
‘অবরোধ বাসিনী’-শব্দটি দ্বারা শৃঙ্খলায়িত থাকাকে বোঝায়। অবরোধ বাসিনী কারা বা অবরোধ বাসিনী বলতে কাদের বুঝিয়েছেন সে বিষয়ে বলতে গেলে বলা যায় অবরোধ বাসিনী রচনাটি বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ওই সময়কার নারীদের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে লিখিত ঘটনার বর্ণনা। সেই সময়ে এমন এক পরিস্থিতি বিদ্যমান ছিল যখন নারী শিক্ষা তো অনেক দূরের কথা বরং নারীর বাইরে বের হওয়া, কথা বলা এবং অন্যান্য কাজেও ছিল প্রতিবন্ধকতা। সেখানে প্রতি পদে পদে নারীদের পেছনে থাকতে হতো। এমনকি নারী মানসিকভাবেই যে দুর্বল ছিল সেকথাও স্পষ্ট ছিল। নারীদের এই অবস্থার পেছনে সামাজিক শৃঙ্খল যেমন ছিল অন্যদিকে নিজেদের মানসিকতারও দায় ছিল। সেই বন্দী থাকার মানসিকতা বা নারীর ওপর চাপিয়ে দেয়া বিধি-নিষেধ উঠে এসেছে বেগম রোকেয়ার অবরোধ বাসিনী গ্রন্থে। অবরোধ বাসিনী বলতে লেখিকা যাদের বুঝিয়েছেন তারা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ভয়ে এবং অনেক ক্ষেত্রে নিজেরাই নিজেদের ভেতর গুটিয়ে থাকতেন। তাদের চারপাশে ছিল এক ধরনের অদৃশ্য শক্তি যা সমাজের বিধি-নিষেধ, ধর্মীয় গোড়ামির আতিশয্য, ভুল ব্যাখ্যা, অবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি যা থেকে শিক্ষাই ছিল মুক্তির পথ এবং মূলত সেই পথও ছিল নারীদের জন্য রুদ্ধ। যে পথের আলো দেখিয়েছেন এই বেগম রোকেয়াই। বহু সংগ্রাম করে নারী শিক্ষার ভিত রচনা করেছেন। তাদের শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে বুঝিয়েছেন। সে কথায় পরে আসছি। অবরোধ বাসিনীর শুরুতেই তিনি বলে নিয়েছেন, আমরা বহুকাল হইতে অবরোধ থাকিয়া থাকিয়া অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছি সুতরাং অবরোধের বিরুদ্ধে বলিবার আমাদের বিশেষত আমার কিছুই নাই। মেছোনীকে যদি জিজ্ঞাসা করা যায় যে, ’পচা মাছের দুর্গন্ধ ভাল না মন্দ?’ সে কি উত্তর দেবে? এ কথা বলেই তিনি তার স্বচোক্ষে দেখা ঘটনার বর্ণনা শুরু করেছেন। যেখানে একজন নারী আর একজন নারীর সামনে নিজেকে প্রকাশ করতে কিভাবে লজ্জিত বোধ করে সেই ঘটনার বর্ণনা টেনেছেন। এই নারী ছিল বিদেশীনি। তৎকালীন সমাজে এই মেমদের নিয়ে সেই সময়ের নারীদের মধ্যেই এক ধরনের অস্পৃশ্যতা লক্ষ্য করা গেছে। যেহেতু তাদের পোশাক- আশাক, চাল-চলনে, কথা-বার্তায় ছিল বাঙালীর চেয়ে ভিন্ন। পাশ্চাত্য দেশে নারীদের ক্ষেত্রে বৈষম্যের চিত্র ততটা প্রকট না হলেও প্রাচীন সমাজ ব্যবস্থা থেকেই এই উপমহাদেশে নারীদের অদৃশ্য শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হতো। এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, নারীর মানসিকতাও পিছিয়ে রাখা হয়েছিল বা নারী নিজেও সেই শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে আসতে চাননি। আজও যে সে চেষ্টা একেবারে করা হয় না সে কথা সত্যি নয়। তবে সেই শেকল ভাঙার জন্য কারও প্রয়োজন হয়। সমাজের কুসংস্কারের জাল ছিঁড়ে ফেলার মতো সাহস ও ধৈর্য দরকার হয়। এর সঙ্গে পরিবারের কারও সমর্থনও দরকার হয়। বেগম রোকেয়াও কিন্তু সেই সমর্থন পেয়েছিলেন। সেটা প্রথমে তার পরিবারে এবং পরে তার স্বামীর কাছ থেকে।
রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রাম। আজ যে স্থানে আলো ছড়াচ্ছে বেগম রোকেয়া বিশ^বিদ্যালয়। দিকে দিকে শিক্ষার বাতি হয়ে জ্বলছে। তার শুরুটা হয়েছিল নিতান্তই এক খাঁচা-সম পরিবেশের মধ্যে দিয়ে। সময়টা ১৮৮০ সাল। কঠোর পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা যখন অপসংস্কৃতির আর নারী বিদ্বেষী নিয়মের বেড়াজালে নারীরা বন্দী ছিল তখন বেগম রোকেয়া জন্মগ্রহণ করেন। সমাজের কাঠামো এমন স্্েরাতে প্রবাহিত হচ্ছিল যেখানে নারীদের কঠোর নিয়মের মধ্যে জীবন যাপন করতে হতো। জ্ঞান তৃষ্ণা পূরণ করাও তখন বেশ দুরূহ ছিল। বেগম রোকেয়াকে নারী আন্দোলনের অগ্রদূত বলা হয়। কেন তাকে অগ্রদূত বলা হয় তা তার জীবন আলোচনা থেকেই বোঝা যায়। তিনি যে সময় জন্ম গ্রহণ করেন সে সময় ইংরেজী শিক্ষা তো বহুদুরের কথা মেয়েদের শিক্ষা গ্রহণই ছিল নিষেধ। মেয়েদের কাজ ছিল সন্তান জন্মদান, লালনপালন ও গৃহ কাজকর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এমনকি নিজ পরিবারেও মতামত প্রকাশ করা ছিল কঠিন কাজ। বাইরের জগতে বের হওয়ার সুযোগও ছিল খুব কম। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি আবিষ্কার করলেন বাইরের পৃথিবীটা তার জন্য নয়। সেটা শুধুই পুরুষদের দখলে। তাকে ঘরেই আরবী ও উর্দু শিক্ষা দেয়া হলো। তবে জ্ঞানের নেশা যাকে পেয়ে বসে তাকে থামানো যায় না। বেগম রোকেয়ার বড় ভাই ইব্রাহীম ছিলেন আধুনিক মনস্ক। তিনিই বেগম রোকেয়াকে বাংলা ও ইংরেজী শেখান। তবে তা পরিবারের অন্য সদস্যদের অন্তরালে।
নিজ পরিবারেই একাধারে ইংরেজী শিক্ষার বিরোধী থাকলেও বড় ভাইয়ের মতো আধুনিকমনস্ক মানুষের সংস্পর্শে আসতে পেরেছিলেন। যা পরবর্তীকালে তার জ্ঞান তৃষ্ণাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। শিক্ষার জন্য এমন ধ্যান ছিল বলেই তিনি নিজে জাগতে পেরেছেন হতে পেরেছেন নারী জাগরণের অগ্রদূত। নিজেকে জাগানোই যেখানে বেশ কঠিন কাজ সেখানে অন্যকে জাগিয়ে তোলার কাজটিও তিনি দক্ষ হাতেই করেছেন। তার হাত ধরেই নারী অধিকার আদায়ে পরবর্তীতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। তবে শুধু নারী জাগরণের অগ্রদূত বললে বেগম রোকেয়ার ভূমিকাকে সঠিক মূল্যায়ন করা যায় না বলেই আমার মনে হয়। কারণ যে পরিবেশের মধ্যে থেকে তিনি ইংরেজী শিক্ষা লাভ করেছিলেন এবং পরবর্তীতে বাংলা ও ইংরেজী মাধ্যমে সাহিত্য রচনা করেছেন তাও বিবেচনায় আনতে হবে। যদিও তার অধিকাংশই নারী অধিকার আদায়ে সচেষ্ট ভূমিকা পালন করেছে কিন্তু পড়ার প্রতি যে তীব্র ঝোঁক তাও শেখায়। সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন একজন মুক্তমনা মানুষ। তিনি শুধুমাত্র তার স্ত্রীকে