
জর্জ হ্যারিসন। যার নাম শুনলেই চোখে ভেসে ওঠে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধের ইতিহাস। বাংলাদেশ দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। ১৯৭১-এ স্বাধীনতা যুদ্ধে লড়াই করে এই দেশের মানুষ বাংলাদেশ নামক স্বাধীন এক ভূখ- ছিনিয়ে এনেছে। সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করেও অনেকেই মানসিক ও আর্থিক সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। প্রকৃত বন্ধুর মতো পাশে থেকেছেন। অবশ্য, তাদের এই অবদান কখনও ভোলার নয়। যে যেভাবে পেরেছেন যুদ্ধাহতদের সাহায্য করেছেন। সেসব অকৃত্রিম বন্ধুদের মধ্যে একজন হলেন জর্জ হ্যারিসন।
বিংশ শতাব্দীর অত্যন্ত প্রতিভাবান একজন জনপ্রিয় গায়ক এবং গিটারিস্ট। যার জন্ম ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৪ সালে ইংল্যান্ডের লিভারপুলে। তিনি জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯৬৬ সালে ব্রিটিশ মডেল ও ফটোগ্রাফার প্যাট্রিসিয়া অ্যান বয়েডকে বিয়ে করেন জর্জ হ্যারিসন। এর পর এক দশকের বেশি সময়ের দাম্পত্য জীবন শেষ হয় ১৯৭৭ সালে বিয়েবিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে। এর পর তিনি আমেরিকার বিখ্যাত দার্শনিক, লেখিকা, ফিল্ম পরিচালিকা অলিভিয়াকে বিয়ে করেন। জর্জ হ্যারিসন মারা যান ২০০১ সালের ২৯ নবেম্বর, ফুসফুসে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে। জর্জ হ্যারিসন মূলত বাঙালীদের কাছে পরিচিত হোন কনসার্ট ফর বাংলাদেশের মাধ্যমে। কনসার্ট ফর বাংলাদেশের নাম শোনেননি এমন মানুষের সংখ্যা খুব কম। এটি একটি চ্যারিটি প্রোগ্রাম। যার মাধ্যমে বিশ্ব জানতে পেরেছিল নির্যাতিত, নিপীড়িত বাঙালীর কথা। পাকিস্তান কর্তৃক অন্যায়, অবিচারের কথা। তাদের হত্যাযজ্ঞের কথা। তাৎকালীন মিডিয়ার বহুল প্রচার ছিল না। ছিল না সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম! তাই বিশ্বের কাছে বাংলার দুর্দশা আড়ালেই থেকে যাচ্ছিল। বিশ্বের গণমাধ্যমে হানাদার বাহিনীর অরাজকতা আর গণহত্যার খবর প্রচার হলেও তা ছিল অপ্রতুল। দুঃখজনক হলো যে চীন, আমেরিকার মতো রাষ্ট্র এই মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেনি! ১৯৭১’র আগস্টে সেই আমেরিকার নিউইয়র্কের মাটিতে বিশ্বের নামীদামী সঙ্গীতশিল্পী মিলিত হয়ে আয়োজন করেন চ্যারিটি শো ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। কনসার্টের মূল উদ্যোক্তা প-িত রবিশঙ্কর মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিশ্বজনমত গড়ে তোলা এবং শরণার্থীদের আর্থিক সহায়তা দেয়ার জন্য শিল্পী জর্জ হ্যারিসনকে নিয়ে এই অবিস্মরণীয় কনসার্টের আয়োজন করেছিলেন। তিনি মূলত কথা বলেন, পপ সঙ্গীতের সুপরিচিত ব্যান্ড বিটলসের অন্যতম সদস্য জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে এবং তিনি সম্মত হওয়ার পরে নিজেই যোগাযোগ করেন আরও শিল্পীদের সঙ্গে। জর্জ হ্যারিসন ও তার মানবতাবাদী গায়ক বন্ধুরা গানে গানে বাঙালীদের ওপর চলা নির্মম অত্যাচারের কথা বিশ্ববাসীকে শুনিয়েছিলেন। কনসার্ট ফর বাংলাদেশ শুধু আর্থিক সহযোগিতায় সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং বাংলাদেশের অস্তিত্বের কথা, চলমান গণহত্যার কথা, দেশান্তরী শরণার্থীর কথা সারাবিশ্বকে জানিয়েছিলেন তারা। দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ শুরু হয়েছিল প-িত রবিশঙ্করের একটি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিয়ে। এ কনসার্টের জন্য তিনি তৈরি করেছিলেন ‘বাংলা ধুন’ নামে নতুন একটি সুর। আর তাঁর সঙ্গে যুগলবন্দী ছিলেন ওস্তাদ আলী আকবর খান। তবলায় সহযোগিতা করেছিলেন বিখ্যাত আল্লা রাখা। তানপুরায় ছিলেন কমলা চক্রবর্তী। সেদিন ম্যাডিসন স্কয়ারের অনুষ্ঠানে জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে ছিলেন অন্যতম প্রতিবাদী গানের রাজা বব ডিলান। যাকে ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ১৩ অক্টোবর সুইডিশ একাডেমি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করে। তিনি পৃথিবীর প্রথম গীতিকার, যিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। অদ্যাবধি তার বিক্রীত রেকর্ডের সংখ্যা ১০ কোটির বেশি। ওই কনসার্টে তিনি গেয়েছিলেন ছয়টি গান, ‘মি. ট্যাম্বুরিনম্যান’ থেকে শুরু করে তাঁর লেখা ও সুরারোপিত ৫০ লাইনের বিখ্যাত গান ‘আ হার্ড রেইন ইজ গোননা ফল’। সেদিন বব ডিলানের সঙ্গে গিটার বাজিয়েছিলেন জর্জ হ্যারিসন, ব্যাস লিওন রাসেল ও ট্যাম্বুরিন রিঙ্গো স্টার। সে অনুষ্ঠানে বিটলসের অন্যতম সদস্য রিঙ্গো স্টার, লিওন রাসেল, এরিক ক্ল্যাপটন, বিলি প্রেস্টন, ডন প্রেস্টনসহ কয়েকজন গান গেয়েছেন, গিটার বাজিয়েছেন। ’৭১-এর পাক হানাদার বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞের দৃশ্য জর্জ হ্যারিসনকে বেদনাতুর করে তুলেছিল। তিনি বাংলাদেশের নির্যাতিত মানুষের জন্য কিছু করতে চেয়েছিলেন। আমেরিকার মাটিতে ঘটে যাওয়া এই কনসার্ট হতে সংগৃহীত ২,৫০,০০০ মার্কিন ডলার বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের জন্য দেয়া হয়েছিল। কনসার্টে জর্জ হ্যারিসন তার নিজের লেখা বিখ্যাত সেই মর্মস্পর্শী বাংলাদেশ বাংলাদেশ গান পরিবেশন করেন। গানের মূল কথাই ছিল বিশ্বের মানুষের কাছে বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান। গানের সুরে মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন। স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন মানুষ মানুষের জন্য। জর্জ হ্যারিসন পুরো গানটা উচ্চৈস্বওে, করুণ বিলাপের সুরে, গভীর মানবিক ও বিপ্লবী আবেদন নিয়ে গেয়েছিলেন। দর্শক-শ্রোতা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আবেগে অশ্রুসিক্ত করেছিল। সেদিনই বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি স্বাধীনতা পাওয়ার আগেই স্বতন্ত্র দেশ হিসেবে পরিচিত হয়েছিল। এই কনসার্ট একবার নয়, দুইবার আয়োজন করা হয়েছিল। প্রথম কনসার্টের ভেন্যুতে দর্শকদের স্থান সংকুলান না হওয়ায় দ্বিতীয়বার আয়োজন করে কনসার্ট ফর বাংলাদেশের টিম। এবং কনসার্টের টিকেট, ক্যাসেট হতে প্রাপ্ত সমস্ত অর্থ ইউনিসেফের ফান্ডে জমা করা হয়। এই কনসার্ট সারাপৃথিবীকে নাড়াতে সক্ষম হয়েছিল। সারাপৃথিবীর মানুষ জানতে পেরেছিল পাকিস্তান সরকারের হত্যাযজ্ঞের কথা। কনসার্ট ফর বাংলাদেশ ছিল একটি উদ্যোগ, একটি প্রতিবাদ। বলা হয় যে, বিশ্বে যত বড় বড় মানবতাবিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে চ্যারিটি প্রোগ্রাম হয়েছে তার সূত্রপাত এই কনসার্ট ফর বাংলাদেশ থেকেই হয়েছে। স্বাধীনতার যুদ্ধে জর্জ হ্যারিসনের অবদানকে নব প্রজন্মকে জানাতে বাংলাদেশের পাঠ্যবইতে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে মহান এই মানুষের নাম। অষ্টম শ্রেণীর বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বইয়ে লেখা হয়েছে: ‘নিউইয়র্কে যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পী জর্জ হ্যারিসন বাংলাদেশ কনসার্ট আয়োজন করে তা থেকে প্রাপ্ত অর্থ মুজিবনগর সরকারের কাছে তুলে দেন। ভারতের খ্যাতিমান শিল্পী রবিশঙ্কর মুক্তিযুদ্ধে মানুষকে উজ্জীবিত করেন। তিনি বাংলাদেশ কনসার্টের আয়োজকদের মধ্যে অন্যতম।’ জর্জ হ্যারিসনকে নিয়ে দেশে লেখালেখি কম হয়নি। বাংলাদেশ সর্বদায় সম্মানের সঙ্গে জর্জ হ্যারিসনকে স্মরণ করে থাকে। বাংলাদেশ ও এদেশের মানুষের সঙ্গে জর্জ হ্যারিসনের আলাদা একটি টান ছিল। তাই জর্জ হ্যারিসনের মৃত্যুর পর ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে জর্জ হ্যারিসনের স্ত্রী অলিভিয়া হ্যারিসন ঢাকায় এসেছিলেন। অলিভিয়া ‘জর্জ হ্যারিসন ফান্ড ফর ইউনিসেফের’ অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং তিনি বাংলাদেশে এই প্রতিষ্ঠানের কাজ দেখতেই এসেছিলেন। জর্জ হ্যারিসন তার আত্মজীবনী বই ‘আই মি মাইন’ তে বাংলাদেশ নিয়ে লিখে গেছেন।
রবিশঙ্কর, জর্জ হ্যারিসন কিংবা বব ডিলান; এরা প্রত্যেকেই বাংলাদেশের এক একজন অকৃত্রিম বন্ধু। বাংলাদেশ এসব মহান বন্ধুকে আজীবন মনে রাখবে।