ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আজও কাঁদায় কৃষ্ণপুরে গণহত্যার স্মৃতি

সবুজ গ্রাম নদীর জল রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল

জনকণ্ঠ ফিচার

প্রকাশিত: ০০:১৯, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২

সবুজ গ্রাম নদীর জল রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল

হবিগঞ্জে কৃষ্ণপুর গণহত্যা স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ

আর সব গ্রামের মতোই গাছপালা বেষ্টিত সবুজ একটি গ্রাম। গ্রামের মাটি, গ্রাম সংলগ্ন নদীর জল সবই রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল। ১৯৭১ সালে প্রত্যন্ত এ গ্রামে পৌঁছে গিয়েছিল বর্বর পাকিস্তান বাহিনী। হায়েনাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল তাদের দোসর রাজাকার-আলবদররা। নিষ্ঠুরতম গণহত্যা চালিয়েছিল তারা। হবিগঞ্জের এ গ্রামের নাম কৃষ্ণপুর। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৮ সেপ্টেম্বর শতাধিক নিরীহ-নির্দোষ মানুষকে এখানে হত্যা করা হয়। আজ সেই বেদনাবিধুর দিন, কৃষ্ণপুর গণহত্যা দিবস।   
২৫ মার্চের গণহত্যার কথা আমরা বিশেষভাবে জানি। কালরাত্রীতে ঢাকায় যে গণহত্যা চালানো হয়েছিল সে ইতিহাস নানাভাবে আমাদের সামনে আসে। জাতীয়ভাবে এবং খুব গুরুত্বের সঙ্গে পালিত হয় দিবসটি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্থানীয় ইতিহাস আমাদের চর্চার দুর্বলতার কারণেই অজানা থেকে যায়। কৃষ্ণপুর গণহত্যার ইতিহাসও যথেষ্ট আড়ালে পড়ে গেছে।
হবিগঞ্জ জেলার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে একদম শেষ মাথায় লাখাই উপজেলা। উপজেলা থেকে পাঁচ কিলোমিটার দক্ষিণে হিন্দু অধ্যুষিত কৃষ্ণপুর গ্রাম। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বলভদ্রা নদী। মুক্তিযুদ্ধের সময় অবশ্য গ্রামটি ছিল সিলেট জেলার অন্তর্গত।
সে সময়ের ইতিহাস পাঠে জানা যাচ্ছে, প্রত্যন্ত অঞ্চল হওয়ায় নিরাপদ ভেবে দূর-দূরান্ত থেকেও হিন্দুরা এ গ্রামে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। স্থানীয় রাজাকার-আলবদর-আল শামসরা এ খবর জানত। পাকিস্তানী ক্যাম্পে প্রতি মুহূর্তে খবর পাঠাত তারা। এরই ধারাবাহিকতায় ১৬ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে রাজাকাররা নদীপথে গ্রামটিতে এসে হাজির হয়। গোটা গ্রাম চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে তারা। ১৮ সেপ্টেম্বর অগ্রবর্তী রাজাকার দলের সঙ্গে যোগ দেয় পাকিস্তানী বর্বর বাহিনী।
জানা যায়, কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামে ক্যাম্প করেছিল হানাদাররা।  সেখান থেকে দুটি স্পীডবোটে করে ভোর ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে কৃষ্ণপুরে ঢোকে তারা। গ্রামের নিরীহ মানুষজন তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। এ অবস্থায় অতর্কিতে হামলা চালানো হয়। হামলায় অংশ নেয় রাজাকাররাও। গদাইনগর, চন্ডিপুর, লালচান্দপুর, গকুলনগর, গংগানগর, সতিারামপুরসহ বিভিন্ন পাড়া দখলে নেয় তারা। বাড়ি বাড়ি ঢুকে টাকাকড়িসহ মূল্যবান সম্পদ লুট করে। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়।

এ সময় গ্রামবাসীর অনেকেই কচুরিপানার মধ্যে কিংবা ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে প্রাণে বাঁচার চেষ্টা করেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি তাদের। রাজাকাররা গ্রামের মানুষজনকে খুঁজে বের করে ধরিয়ে দেয়। হত্যাকা-েও অংশ নেয় তারা। মোড়াকরি গ্রামের লিয়াকত আলী, বাদশা মিয়া, ফান্দাউকের আহাদ মিয়া, বল্টু মিয়া, কিশোরগঞ্জের লাল খাঁ, রজব আলী, সন্তোষপুর গ্রামের মোর্শেদ কামাল ওরফে শিশু মিয়াসহ অন্তত ৫০ জন রাজাকারের বিরুদ্ধে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকা-ে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়।
স্থানীয়দের তথ্য অনুযায়ী, কৃষ্ণপুর কমলাময়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে জড়ো করে ৪৭ জনকে হত্যা করা হয়। স্কুল প্রাঙ্গণে এখন শহীদদের একটি নামফলক চোখে পড়ে। ননী গোপাল রায়ের বাড়ির পুকুরের ঘাটলা, গদাইনগরের চিত্তরঞ্জন দাশের বাড়ির উঠানসহ চ-ীপুরের তিনটি স্থানে একইভাবে মানুষনজকে জড়ো করা হয়। তার পর নির্বিচারে গুলি, ব্রাশ ফায়ার। স্থানীয়দের তথ্য মতে, সব মিলিয়ে ১২৭ জনকে হত্যা করে পাকিস্তানীরা। নির্দোষ গ্রামবাসীর গুলিবিদ্ধ মরদেহ স্তূপাকারে পড়েছিল। কিছু ভাসিয়ে দেয়া হয়েছিল নদীর পানিতে।  
তবে গণহত্যার শিকার সবার নাম-পরিচয় জানা যায়নি। স্থানীয়ভাবে সংরক্ষিত একটি তালিকায় ৪৭ জনের নাম পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে রয়েছেন কালী দাস রায়, ডাঃ ননী রায়, রাধিকা মোহন রায়, গোপী মোহন সূত্রধর, সুনীল শর্মা, মুকুন্দ সূত্রধর, যোগেন্দ্র সূত্রধর, মহেন্দ্র রায়, অনিল মাঝি, চন্দ্র কুমার রায়, জয় কুমার রায়, শান্ত রায়, কিশোর রায়, ননী চক্রবর্তী, সুনীল চক্রবর্তী, ব্রজেন্দ্র দাস, জগদীশ দাস, ইশান দাস, ধীরেন্দ্র রায়, হরিচরণ রায়, মদন রায়, দাশু শুক্লবৈদ্য, হরি দাশ রায়, শব লঞ্জন রায়, রামাচরণ রায়, ডাঃ অবিনাশ রায়,  শৈলেস রায়, ক্ষিতিশ  গোপ, নীতিশ গোপ, হীরা লাল গোপ, প্যারি দাস, সুভাষ সূত্রধর, প্রমোদ দাস, সুদর্শন দাস, গোপাল রায়, দীগেন্দ্র আচার্য্য, রেবতী রায়, শুকদেব দাস, দীনেশ বিশ্বাস, মনোরঞ্জন বিশ্বাস, রস রাজ দাস, জয় গোবিন্দ্র দাস, বিশ্বনাথ দাস, মহাদেব দাশ, মহেশ দাস, শবরঞ্জন রায় ও মনোরঞ্জন বিশ্বাস।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী চ-ীপুর পাড়ার বাসিন্দা গোপাল চন্দ্র রায়ের ছেলে গোপেন চন্দ্র রায়। সে সময় বয়স ছিল ৭ বছর। তার বর্ণনা মতে, পাকিস্তানীরা গ্রামের মানুষজনকে রসি দিয়ে হাত পা বেঁধে ফেলে। পরে গুলি করে হত্যা করা হয়। গদাইনগরের দীন বন্ধু, পরিতোষ রায়সহ কয়েকজন বেঁচে যান ভাগ্যক্রমে। আর চ-ীপুরের প্রায় সবাইকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

একই পাড়ার বাসিন্দা জয় কুমার রায়ের ছেলে বেনুপদ রায়ের বয়স ছিল ১১ বছর। সে সময় তিনি নিজ চোখে প্রত্যক্ষ  করেছেন এই বর্বরতা। তার বর্ণনা থেকে জানা যায়, সেদিন তার বাবা জয় কুমার রায়, চাচা চন্দ্র কুমার রায়সহ ৭ জন আত্মীয়কে গুলি করে হত্যা করে পাকবাহিনী। হত্যার পর মৃতদেহ পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হয়।
সরেজমিনে কৃষ্ণপুর হত্যাকা- সংঘটিত এলাকা ঘুরে  দেখা যায়, আজও ননী গোপাল রায়ের বাড়ির টয়লেটের  দেয়ালে, বাড়ির পাশের দুর্গামন্দিরের দেয়ালে গুলির ক্ষতচিহ্ন রয়ে গেছে।  স্বজন হারানোর বেদনায় গ্রামবাসী আজও চোখের জল ফেলছেন। হত্যাকা-ের বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছেন তারা।
বর্তমানে কৃষ্ণপুরে নিহতদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। আজ সেখানে ফুল দিয়ে শদীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হবে।

×