়াশ, দাঁত পরিষ্কারের ওষুধ সারসহ বিভিন্ন পণ্য।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর এক সূত্র জানায়, পাটকাঠির ছাই থেকে এক ধরনের জ্বালানি চারকোল তৈরি হওয়ার পর তার মধ্যে কার্বনের অস্তিত্ব আবিষ্কার হয় ২০০৭ সালে। শুরুতে এই চারকোলে রান্না শুরু হয়। সাধারণ কাঠের (খড়ি) জ্বালানির দাহ্য ক্ষমতার চেয়ে চারকোলের দাহ্য ক্ষমতা অনেক বেশি হওয়ায় চাহিদা বাড়ে। প্রতিটি এলাকায় চারকোল বিক্রয় কেন্দ্র স্থাপিত হয়। ২০০৯ সাল থেকে প্রাথমিকভাবে চারকোল রফতানি শুরু হয়। বর্তমানে ফরিদপুর, মাগুরাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে চারকোল কারখানা স্থাপিত হওয়ায় রফতানি বেড়েছে।
শুধু চারকোল খাতে বছরে রাজস্ব আসছে অন্তত ৫০ কোটি টাকা। চারকোলকে কেন্দ্র করে ৫০ হাজার মানুষের কর্ম সংস্থান হয়েছে।
এদিকে চারকোল কারখানায় কার্বনও তৈরি হচ্ছে। বর্তমান পরিচিতি কার্বন ফ্যাক্টরি। বাংলাদেশ চারকোল ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যান্ড এক্সপোর্ট এ্যাসোসিয়েশনের সূত্র জানায়, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে চারকোল রফতানি হয় ৪ হাজার ১৮২ মেট্রিক টন। বৈদেশিক মুদ্রা আসে প্রায় ৩০ লাখ ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে লকডাউনের কারণে ফ্যাক্টরির কার্যক্রম সীমিত হয়ে পড়ে। তারপরও গত বছর অক্টোবর থেকে চলতি বছরের প্রথম ভাগ পর্যন্ত স্থানীয় বাজারে বড় পরিসরে কার্বন সরবরাহ করা গেছে।     
কার্বন ফ্যাক্টরিগুলো জুলাই-আগস্ট থেকে পাটকাঠি কেনা শুরু করে। অক্টোবর থেকে মার্চ এপ্রিল পর্যন্ত মিলগুলো উৎপাদনে থাকে। প্রতি মণ পাটখড়ি থেকে প্রায় ১০ কেজি চারকোল পাউডার বা কার্বন উৎপাদিত হয়। কার্বন কারখানার এক সূত্র জানায় কার্বনের ৮০ শতাংশ রফতানি হয় চীনে। বাকি ২০ শতাংশ মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানী, তাইওয়ান। আগ্রহ বাড়ছে অন্যান্য দেশের।
বগুড়ার চারকোলের পাইকারি বিক্রেতা তোফাজ্জল হোসেন জানান, ফরিদপুরের মধুমতী নদীর তীরের একটি ফ্যাক্টরিতে কাজ করেছেন। বর্তমানে সেই কারখানা থেকে চারকোল এনে পাইকারি দরে বিক্রি করছেন। বগুড়া অঞ্চল ছাড়াও আশপাশে জয়পুরহাট নওগাঁ সিরাজগঞ্জে চারকোল সরবরাহ করেন। প্রতিটি জায়গায় চারকোল বিক্রেতা গড়ে উঠেছে। কারখানার মালিকগণ পাট কাটার মৌসুমে তাদের এজেন্টদের প্রতিটি এলাকায় পাঠিয়ে দেয়। পাটকাঠি কিনে ফ্যাক্টরিতে পাঠায়। ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন বলেন, কার্বন ফ্যাক্টরি  বৈদেশিক মুদ্রার পাশাপাশি আর্থ সামাজিক উন্নয়নেও অবদান রাখছে পাটকাঠি। পাটকাঠি আগে শুধু রান্নার জ্বালানি ও ঘরের বেড়া দেয়ার কাজে ব্যবহৃত হতো। কৃষক এখন পাটের সঙ্গে পাটখড়ি বিক্রি করছে। পাটখড়ির ছাইকেও আর অবহেলা করা যায় না।

 

×