সাহিত্য চর্চার উদার পরিবেশ সৃষ্টি করেই বসে ছিলেন না, একটি স্কুল তৈরির জন্য অর্থ আলাদাও করে রাখেন। এতে তার বিদ্যা মনস্ক মনের পরিচয় পাওয়া যায়। যে পরিবেশ বেগম রোকয়ার পরবর্তী জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতেও ভূমিকা রেখেছিল। আজ থেকে একশ বছরেরও বেশি সময় আগে বেগম রোকেয়া যে সাহসিকতা, উদার মনোভাব দেখিয়েছেন তা আজও নারীদের অগ্রযাত্রায় অনুসরণীয়, অনুকরণীয়। নারীরা যে কেবল ভোগের সামগ্রী নয় সে কথা তার রচনার মধ্যে দিয়ে তিনি বুঝিয়ে গেছেন। বেগম রোকেয়া তার চিন্তা চেতনা, তার ধ্যান ধারণায় তখনকার নারীদের চেয়ে ছিলেন অনেক অনেক এগিয়ে। এমনকি এই আজ আধুনিক যুগে দাঁড়িয়েও অনেক নারী যখন তার অধিকারের কথা বলতে দ্বিধা করে তখন তিনি তার কর্ম দিয়ে দৃঢ় চেতনার পরিচয় দিয়েছেন।
ফিরে আসি অবরোধ বাসিনীতে। তৎকালীন সমাজের অবস্থা এতটাই করুণ ছিল অর্থাৎ নারীরা নিজেদের এতটাই আড়ালে রাখতে চাইত যে তার কণ্ঠ পর্যন্ত কোনো পুরুষের কানে যাতে না পৌঁছায় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকত। তার অবরোধবাসিনী-৩ এ এই ধরনের একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। অবরোধ বাসিনী-৭ এ একটি নিদারুণ অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন। বর্ণনাটি এ রকম- ঢাকা জিলায় কোন জমিদারের প্রকা- পাকা বাড়িতে আগুন লাগলে বাড়ির মহিলাদেরও বাহির করার প্রয়োজনবোধ হলো। তবে এতগুলো পালকি একসঙ্গে জোগাড় করতে না সমর্থ না হওয়ায় একটা বড় রঙিন মশারির মধ্যে বাড়ির নারীদের একত্র করে রওনা হয়। পথে কাঁটা এবং অন্য কারণে মশারি ছিঁড়ে ভেতরের সবাই যখন বাইরে বেরিয়ে আসল তখন পর্দা রক্ষায় ধানক্ষেতে সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে কাটায়। পরে সন্ধ্যার পর পালকি এনে তাদের নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়! কি আশ্চর্য এবং করুণ অভিজ্ঞতা সে সময়ের নারীদের হয়েছে তা অবর্ণনীয়। আর একটি ঘটনায় আরও বেশি মর্মান্তিক বর্ণনা দেয়া হয়েছে। ‘অবরোধ বাসিনী-৮ এ। এক বাড়িতে আগুন লাগিয়াছিল। গৃহিনী বুদ্ধি করিয়া তাড়াতাড়ি করিয়া সমস্ত অলঙ্কার একটা হাত বাক্সে পুড়িয়া লইয়া ঘরের বাহির হইলেন। দ্বারে আসিয়া দেখিলেন সমাগত পুরুষেরা আগুন নিবাইতেছেন। তিনি তাহাদের সম্মুখে বাহির না হইয়া অলঙ্কারের বাক্সটি হাতে করিয়া ঘরের ভেতর খাটের নিচে গিয়া বসিলেন। তদবস্থায় পুড়িয়া মরিলেন, কিন্তু পুরুষের সম্মুখে বাহির হইরেন না। ধন্য! কুল কামিনীর অবরোধ!
যাই হোক বেগম রোকেয়ার অবরোধ বাসিনীর প্রতিটি ঘটনাই সেই সময়কার নারীদের সামাজিক অবস্থান, কঠোর পর্দা প্রথা, অশিক্ষা, কুসংস্কার, পুরুষতান্ত্রিকতা নির্মমতা প্রভৃতি বর্ণিত হয়েছে। ঘটনাগুলো পড়লেই পাঠক মাত্রই বুঝতে অসুবিধা হয় না এ রকম একটি প্রতিকূল পরিবেশে বেগম রোকেয়া নারী শিক্ষার প্রজ্বলন করেছিলেন। এ কারণেই বেগম রোকেয়ার প্রতি সাধুবাদ।